আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় কাজী নজরুল ইসলামের স্বদেশচেতনার গান। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে উঠে মানবমঙ্গলের গান গেয়েছেন। চেয়েছেন নিপীড়িত মানুষের প্রগতি। পিছিয়ে পড়া মানুষকে জাগাতে চেয়েছেন। চেয়েছেন ইংরেজ শাসকদের হটিয়ে, উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার পতাকা তলে সমবেত করতে।
কাজী নজরুল ইসলামের স্বদেশচেতনার গান
কাজী নজরুল ইসলামের স্বদেশচেতনার গান
কাজী নজরুল ইসলামের দেশাত্মবোধক গানের তালিকা
১ . অগ্নি-ঋষি! অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে
তাই ত তোমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে
দহন বনের গহন-চারী-
হায় ঋষি—কোন বংশীধারী দেশি
নিংড়ে আগুন আনলে বারি, অগ্নি-মরুর মাঝে।
সর্বনাশা কোন বাঁশি সে বুঝতে পারি না যে ॥
দুর্বাসা হে! রুদ্র তড়িৎ হানছিলে বৈশাখে,
হঠাৎ সে কার শুনলে বেণু কদম্বের ঐ শাখে।
বজ্রে তোমার বাজল বাঁশি,
বহ্নি হল কান্না-হাসি,
সুরের ব্যথায় প্রাণ উদাসী মন সরে না কাজে।
তোমার নয়ন-ঝুরা অগ্নি-সুরেও রক্তশিখা রাজে
২ . ‘বাঙলায় মহাত্মা’
আজ না-চাওয়া পথ দিয়ে কে এলে ঐ কংস কারার দ্বার ঠেলে।
আজ শব শ্মশানে শিব নাচে
ঐ ফুল ফুটানো পা ফেলে আজ প্রেম দ্বারকায় ডেকেছে বান,
মরুভূমে জাগল তুফান,
দিগ্বিদিকে উপচে পড়ে প্রাণ রে !
তুমি জীবন-দুলাল সব লালে লাল করলে প্রাণের রং ঢেলে ।
শ্রাবন্তি ঢল আসল নেমে,
আজ ভারতের জেরুজালেমে মুক্তি পাগল এই প্রেমিকের প্রেমে রে
ওরে আজ নদীয়ার শ্যাম নিকুঞ্জে রক্ষ হরি রাম খেলে ॥
ঐ চরকা চাকায় ঘর্ঘর ঘর
শুনি কাহার আসার খবর,
ঢেউ-দোলাতে দোলে সপ্ত সাগর রে!
পথের ধূলা ডেকেছে আজ সপ্ত কোটি প্রাণ মেলে
আজ জাত-বিজাতের বিভেদ ঘুচি, এক হল ভাই বামুন- মুচি
প্রেম-গঙ্গায় সবাই হল শুচি রে!
আয় এই যমুনায় ঝাঁপ দিবি কে বন্দেমাতরম্ বলে –
ওরে সব আগুন জ্বেলে
৩ . “সূর্য-নিনাদ
কোরাস্ (আজ) ভারত ভাগ্য-1 J-বিধাতার বুকে গুরু-লাঞ্ছনা-
পাষাণ-ভার,
আর্ত-নিনাদে হাঁকিছে নকীব, কে করে মুশকিল আসান তার?
সন্ধি-মহলে ফন্দীর ফাঁদ, গভীর আন্ধি-অন্ধকার!
হাঁকিছে নকীব, হে মহারুদ্র, চূর্ণ কর এ ভণ্ডাগার
রক্ত-মদের বিষপান করি
আর্তমানব; স্রষ্টা কাতর সৃষ্টির তাঁর নির্বাণ স্মরি’!
এদন-ঘন বিশ্বে স্বনিছে প্রলয় ঘটার হুহুঙ্কার,
হাঁকিছে নকীব, অভয়-দেবতা, এ মহাপাথার করহ পার ।
কোলাহল ঘাঁটা হলাহল-রাশি
কে নীলকণ্ঠ গ্রাসিবে রে আজ দেবতার মাঝে দেবতা সে আসি?
