আধুনিক যুগের বাদ্যযন্ত্র

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় আধুনিক যুগের বাদ্যযন্ত্র

আধুনিক যুগের বাদ্যযন্ত্র

 

আধুনিক যুগের বাদ্যযন্ত্র

 

আধুনিক যুগের বাদ্যযন্ত্র

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে ঐতিহাসিকগণ মধ্যযুগ বলে বিবেচনা করে থাকেন। সে অনুযায়ী এর পরবর্তী সময়কে নিঃসন্দেহে আধুনিক যুগ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আধুনিক যুগে বাদ্যযন্ত্রের দ্রুত বিবর্তন ঘটতে থাকে। প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সুবিধা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা হতে থাকে। ফলস্বরূপ বিবর্তনের ধারায় চলমান বাদ্যযন্ত্রগুলো পূর্ণতাপ্রাপ্তির দিকে অগ্রসর হয় এবং আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যে ধারার সংগীতের প্রচলন চলে এসেছে তাকে বলা হয় ধ্রুপদ সংগীত। ধ্রুপদ সংগীতকে শাস্ত্রীয় সংগীতের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ বলা হয়ে থাকে। ধ্রুপদ তখন প্রধান সভা সংগীত। সে সময়ে কণ্ঠসংগীতে যেমন ধ্রুপদ পরিবেশন করতেন শ্রেষ্ঠ কলাবন্তগন, তেমনি বাদ্যযন্ত্রেও ধ্রুপদী সংগীত পরিবেশন করতেন রাজসভার উঁচুমানের বাদকগন।

সেনী ঘরানার শিল্পীরা কন্ঠসংগীতের পাশাপাশি রবাব ও বীনে (রুদ্র বীণা) ধ্রুপদী সংগীত পরিবেশন করে শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ধ্রুপদ সংগীতে দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী এবং আভোগ এই চারটি বিভাগে মীড়, গমক ইত্যাদির সাহায্যে বিলম্বিত থেকে ক্রমান্বয়ে দ্রুততর লয়ে আলাপ পর্ব সমাপ্ত করা হয়। ক্রমে সংগীত রীতির বিবর্তনের ফলে ধ্রুপদের স্থানে খেয়াল আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে।

ফার্সি ভাষায় ‘খেয়াল’ আলাপের পরে মূল গানে প্রবেশ করা হয়। অর্থাৎ বাণী উচ্চারণ করে গান গাওয়া হয়। গানের চারটি বিভাগ (স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ) স্থির লয়ে গাইবার পর দুগুণ, তিনগুণ, চৌগুণ, ছয়গুণ, আটগুণ ইত্যাদি লয়ে গানটি গাওয়া হয় এবং প্রয়োজনবোধে ঐ লয়েই গমক, তেহাই ইত্যাদি প্রয়োগ করে গান শেষ করা হয়। ধ্রুপদে সাধারণত পাখোয়াজ সঙ্গত করা হয়, কারণ পাখোয়াজের শব্দ ধ্রুপদের ভাবগাম্ভীর্যের সাথে মানানসই।

খেয়াল শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘কল্পনা। নানাবিধ তান বিস্তার ইত্যাদির দ্বারা বিভিন্ন তালে রাগ গায়নকে বলা হয় খেয়াল। খেয়াল পরিবেশনার ক্ষেত্রে একজন শিল্পীর যথেষ্ট স্বাধীনতা রয়েছে এবং এখানে ইমপ্রোভাইজেশনের অনুমতি আছে বা সুযোগ রয়েছে। খেয়ালকে শোভিত করার জন্য অলংকরণ, স্বরের কম্পন, মীড়, গমক এবং নানা ধরণের তান – এ সবকিছুই ব্যবহার করা যেতে পারে।
খেয়াল রাগের উপর ভিত্তি করে রচনা করা হয় এবং একমাত্র রাগ ছাড়া তেমন কোন অনমনীয় বিধিনিষেধ এতে আরোপিত হয় না। খেয়ালের অলংকরণের রীতি এবং ইমপ্রোভাইজেশনের প্রথা ধ্রুপদে অনুপস্থিত। ধ্রুপদ এবং খেয়ালের তুলনামূলক আলোচনা এবং খেয়ালের বিকাশ প্রসঙ্গে সংগীত গবেষক ম.ন. মুস্তাফার “আমাদের সংগীত ইতিহাসের আলোকে” গ্রন্থ থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলো।

