আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় অতুলপ্রসাদ সেনের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ। অতুল প্রসাদ খেয়াল , ঠুমরি এবং দাদরার মতো দ্রুতগতির হিন্দুস্তানি সুরগুলি দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছিলেন এবং সুরটি গানের কথা ছাড়িয়ে যাওয়ার সময়ে স্বতঃস্ফূর্ততার একটি উপাদান যোগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলা সঙ্গীতে ঠুমরি শৈলী প্রবর্তনের কৃতিত্ব অতুল প্রসাদকে দেওয়া হয়। তিনি বাংলা ভাষায় গজল প্রবর্তনেরও পথপ্রদর্শক।
অতুলপ্রসাদ সেনের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ
কণ্ঠে মায়াভরা সুর আর অন্তরে সহজ সুরের অতুলনীয় মূর্ছনা নিয়ে জন্মেছিলেন গীতকবি অতুলপ্রসাদ সেন। রবীন্দ্রনাথ বা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়ার সুযোগ হয়নি অতুলপ্রসাদ সেনের কিন্তু মাতামহ কালী নারায়ণের বাউল গান ও পিতা রামপ্রসাদ সেনের শান্ত মঙ্গলাচরণ শুনে শুনে সংগীতের সাথে হৃদয়ের সংযোগ হয় তাঁর নিজের অজান্তেই।
আপন অন্তরের নিভৃতেই গানের জগতে প্রবেশ হয়েছিলো অতুলপ্রসাদ সেনের। কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাগুরুর কাছে নিয়মনীতি মেনে সংগীত শিক্ষার সুযোগ তার কখনো হয়নি। তবে অতুলপ্রসাদ সেন বরাবর ভক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের। যে কারণে তিনি খামখেয়ালী স্বভাবের সদস্য হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন।
এই খামখেয়ালী স্বভাবের সদস্য হয়েই তিনি রাধিকাপ্রশান্ত গোস্বামীর সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ লাভ করেন। রাধিকাপ্রশান্ত গোস্বামীর উচ্চাঙ্গসংগীতে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর মতো উচ্চাঙ্গসংগীত রচনার বাসনা করেন। অতুলপ্রসাদের নিজের কথায় জানা যায়,
“খামখেয়ালী আসরে বিখ্যাত গায়ক রাধিকাপ্রশান্ত গোস্বামী তাঁহার উচ্চাঙ্গের তাল-লয়মণ্ডিত গান গাহিয়া আমাদের মনোরঞ্জন করিতেন। আমি ভাবিতাম, আমিও তাঁহার মতই সুর রচনা করিব। রবীন্দ্রনাথের সংগীত প্রতিভা এমন সর্বমুখী যে, গোস্বামী মহাশয়ের উপাদেয় সুরে রবীন্দ্রনাথ গান বাঁধিতেন এবং কবির সে নব রচিত গানগুলি রাধিকাপ্রশান্ত খামখেয়ালী আসরে শুনাইতেন।
খামখেয়ালী মজলিসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অধিকারী। আমরা ছিলোম তাহার সাঙ্গপাঙ্গ। তাঁহারই পদতলে আমাদের বিশেষত আমার সুরদীক্ষা। কর্মসূত্রে অতুলপ্রসাদ সেন লক্ষ্মৌ শহরে বাসা বাঁধেন। লক্ষ্ণৌর আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ ছিলো সুরের মায়াজলে। ঠুংরী ছিলো লক্ষ্মৌবাসীর অন্তরের সুর। সেই ঠুংরী গানের মধুরস অতুলপ্রসাদের সংগীত জীবনের গতি বদলে দিলো।
তাঁর রচিত স্বদেশপর্বের গানও এর ব্যতিক্রম নয়। রাগ-রাগিণীর ব্যবহার থেকে শুরু করে বাউল-কীর্তনের সুরও তিনি প্রয়োগ করেছেন তাঁর স্বদেশপর্বের গানের সুর রচনায়। এছাড়াও ভাটিয়ালি, রামপ্রসাদী সুরের উপস্থিতিও পাওয়া যায় তাঁর স্বদেশপর্বের গান রচনায়। এই ধারার গানের কতিপয় উদাহরণ দেওয়া হলো-
১. কিষাণ ভাই, তুমি কি ফসল ফলাবে-ভাটিয়ালি ।
২. দেখ মা এবার দুয়ার খুলে-রামপ্রসাদী মানসী।
৩. মোদের গরব মোদের আশা বাউল ।
8. প্রবাসী চল রে দেশে চল বাউল।
অন্যান্য গীতিকবিদের মতো অতুলপ্রসাদ সেনের ক্ষেত্রেও স্বদেশি গানের সুর রচনায় রাগ-রাগিণীর ব্যবহারবর্জিত সাধারণ বাংলার বাউল-কীর্তনের সুরে রচিত গান অধিক গ্রহণযোগ্যতা ও মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অত্যন্ত প্রিয় গান, ‘দেখ মা এবার দুয়ার খুলে’ গানটি। সমবেত কণ্ঠে গীত এই গান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে হতাশার বুকে আশা জাগানিয়া সুর।
রামপ্রসাদী সুরের এমন এক বাংলার নিজস্ব ঢং রয়েছে যাতে বাংলার প্রতিটি প্রাণ আন্দোলিত হয়। এ প্রসঙ্গে স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তিটি সংযুক্ত করতে চাই,