উরিবে কখন ইন্দিরা, ক্রোড়ে শান্তির ঝারি সুধার ভাঁড়?
হাঁকিছে নকীব, আন ব্যথা-ক্লেশ-মন্থন-ধন অমৃত-ধার ॥
কন্ঠ-ক্লিষ্ট এদন-ঘাতে অমৃত-অধিপ নর-
নারায়ণ দারুময় ঘন মনো-বেদনাতে।
দশভুজে গলে শৃঙ্খল-ভার দশপ্রহরণ ধারিণী মা’র-
হাঁকিছে নকীব, ‘আবিরাধির্ম এধি’ হে নব যুগাবতার!
মৃত্যু আহত মৃত্যুঞ্জয়
কে শোনাবে তাঁরে চেতন-মন্ত্র? কে গাহিবে জয় জীবনের জয়?
নয়নের নীরে কে ডুবাবে বল বল-দর্শীর অহঙ্কার? –
হাঁকিছে নকীব, – সেদিন বিশ্বে খুলিবে আরেক তোরণ দ্বার
৪ . ওরে আজ ভারতের নব যাত্রা পথের
বাঁশি বাজলো, বাজলো বাঁশি
ফেলে তরুর ছায়া ভুলে ঘরের মায়া
এলো তরুণ পথিক ছুটে রাশি রাশি ।
তারা আকাশকে আজ চাহে লুটে নিতে
তারা মন্থর ধরায় চাহে দুলিয়ে দিতে
তারা তরুণ তরুণ প্রাণ জাগায় মৃতে
সাহস জাগায় চিতে তাদের অট্টহাসি ॥
মোরা প্রাচীরের পরে রে প্রাচীর তুলে
ভাই হয়ে ভাইকে হায় ছিলাম ভুলে।
আজ ভেঙে প্রাচীর হল ঘরের বাহির
একই অঙ্গনে দাঁড়ালো উন্নত শির।
এলো মুক্ত গগন তলে প্রাণ পিয়াসি
এলো তরুণ পথিক ছুটে রাশি রাশি ।
৫ . আজ ভারতের নব আগমনী জাগিয়া উঠেছে মহাশ্মশান
জাগরণী গায় প্রভাতের পাখি ফুলে ফুলে হাসে গোরস্থান ॥
ট’লেছে অটল হিমালয় আজি
সাগরে শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
হলাহল শেষে উঠেছে অমৃত বাচাইতে মৃত মানব-প্রাণ
আঁধারে ক’রেছে হানাহানি যারা
আলোকে চিনেছে আত্মীয় তা’রা
এক হয়ে গেছে ভারতের নব খ্রিস্টান, শিখ, হিন্দু, পারসি, মুসলমান।
এই তাপসীর চরণের তলে
লভিয়াছে জ্ঞান শিক্ষা সকলে
আবার আসিবে তারা দলে দলে করিতে পুণ্য তীর্থ-স্নান
৬ . আজি শৃঙ্খলে বাজিছে মাভৈঃ- বরাভয়,
এ যে আনন্দ-বন্ধন এদন নয় ॥
শুরে নাশিতে সবার এই বন্ধন-ত্রাস,
মোরা শৃঙ্খলে ধরি তারে করি উপহাস,
সহি নিপীড়ন-পীড়নের আয়ু করি হ্রাস,
এ যে রুদ্র-আশীর্বাদ– লৌহ-বলয় ॥
মোরা অগ্র-পথিক অনাগত দেবতার,
এই শৃঙ্খলে ভারতের নব বন্দিছে চরণ তাঁহার।
শোন, শৃঙ্খলে তাঁর আগমনী-ঝঙ্কার!
হবে দৈত্য কারায় নব অরুণ উদয়
৭ . আমি মহাভারতী শক্তিনারী।
আমি কৃশ-তনু-অসিলতা,
স্বাহা আমি তেজ তরবারি আমি আশা-দীপ,
জ্যোতি, আমি কল্যাণ, সাম্য, প্রেম, সংহতি।
আমি ভবনে করুণা-কোমল আমি ভুবনের সর্ব দ্বন্দ্ব সংহারি’
আমি শান্ত উদাসীন মেঘে আনি বর্ষণ-বেগ,
আমি তড়িৎলতা, পরাজিত পৌরুষে
জাগায়ে তুলি দূর করি নিরাশা দুর্বলতা।
আমি গার্গী, মৈত্রেয়ী ভারতের নব, ভাগবতী শক্তি,
আমি নবারুণ আলোক আনিব বিশ্বে তিমির বিদারি
৮ . আয় রণজয়ী পাহাড়ি দল শক্তি- মাতাল বুনো
পাগল থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ নেচে আয় রে দৃপ্ত পায় ।
গিরি দরি বন ভাসায় যেমন পার্বতীয়া কাজল!