“তদানীন্তন ভারতীয় সংগীত ধর্মীয় আচার আচরণের নাগপাশে কঠোরভাবে আবদ্ধ। …… . সংগীত তাদের কাছে জীবনের বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যতকে অনুধাবন ও আবিষ্কারের প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো। গান গাইতে গেলেই মনে করা হতো এটি একটি ধর্মীয় আচার হিসেবে পালিত হতে যাচ্ছে এবং এর জন্য নির্ধারিত নিয়ম-কানুন অলঙ্ঘনীয়ভাবে মানতে হবে।

এই সময়ে ধর্ম প্রভাবমুক্ত, পরিমার্জিত সংগীতের নব তরঙ্গ নতুন এক আবেদন নিয়ে ভারতীয় সংগীত অঙ্গনে প্রবেশ করলো। বলতে গেলে ‘খেয়াল’ই সর্বপ্রথম ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। ”

সংগীতের নতুন পদ্ধতি বলতে খেয়ালের কথাই এখানে বোঝানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সংগীত গুণী হজরত আমীর খসরুর অবদানের কথা উল্লেখযোগ্য। খেয়াল রচনার ভিত্তি তৈরিতে হজরত আমীর খসরুর অবদান রয়েছে। আমীর খসরু খেয়ালের আবিষ্কর্তা না হলেও অলকৃত সুরের কাজ প্রয়োগ করে গান গাওয়ার একটি ধারার সূচনা তাঁর হাতেই হয়েছিলো। প্রসঙ্গক্রমে পুনরায় “আমাদের সংগীত ইতিহাসের আলোকে” গ্রন্থ থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলো।

“তিনি (আমীর খসরু) অলংকৃত সুরের কাজে মুসলিম পদ্ধতিতে গান গাওয়ার যে প্রণালী উদ্ভাবন করেছিলেন মধ্যযুগীয় অনেক ইতিহাসবেত্তা সেজন্য তাঁকে খেয়ালের প্রবর্তক হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। তিনি দেখিয়েছেন কি করে গানের সুর দ্রুত অনুবর্তনে একের পর আরেকটি এসে পড়ে। তরঙ্গের পর তরঙ্গ এসে বাতাসের গায়ে কি এক মোহনীয় সুর বাংকার সৃষ্টি করে।

তিনি সংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে এই মুক্ত রীতির প্রচলন ঘটিয়েছেন। সুরের কাজে তিনি যে আবেশ অনুভূতি সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছিলেন খেয়ালের আসল উদ্দেশ্য কিন্তু তাই। এই মুক্ত পদ্ধতিই খেয়াল পদ্ধতির ভিত রচনা করেছে। প্রায় দু’শো বছর পর জৌনপুরের শরকী শাসকরা উদারভাবে মুসলিম পদ্ধতির সংগীত পদ্ধতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছিলেন।

আমীর খসরুর মৃত্যুর পর থেকে সুলতান হোসের শাহ্ শরকীর রাজ্যভার গ্রহন করা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ধ্রুপদের একচ্ছত্র আধিপত্যের দরুন মুসলিম রীতির সংগীতের মোটেও কোন উৎকর্ষ ঘটেনি। তবে মুসলিম শাসকবর্গের দরবারে মুসলিম সংগীত রীতিসমূহ আপন অস্তিত্ব নিয়ে টিকে ছিলো। সুলতান হোসেন শাহ্ শরকী তাঁর ব্যক্তিগত অংশ গ্রহন ও সাধনায় খেয়ালকে জীবনী শক্তিতে উজ্জীবিত করেন।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে হোসেন শাহ্ শরকীই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমীর খসরুর ভাবধারার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে খেয়ালের রূপরেখা প্রণয়ন করেন এবং খেয়াল পদ্ধতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। খেয়ালকে এরপর সর্বাঙ্গীন পরিপূর্ণতা, জনপ্রিয়তার শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করেন সম্রাট মোহাম্মদ শাহের সভা- সংগীতজ্ঞ নিয়ামত বা সদারঙ্গ।

