অপেরার আবির্ভাব

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় অপেরার আবির্ভাব

অপেরার আবির্ভাব

 

অপেরার আবির্ভাব

 

অপেরার আবির্ভাব

ষোড়শ শতকের শেষ পর্বে ফ্লোরেন্সে কয়েকজন সঙ্গীতজ্ঞ ও সাহিত্যিকের চেষ্টায় ও উৎসাহে সর্বপ্রথম অপেরার বীজ রোপিত হয়। এর জন্মসূত্র প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, প্রাচীন গ্রীক- ট্রাজেডীর মধ্যে তার গোড়াপত্তন, সঙ্গীত ছিলো তার অপরিহার্য উপাদান। দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন কাল থেকেই নাটকে সঙ্গীতের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ও উপযোগিতা রয়েছে; তথাপি ষোড়শ শতকের শেষে অপেরার (প্রচলিত অর্থে) সূত্রপাত।

Daphne ও Apollo-র কাহিনীকে কেন্দ্র করে Ottavio Rinuccini কথা অংশ এবং মুখ্যত Jacopo Peri সুর যোজনা করলেন। ১৬০০ খৃষ্টাব্দে তাঁরা দুজনে Euridice নামে একটি অপেরা রচনা করলেন । সম্ভবত এটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ অপেরা। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভ্রান্তে দুটি ধারার জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়- ক. Classical Tragedy, Ballet এই ব্যালেকে কেন্দ্র করেই ফ্রান্সে অপেরার জন্ম।

Jean Baplise Lully (১৬৩২-১৬৮৭) যে রীতিতে অপেরা রচনা করলেন, তার সঙ্গে ইতালীয় অপেরার প্রভেদ দেখা গেল। তিনি নাটকীয় উপাদানের দিকে যেমন বেশী দৃষ্টি দিলেন, তেমনি যন্ত্রসঙ্গীতের প্রাধান্য ও দীর্ঘ গানের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট গানের ব্যবহার করলেন। তার সঙ্গে ব্যালের আদর্শও স্থান পেল, যেমন দৃশ্যসজ্জার ঘনঘটা। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ থেকেই জার্মান অপেরার স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা গেলো।

তার আগে সুদীর্ঘ এক শতাব্দীকাল মুখ্যত ইতালীয় রচয়িতারাই জার্মান ভাষায় অপেরা রচনা করতেন। সুতরাং বলাই বাহুল্য যে, জার্মান অপেরার সঙ্গে ইতালীয় অপেরার ঘনিষ্ঠতা সবচেয়ে বেশী। এই পর্বের স্মরণীয় জার্মান রচয়িতা হচ্ছেন Reinhard Keiser (১৬৭৪-১৭৩৯)। ইংল্যান্ডে অপেরার জন্ম ‘msque’ থেকে এবং The Venus and Adonis (১৬৮৫) John Blow রচিত প্রথম ইংরেজি অপেরা।

এই পর্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচয়িতা হচ্ছেন Henry Purcell (১৬৫৯-১৬৯৫); তাঁর Dido and Aneas (১৬৮৯) আজও বিশেষভাবে স্মরণীয়। ইংল্যান্ডে ষোড়শ শতকের শেষে যন্ত্রসঙ্গীতের জগতে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এলো- ‘music for music’s sake’, ‘abstract music. ‘ ইংল্যান্ডে ইতালীয় অপেরা কালক্রমে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

Retrortion যুগের ‘Recitative Musick’- এর চর্চা তো ছিলোই, তার সঙ্গে ফরাসী অপেরার নৃত্যাদর্শ ও যন্ত্রসঙ্গীত, সবশেষে ইতালীয় আদর্শ- এসবের সমন্বয়ে ইংল্যান্ডে অপেরার আদর্শ গড়ে উঠতে থাকে; তবু এর সঙ্গীতের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হয় নি। সোভিয়েট রাশিয়া প্রধানতঃ ইতালীয় অপেরার আদর্শ বজায় রেখেছিলো।