আন তীর ধনু বর্শা হান্ বাজা রে শিঙ্গা বাজা মাদল
৯ . আসে রে ঐ আসে ভারত-আকাশে আশা অরুণ রবি।
মৃত জনগণে বাঁচাতে এলো যেন নূতন প্রাণ-জাহ্নবী |
তন্দ্রা-মগন জাগিছে জনগণ নব আশার মোহে,
গলি পাষাণ-গিরি প্রাণ-নিঝর বহে শোভিল ফুলে ফলে শুষ্ক অটবী ॥
নূতন দিনের পাখিরা ছুটে আসে শত রঙের খেলা মুক্ত আকাশে,
ছুটলি দিকে দিকে জয় ভারত গাহি শত চারণ কবি
১০ . উদার ভারত। সকল মানবে দিয়াছ তোমার কোলে স্থান।
পার্সি-জৈন-বৌদ্ধ-হিন্দু খ্রিস্টান-শিখ-মুসলমান ॥
তুমি পারাবার, তোমাতে আসিয়া মিলেছে
সকল ধর্ম জাতি আপনি সহিয়া ত্যাগের বেদনা সকল দেশের করেছ জাতি;
নিজেরে নিঃস্ব করিয়া, হয়েছ বিশ্ব মানব- পীঠ |
নিজ সন্তানে রাখি নিরন্ন, ভারতের নব অন্য সবারে অন্ন দাও,
তোমার স্বর্ণ রৌপ্য মানিকে বিশ্বের ভাণ্ডার ভরাও
আপনি মগ্ন ঘন তমসায় ভুবনে করিয়া আলোক দান
বক্ষে ধরিয়া কত সে যুগের কত বিজেতার গ্লানির স্মৃতি
প্রভাত আশায় সর্বসহা মা যাপিছ দুখের কৃষ্ণাতিথি,
এমনি নিশীথে এসেছিলে বুকে আসিবে আবার সে ভগবান ॥
১১ . এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী ।
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনি
রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল,
আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল।
ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল ল’য়ে অশনি
কেতকী-কদম-যূথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথ
মালিকা পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেল চঞ্চলা বালিকা।
তড়াগে পুকুরে থই থই করে শ্যামল শোভার নবনী ॥
শাপলা শালুক সাজাইয়া সাজি শরতে শিশির নাহিয়া,
শিউলি-ছোপানো শাড়ি পরে ফের আগামনী-গীত গাহিয়া।
অঘ্রাণে মা গো আমন ধানের সুঘ্রাণে ভরে অবনি
শীতের শূন্য মাঠে তুমি ফের উদাসী বাউল সাথে মা,
ভাটিয়ালি গাও মাঝিদের সাথে গো, কীর্তন শোনো রাতে মা।
ফাল্গুনে রাঙা ফুলের আবিরে রাঙাও নিখিল ধরণী
১২ . এ দুর্দিন রবে না তোর আসবে শুভদিন।
নতুন আশায় বুক বাঁধ রে অন্ন-বা-হীন রাত পোহাবে,
এই আঁধারে রইবি না তুই ডুবে আশার সূর্য উঠবে আবার পুবে,
তুই সাহস ক’রে উঠে দাঁড়া,
হবে দুঃখের আয়ুক্ষীণ ধর্ম জাগেন মাথার উপর,
অসীম আকাশ তলে, আজো তাহার চাঁদ-সুরযের রুদ্র আঁখি জ্বলে।
এই সুখে রাখা দুঃখ দেওয়া যাঁহার হাতের খেলা
তুই ধর দেখি রে তাহার চরণ-ভেলা,
তুই দেখবি সেদিন রইবি ভারতের নব না আর এমন পরাধীন