নিবেদিতপ্রাণ একজন সাধক সংগীতজ্ঞ হয়ে নতুন রীতির প্রচলন ও সংযোজন ঘটিয়ে তিনি খেয়ালকে নবতর রূপ দান করেন। তাঁরই সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় রক্ষণশীল ধ্রুপদকে পশ্চাতে ফেলে খেয়াল জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে কালজয়ী হয়ে আছে। সংগীতের এই বিশেষ ধারার প্রবর্তনের সাথে বাদ্যযন্ত্রের বিবর্তনের একটি যোগসূত্র রয়েছে। কারণ ধ্রুপদ থেকে খেয়ালের এই পালাবদলের সাথে বীণা, রবাব ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের স্থলে সারেঙ্গী এবং সেতারের এবং আরো পরে সরোদের উত্থান একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

সারেঙ্গী প্রচলনের পটভূমি

উচ্চাঙ্গ সংগীতে সারেঙ্গীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে সপ্তদশ অথবা অষ্টদশ শতাব্দীতে। যদিও এর অনেক আগে সারেঙ্গীর উদ্ভব হয়েছে। প্রথম যুগে লোকজ এবং ধর্মীয় সংগীতে এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিলো। এর পরে বাঈজীদের নৃত্য এবং ঠুমরী স্টাইলের গানের সহযোগী হিসেবে সারেঙ্গী প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লোকজ সংগীত, ধর্মীয় সংগীত এবং নৃত্যের সহযোগী থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীতে সারেঙ্গীর আগমন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

সংগীতের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের সাথে বিষয়টি জড়িত। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে ধ্রুপদের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং খেয়ালের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধ্রুপদ সংগীতের সাথে সহযোগী হিসেবে বীণা বাজানো হতো। কিন্তু খেয়ালের সঙ্গে বীণা তেমন মানানসই না হওয়ার কারণে নতুন একটি বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

সারেঙ্গী যখন নৃত্যের সহযোগী হিসেবে ব্যবহৃত হতো তখনই এই যন্ত্রের অমিত সম্ভাবনার বিষয়টি সংগীতজ্ঞদের নজরে আসে। কণ্ঠে যে সকল কাজ পরিবেশন করা হয় তার সবই সারেঙ্গীতে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। এ কারণে এটি উচ্চাঙ্গ সংগীতের তথা খেয়ালের উৎকৃষ্ট সহযোগী হওয়ার দাবীদার।

ঠিক এ কারণেই ক্রমে উচ্চাঙ্গ সংগীতে সারেঙ্গীর নির্দিষ্ট একটি অবস্থান তৈরি হয়ে যায় এবং প্রায় দু’শ বছর একচেটিয়াভাবে এই অবস্থান অক্ষুন্ন থাকে। তবে একটি কথা না বললেই নয়, তা হলো, অনুগামী যন্ত্র ছাড়া একক উচ্চাঙ্গ যন্ত্র হিসেবে সারেঙ্গী তখনো সামাজিকভাবে স্বীকৃত ছিলো না।

সারেঙ্গীকে উৎকৃষ্ট মানের উচ্চাঙ্গ সংগীত পরিবেশনের যন্ত্র হিসেবে প্রথমে যাঁর অবদানের কথা স্বীকার করতে হয় তিনি পানিপট-সোনিপট ঘরানার প্রখ্যাত বাদক হায়দর বস। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে তাঁর জন্ম। তিনি সারেঙ্গীতে এমন কতগুলো রাজ প্রবর্তন করেন যার ফলে সারেঙ্গী উঁচু মানের একটি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।