১৮৩৬ খৃষ্টাব্দে Chcrubini-এর অনুসরণে Glinka A Life for the Tear’ নামে একটি (Rescue Opera ) অপেরা রচনা করেন, যার ভিত্তি রুশসঙ্গীতের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই পর্বের রুশীয় রচয়িতাদের মধ্যে Moussorgsky (১৮৩৯-১৮৮১) বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য, যিনি তাঁর রচনার মধ্যে রুশ- সঙ্গীতের আদর্শ বজায় রেখেছেন। ইউরোপীয় অপেরার ইতিহাস সত্যই বিচিত্র, এবং তা সংক্ষেপে আলোচনার বস্তু নয়।

 

অপেরার আবির্ভাব

 

Wagner তাঁর সময় পর্যন্ত ইউরোপীয় অপেরা বিভিন্ন পরীক্ষার সীমান্ত অতিক্রম করেছে। কখনো কথার সঙ্গে নামমাত্র সুর, কখনো যন্ত্রসঙ্গীতের প্রাধান্য, কোথাও গায়কের কন্ঠসঙ্গীতের প্রাধান্য, কোথ ও বা এরই সঙ্গে নৃত্যও স্থান পেয়েছে। হালকা রসের অপেরার পাশাপাশি রোমান্টিক অপেরার যেমন আবির্ভাব ঘটেছে, তেমনি বিষয়বস্তুর দিক থেকেও অপেরা ক্রমশ বাস্তবের দিকে ঝুঁকেছে। আবার, এই অপেরাকে কেন্দ্র করেই ইউরোপীয় কথাশিল্পের যুগান্তর এসেছে।

কাজেই, ইউরোপে অপেরার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইউরোপীয় অপেরার এই জনপ্রিয়তা এবং তার ঐশ্বর্যই নিঃসন্দেহে ঊনিশ শতকের বাংলা দেশের রঙ্গমঞ্চকে স্পর্শ করেছে। অর্থব্যয়ে তখন কয়েকটি ইতালীয় অপেরা অভিনীত হয়েছিল যা জানা যায়। অপেরার বাইরের জৌলুসই তৎকালিন দর্শকদের আকৃষ্ট করেছিলো, সন্দেহ নেই।

রবীন্দ্রনাথের মনে এসব স্মৃতি কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিলো, তা বলা কঠিন। বোধ হয় ইউরোপ-প্রবাসেই তিনি এ সম্বন্ধে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহী হয়ে ওঠেন তাঁর নিজের লেখা থেকে এই কথাই ধারণা করা যায়। পরবর্তীকালে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে আর্থার সুলিভাসের গন্ডোলিয়ন সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে অপেরা সম্বন্ধে তাঁর কী মনোভাব ছিল তা অনুভব করা যায়। এই পর্বটি তখন ইংল্যান্ডে সঙ্গীতের দিক থেকে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ।

এর কিছুকাল আগে ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে Wagner ইংল্যান্ডে উপস্থিত হন, তাঁর অপেরার অভিনয়ে লন্ডনে তখন থেকেই অপেরার বা সঙ্গীতের নবজাগরণ শুরু হলো। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথম ইংল্যান্ডে যান, (২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮-ফেব্রুয়ারি ১৮৮০)। অনুমান করা যায়, যে নব-কল্লোল সৃষ্টি হয়েছিলো তৎকালীন লন্ডনে সাঙ্গীতিক জগতে, তিনিও তার রসাস্বাদ থেকে বঞ্চিত হন নি।

 

অপেরার আবির্ভাব

 

অপেরাকে তার নিজস্ব পরিবেশে কাছে থেকে দেখার এই সুযোগকেই তিনি বাল্মীকি-প্রতিভার মধ্যে ব্যবহার করেছিলেন।
এই কথাগুলি স্মরণ করেই সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, বাংলা গীতিনাট্যের ধারাটি বাল্মীকি-প্রতিভর মধ্যে শেষ পর্যন্ত সংহতি লাভ করেছে। কবি নিজেও এই গীতিনাট্যটিকে বিশেষ অনুরাগের সঙ্গে দেখতেন এবং নানা উপলক্ষ্যে এটি বহুবার অভিনীত হয়েছে। বস্তুতঃ বাল্মীকি-প্রতিভা স্বতন্ত্র বা পারস্পর্যহীন বিচ্ছিন্ন সৃষ্টি নয়, বরং পূর্বাপরতাসূত্রে এর ঐতিহাসিক ভূমিকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

আরও দেখুন :

Leave a Comment