১৩ . এই আমাদের বাংলাদেশ এই আমাদের বাংলাদেশ
যে দিকে চাই স্নিগ্ধ শ্যামল চোখ জুড়ানো রূপ অশেষ ॥
চন্দনিত শীতল বাতাস বয় এ দেশে নিরন্তর
জোছনা সম কোমল হয়ে আসে হেথায় রবির কর
জীবন হেথায় স্নেহ সরস সরল হৃদয় সহজ বেশ
নিত্য হেথা ঝরছে মেঘে স্বর্গ হতে শান্তি জল মাঠে
ঘাটে লক্ষ্মী হেথায় ছড়িয়ে রাখে ফুল কমল।
হাঙ্গোর কুমির শার্দুল সাপ ভারতের নব খেলার সাথি এই জাতির
দিল্লীর যশ করল হরণ এই দেশেরি প্রতাপ বীর একদা
এই দেশের ছেলে জয় করেছে দেশ বিদেশ
১৪ . এই দেশ কার? তোর নহে আর রে মৃঢ় সন্তান
ভারতমাতার
দেবতার দেশে আজ দৈত্য করে বিরাজ,
মন্দির আজি বন্দীর কারাগার লাজ নাহি তার,
যার জননী দাসী দাসের শিকল প’রে (কেমনে নিলাজ) বেড়াস্ হাসি ?
অসম্মানের প্রাণ ক’রে দে রে অবসান,
মানুষের মত ম’রে বাঁচ রে আবার
১৫ . এই ভারতে নাই যাহা তা ভূ-ভারতে নাই।
মানুষ যাহা চায় স্বর্গে গিয়ে, আমরা হেথায় পাই
মেঘমুক্ত এমন আকাশ চন্দনিত এমন বাতাস,
ফুল-ফসলের ছড়াছড়ি কোথায় এত পাই ॥
জল চাইলেই হাতের কাছে ছুটে আসে নদী,
মাটিতে পাই খাঁটি সোনার একটু কাটি যদি ।
গিরি-দরি-সাগর-মরু পশু-পাখি-লতা-তরু,
বিশ্বের সব দৃশ্য দেখি যখন যাহা চাই ॥
পাঁচভূতে খায় লুটে রে ভাই আমার দেশের দান (তবু)
কম হ’ল না কভু ইহার বিভব অফুরান।
মানুষ যদি নাই এ দেশে নইলে কি ভাই এ দীন বেশে,
কেঁদে বেড়ায় দেশ-জননী অঙ্গে মেখে ছাই—
মোরা অবহেলে এই অফুরান বিভব যে হারাই ॥
১৬ . এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল ।
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল ॥
তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয় ওরে
ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাধন জয়।
এই বাধন প’রেই বাঁধন-ভয়কে করব মোরা জয়
এই শিকল বাঁধা পা নয় এ শিকল ভাঙা কল
তোমার বন্ধ ঘরের বন্ধনীতে করছ বিশ্ব গ্রাস,
আর ভয় দেখিয়েই ক’রবে ভাবছ বিধির শক্তি হ্রাস
সেই ভয়-দেখানো ভূতের মোরা ক’রবো সর্বনাশ,
এবার আনবো মাভৈঃ বিজয়-মন্ত্র বল-হীনের বল
তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন জয় দেখিয়ে নয়
সেই ভয়ের টুটি ধরব টিপে করব তারে লয়।
মোরা আপনি মরে মরার দেশে আনব বরাভয়,
পরে ফাঁসি আর হাসি মৃত্যু-জয়ের ফল ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন এই শিকল-বঞ্চনা,
এ যে মুক্তি-পথের অগ্রদূতের চরণ-বন্দনা !