এর পরবর্তী সময়ে যাঁর অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় তিনি হচ্ছেন বুন্দু খাঁ দিল্লী ঘরানার এই শিল্পীর জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে। তিনিও এর বাজ পরিশীলিত করার বিষয়ে গবেষনা করেন। তাঁর পরবর্তী সময়ের উল্লেখযোগ্য বাদক হচ্ছেন রাম নারায়ন, যিনি বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে একক বাদনের যন্ত্র হিসেবে সারেঙ্গীকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

প্রথম দিকে তাঁকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো, কিন্তু সব বাধার মুখে তিনি সহযোগী হিসেবে সারেঙ্গী না বাজিয়ে একক যন্ত্র হিসেবে সারেঙ্গী বাজানোর সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। ফলে উচ্চাঙ্গ সংগীতের জগতে একক যন্ত্র হিসেবে সারেঙ্গী মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরবর্তী কালে আরো অনেক বাদক তাঁর পথ অনুসরণ করে একক সারেঙ্গী বাদক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন, মম্মন খাঁ, আবদুল আজিজ খাঁ, আশিক হোসেন, আবদুল মজিদ খাঁ, বড়ে সাবির খাঁ, আহমেদী বা, গোপাল মিশ্র এবং সাম্প্রতিক সময়ে হনুমান প্রসাদ মিশ্র, সুলতান খাঁ, রমেশ মিশ্র প্রমূখ।

সারেঙ্গীর পরে একই গোত্রের অর্থাৎ ছড় দিয়ে বাজানোর আরেকটি যন্ত্র অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। যন্ত্রটি হচ্ছে এস্রাজ। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এই যন্ত্রের আবির্ভাব। সারেঙ্গীর মতই এই যন্ত্র ছড় দিয়ে বাজাতে হয়। বাঁ হাতের আঙুলের সাহায্যে তারে ঘর্ষন করে সুর উৎপন্ন করতে হয়, যদিও আঙুলের ব্যবহারে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।

তবে সারেঙ্গীর সাথে এস্রাজের মূল পার্থক্য হলো এই যে, এস্রাজের উপরের অংশ অনেকটা সেতারের মত এবং তাতে পর্দা বাঁধা রয়েছে। সারেঙ্গীতে কোন পর্দা নাই। এস্রাজের শব্দ মানুষের কন্ঠের খুব কাছাকাছি। সেজন্য কণ্ঠসংগীতের সহযোগী হিসেবে এটি স্বল্প সময়ে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে একক বাদনের যন্ত্র হিসেবেও এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

এস্রাজ যন্ত্রের একজন প্রখ্যাত বাদক ছিলেন বাংলাদেশের ভ্রাহ্মনবাড়িয়া জেলায় জন্ম গ্রহনকারী ওস্তাদ ফুলঝুরি বা। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রনে বিশ্বভারতীর যন্ত্র সংগীত বিভাগের প্রধাণ হিসেবে বেশ কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

সেতারের প্রচলন

উজবেকিস্তানের “দুভার” যন্ত্রে অতিরিক্ত আরেকটি তার সংযোজন করে এর নাম হয়েছিলো “সেহতার ” (সেহ অর্থ তিন)। পারস্য থেকে এই যন্ত্রের আগমন ঘটে উপমহাদেশের মাটিতে। পরবর্তীকালে এ দেশে প্রচলিত একাধিক প্রকারের বীণার সাথে মিলমিশ হওয়ার পর বিবর্তন ঘটে যেভাবে আধুনিক সেতারের উদ্ভব হয় তার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

এখানে সেতারের প্রচলন প্রসঙ্গে শুধু একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্তমান যুগের সেতারে উচ্চাঙ্গ সংগীতের সকল কারুকাজ ও কৌশল যেভাবে পরিবেশন করা যায় প্রাথমিক যুগের সেতারে তা সম্ভব ছিলো না। একক বাদনের উপযোগী হয়ে ওঠার পূর্বে নৃত্যের সহযোগী হিসেবে এই যন্ত্রটির বহুল প্রচলন ছিলো।