“অতুলপ্রসাদের গানের সুর অত্যন্ত সরল। বড়ো ভালে, লয়ের বৈচিত্র্যে গানগুলি নিবন্ধ নয়। কাব্যসংগীতের বাক্রবন্ধে যে সারল্য আছে, সুরেও সেই সরলতা স্পষ্ট। বাউল, কীর্তন, ভাটিয়ালিতে বাঁধা আছে তাঁর অনেকগুলি গান। বাউল বা কীর্তনের সুরে আছে সহজ সুর প্রয়োগ।
অতুলপ্রসাদ প্রায় ৪০টির মতো বাউল-কীর্তন অঙ্গের গান রচনা করেছেন, অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বাউল বা কীর্তনের সুরে যে আবেগমথিত হৃদয়ানুভবে উদাত্ত গভীর আহ্বান ছড়ানো, তা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। তবে, বাউল বা কীর্তনের প্রচলিত আঙ্গিকে তিনি উত্তর ভারতের সুররীতিকে অপূর্ব মিশিয়েছে, এবং তার ফলে গানগুলির সুরে বাউল-কীর্তনের ছাপ স্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও অতুলপ্রসাদের ঠুংরী-ভঙ্গিম রীতির সুক্ষ্ম সংবেদনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
অতুলপ্রসাদের বিখ্যাত ‘মোদের গরব মোদের আশা’ গানটিও রচিত বাউল সুরে। রবীন্দ্রপ্রেমে উদ্ভাসিত অতুলপ্রসাদ সেন রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তিতে অগুলিমালাস্বরূপ রচনা করলেন সমগ্র বাঙালির অন্তরের গান। অতুলপ্রসাদ যে মূলত চির স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে রইল সংগীতের আসরে বাউল সুরে রচিত তাঁর এই সৃষ্টির জন্য,
“মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা !
তোমার কোলে তোমার বোলে কতই শান্তি ভালোবাসা ।
কী যাদু বাংলা গানে-
গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে।
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।
ওই ভাষাতেই নিতাই গোরা আনল দেশে ভক্তিধারা-
আছে কই এমন ভাষা, এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা?”
(বাউল সুর)
অতুলপ্রসাদ সেনের ৯৩টি রাগভিত্তিক গান রয়েছে তাঁর সমগ্র রচনা ২০৮টি গানের মধ্যে। তিনি ভৈরবী, খাম্বাজ, বেহাগ প্রভৃতি রাগ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি রাগের প্রথাগত বিষয়ে খুব নিষ্ঠাবান ছিলেন না। কারণ গানের ভাব প্রকাশে সুরের ব্যবহারে তিনি বাণী ও তালের সম্মিলনকেই অধিক প্রাধান্য দিতেন।
তাই যথার্থ ভাব প্রকাশে তিনি রাগের অব্যবহৃত স্বরসংগতির স্বরলিপি প্রদত্ত স্বরটিকেও নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করতেন। তাঁর গানে বেহাগ ও জয়জয়ন্তীর এমন উদাহরণ রয়েছে। অতুলপ্রসাদ সেন তাঁর গানের সুর রচনায় তুলনামূলক হালকা রাগ বেশি গ্রহণ করতেন । বেহাগ, খাম্বাজ ও ভৈরবী প্রভৃতি রাগে এক প্রকার গভীর কারুণ্যতা আছে যা মূলত তাঁর হৃদয়ের চেতনাকে স্পর্শ করতে পারতো।
অতুলপ্রসাদ সেনের রাগনির্ভর কতিপয় স্বদেশি গানের তালিকা দেওয়া হলো,
১. কঠিন শাসনে করো মা, শাসিত-খাম্বাজ।
২. জাগো জাগো জাগো এবে-ভৈরো।
৩. খাঁচার গান গাইব না আর-ভৈরবী।
৪. এসো প্রবাস মন্দিরে, এসো গো বঙ্গভারতী কাফি।
৫. এসো হে এসো হে ভারতভূষণ-বেহাগ ।
৬. জয়তু জয়তু জয়তু কবি নটমল্লার।
৭. আপন কাজে অচল হলে (বিচিত্র)-বেহাগ।
এই সকল গানেই কবি স্বদেশমাতার রূপ ঐতিহ্যের যেমন বঞ্চনা করেছেন, তেমনি এই ঐতিহ্য সংরক্ষণের শঙ্কা তাঁকে ঘিরে রাখত। তারও প্রকাশ ব্যক্ত হয়েছে এই সকল গানের সুরে। স্বদেশপর্বের কতিপয় গানে তালের গতি পরিবর্তনের প্রবণতা দেখা যায় অতুলপ্রসাদ সেনের গানে।
যদিও সুর প্রণয়নে লয়ের অভিনবত্ব তিনি গ্রহণ করেননি, কেবল স্বদেশি গানের উদাহরণে কোরাসে বা সমবেত কণ্ঠে দ্বিগুণ লয়ের এবং আবন্ধিত বাণী যেন ভারতবাসীর স্বদেশের প্রতি আবেগকে আরো ঘনিভূত করে তোলে। এক্ষেত্রে অতুলপ্রসাদ সেনের ভারত বন্দনার বিস্ময়কর ‘উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী’ গানটির উদাহরণ টানা যেতে পারে, যা শুক্লা বিলাবল রাগের আশ্রয়ে সুরারোপিত।
এর ‘জননী গো লহো তুলে বক্ষো অংশটিতে হঠাৎ দ্বিগুণ লয়ের কারণে স্বদেশমাতৃকার প্রতি সমর্পণের আকুলতা আরো তীর্যক ও স্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়।
আরও দেখুন :