১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে একজন ইউরোপীয় শিল্পীর অঙ্কিত, বর্তমানে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত একটি চিত্রকর্মে বাঈজী নৃত্যের একটি দৃশ্যে সহযোগী যন্ত্র হিসেবে স্পষ্টত একটি ছোট আকারের সেতার দেখা যায়। সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিলো।

 

আধুনিক যুগের বাদ্যযন্ত্র

চিত্র – ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত চিত্রে নাচের সহযোগী যন্ত্র সেতার

তবে এই সময়ের মধ্যে দিল্লীর রাজ দরবারে একক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে সেতার প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে এমন তথ্যও ইতিহাসে পাওয়া যায়। ও আলাপ বাজানোর উপযোগী। দিল্লীর সেতার ছিলো তুলনামূলক ভাবে উন্নত মানের এবং গৎ তোড়া দিল্লীতে সেতারকে প্রচলিত করার পেছনে এবং সেতারের বিবর্তনে নিয়ামত খাঁ (সদারঙ্গ) এবং তাঁর বংশের অন্যান্য শিল্পীদের বিশেষ অবদান রয়েছে।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে আনুমানিক ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে নিয়ামত খাঁর জন্ম। তানসেন কন্যা স্বরস্বতী এবং জামাতা নৌবাত খাঁর বংশে নৌবাত খার জন্য। নিয়ামত খাঁ নিজে অবশ্য বীণ বাদক ছিলেন। তিনি ধ্রুপদও গাইতেন। এছাড়া খেয়াল রচনায় তাঁর অবদান রয়েছে। যন্ত্র সংগীতেও তাঁর অবদান রয়েছে। তিনি সেতারে তিন তারের পরিবর্তে সাতটি তার সংযোজন করেন।

চিকারীর তার সংযোজন তাঁরই অবদান। সেতার উদ্ভাবনে তাঁর ভাই আমীর খাঁ অথবা আমীর খসরুর অবদান রয়েছে। ভ্রাতষ্পুত্র ফিরোজ খান (অদারঙ্গ) শুধু অসাধারণ সেতারবাদক ছিলেন না, তাঁর হাতে ফিরোজখানি বাজ বিকাশ লাভ করে।  অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে দিল্লীতে ফিরোজ খানের পুত্র বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ মসিদ বা বীণার বাজের অনুকরণে মীড় এবং ঝালা বাজানোর কৌশল প্রবর্তন করেন।

ধ্রুপদ সংগীতের প্রভাবে তিনি সেতারে বাজানোর বিলম্বিত গৎ সৃষ্টি করেন যা মসিদখানি গৎ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। প্রথমদিকে নৃত্যের সহযোগী হিসেবে সেতারের প্রচলন থাকলেও ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সেতার একক উচ্চাঙ্গ বাদ্যযন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেতার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারের যন্ত্র হিসেবে রুদ্র বীণা সবচেয়ে সমাদৃত ছিলো।

বীণায় পরিবেশিত হতো ধ্রুপদী সংগীত। কিন্তু সেতারে উচ্চাঙ্গ সংগীতের যে ধারা পরিবেশনের প্রচলন হলো তা প্রকৃতপক্ষে খেয়ালের অনুরূপ। তবে সেতার এমন ধরনের একটি আধুনিক যন্ত্র যাতে ধ্রুপদ এবং খেয়াল থেকে শুরু করে লঘু উচ্চাঙ্গ, এমনকি লঘু সংগীত পর্যন্ত সব ধরনের সংগীত পরিবেশন করা যায়। আধুনিক যুগে তাই সেতার সবচেয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

সেতার বাদনে যাঁরা প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন তাঁদের কয়েকজনের নাম হলো নিয়ামত খাঁ, ফিরোজ খাঁ, মসিদ বা এবং সাম্প্রতিক সময়ে পণ্ডিত রবি শব্দর, ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ (প্রয়াত), ওস্তাদ ইমরাত খাঁ, ওস্তাদ শাহেদ পারভেজ, ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান (প্রয়াত), ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান (প্রয়াত), ওস্তাদ মীর কাসেম খান (প্রয়াত), ওস্তাদ খুরশিদ খান প্রমূখ।

সরোদের প্রচলন

পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্ব থেকেই উপমহাদেশে রবাবের প্রচলন চলে আসছে। তবে ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে এটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। রুদ্র বীণা এবং রবাব – এ দু’টি ছিলো সে সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র।

ধ্রুপদী সংগীত পরিবেশনে এ দু’টি যন্ত্র ছিলো অনন্য। বিঞা তানসেনের পুত্র এবং কন্যার বংশধরগন এই দু’টি যন্ত্রে বংশ পরম্পরায় ধ্রুপদী সংগীতের চর্চা করে এক অভূতপূর্ব ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। ক্রমে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে সুরসৃঙ্গার এবং সুরবাহার যন্ত্র দু’টির আবির্ভাবে রবার এবং রুদ্র বীণার চর্চায় কিছুটা ভাটা পড়ে।

আরো পরে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রথমে সেতার এবং পরে সরোদের আগমনের পর পূর্বের প্রায় সব যন্ত্রই ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। রুদ্র বীণার স্থান দখল করে নেয় সেতার এবং রবাবের স্থান দখল করে নেয় সরোদ। তানসেনের বংশধরেরা ধ্রুপদী বা হিন্দুস্তানী রবাবের চর্চা করতেন। সম্রাট আকবরের দরবারে মিঞা তানসেন ছাড়াও একজন বিখ্যাত রবাব বাদক ছিলেন, যাঁর নাম কাসিম কোহবার।

সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ্ রঙ্গিলের আমলে কয়েকজন বিখ্যাত রবার বাদক খ্যাতির শিখরে আরোহন করেছিলেন। তাঁরা হলেন, হাসান খাঁ, ছজ্জু খাঁ এবং তাঁর তিন পুত্র প্যার খাঁ, বাসত খাঁ ও জাফর খাঁ। শেষোক্ত তিনজন ছিলেন মোগল দরবারে সর্বশেষ সেনিয়া ঘরানার শিল্পী। তবে তানসেনের আরো পরবর্তী প্রজন্মের বংশধরদের মধ্যে অত্যন্ত খ্যাতিমান ছিলেন ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ, যিনি রামপুরের মহারাজার সভা সংগীতজ্ঞ ছিলেন।

সেনিয়া শিল্পীরা নিজ বংশের বাইরে কাউকে রবাব শিক্ষা দিতেন না। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন একটি যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এ সময়ে ক্রমে আফগানী রবাবের আগমনে এবং প্রভাবে সরোদ যন্ত্রের সৃষ্টি হয় যা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। রবাব থেকে সরোদের এই পালাবদল ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। সে সময়কার তিনজন বিখ্যাত সরোদ বাদক ছিলেন নিয়ামতউল্লাহ খাঁ, হাফিজ আলী খাঁ এবং আবিদ আলী খাঁ।

 

আধুনিক যুগের বাদ্যযন্ত্র

 

সরোদ আবিস্কারে তিনজনই কৃতিত্ব দাবী করে থাকেন। তবে যাঁর হাতেই সরোদ সর্বপ্রথম রূপ লাভ করুক না কেন, এর সর্বশেষ পরিমার্জনা এবং আধুনিক রূপায়ন ঘটে বাংলাদেশের দু’জন শ্রেষ্ঠ সংগীত গুণী ওস্তাদ আলাউদ্দিন বা এবং ওস্তাদ আয়েত আলী বার হাতে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তাঁর উদ্ভাবিত আধুনিক সরোদকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তোলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর সুযোগ্য পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ এই যন্ত্রটিকে বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন করেন।

ওস্তাদ আয়েত আলী বার সুযোগ্য পুত্র ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আরেকজন উঁচুদরের সরোদশিল্পী। অপরদিকে হাফিজ আলী খাঁর পরিবারেও বংশ পরম্পরায় সরোদের চর্চা অব্যাহত রয়েছে। হাফিজ আলী খার পুত্র ওস্তাদ আমজাদ আলী বা ভারতের অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন সরোদ বাদক ।

আরও দেখুন :

Leave a Comment