এই লাঞ্ছিতেরাই অত্যাচারকে হাছে লাঞ্ছনা,
মোদের অশ্রু দিয়েই জ্বলবে দেশে আবার বজ্রানল
১৭ . এসো মা ভারত-জননী আবার জগৎ-তারিণী সাজে।
রাজরানী মা’র ভিখারিনী বেশ দেখে প্রাণে বড় বাজে
শিশু জগতেরে মায়ের মতন, তুমি মা প্রথম করিলে পালন,
আজ মাগো তোরই সন্তানগণ কাঁদিছে দৈন্য-লাজে
আঁধার বিশ্বে তুমি কল্যাণী জ্বালিলে প্রথম জ্ঞান-দীপ আনি;
হইলে বিশ্ব-নন্দিতা রানী নিখিল নর-সমাজে
দেখা মা পুন সে অতীত মহিমা, মুছেদে ভীরুতা গ্লানির কালিমা
রাঙায়ে আবার দশদিক-সীমা দাঁড়া মা বিশ্ব মাঝে
১৮ . “বিজয় গান”
ঐ অভ্রভেদী তোমার ধ্বজা উড়লে আকাশ পথে।
মাগো তোমার রথ আনা ঐ রক্ত-সেনার রথে
ললাট-ভরা জয়ের টীকা অঙ্গে নাচে অগ্নি-শিখা,
রক্তে জ্বলে বহ্নি-লিখা, মা। ঐ বাজে তোর বিজয়-ভেরি,
নাই দেরি আর নাই মা দেরি, মুক্ত
তোমার হতে আনো তোমার বরণ ডালা,
আনো তোমার শঙ্খ, ঐ দ্বারে মা’র মুক্তি সেনা,
বিজয়-বাজা উঠছে তারি। ওরে ভীরু। ওরে মরা।
মরার ভয়ে যাসনি তোরা: তোদেরও আজ ডাকছি মোরা-ভাই!
ঐ খোলে রে মুক্তি-তোরণ, আজ একাকার জীবন-মরণ মুক্ত এ ভারতে ॥
১৯ . ‘রক্ত-পতাকার গান
ওড়াও ওড়াও লাল নিশান।
দুলাও মোদের রক্ত-পতাকা ভরিয়া বাতাস, জুড়ি বিমান
শীতল শ্বাসেরে বিদ্রূপ করি’ ফোটে কুসুম
নব-বসন্ত-সূর্য উঠিছে টুটিয়া ঘুম,
অতীতের ঐ দশ সহস্র বছরের হান মৃত্যু বাণ ॥
চির-বসন্ত যৌবন করে ধরা শাসন।
নহে পুরাতন দাসত্বের ঐ বন্ধ মন,
ওড়াও তবে রে লাল নিশান
ভরিয়া বাতাস, জুড়ি’ বিমান।
বসন্তের এই জ্যোতির পতাকা ওড়াও ঊর্ধ্বে,
গাহ রে গান। লাল নিশান। লাল নিশান
২০ . কারা পাষাণ ভেদি’ জাগো নারায়ণ।
কাঁদিছে বেদীতলে আর্ত জনগণ,
বন্ধ-ছেদন জাগো নারায়ণ হত্যা-ৰূপে আজি
শিশুর বলিদান অমৃত-পুত্রেরা মৃত্যু- ম্রিয়মাণ।
শোণিত-লেখা জাগে—নাহি কি ভগবান?
মৃত্যুক্ষুধা জাগে শিয়রে লেলিহান!
শঙ্কা-নাশন জাগো নারায়ণ
২১ . কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী। ওরে ও তরুণ ঈশান।
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ ! ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদী ।।
গাজনের বাজনা বাজা! কে মালিক? কে সে রাজা? কে দেয় সাজা,
মুক্ত স্বাধীন সত্য কে রে? হা হা হা পায় যে হাসি,
ভগবান পড়বে ফাঁসি? সর্বনাশী শিখায় এ হীন তথ্য কে রে?
ওরে ও পাগলা ভোলা! দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা জোরসে ধরে হেঁচকা টানে।
মার হাঁক হৈদরী হাঁক, কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক ডাক
ওরে ডাক মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!
নাচে ঐ কাল-বোশেখী, কাটাবি কাল বসে কি?
দে রে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি।
লাথি মার ভাঙরে তালা যত সব বন্দিশালায় আগুন জ্বালা,
আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।
২২ . কালের শঙ্খে বাজিছে আজও তোমারই মহিমা ভারতবর্ষ।
প্রণতি জানায়ে বিশ্বভুবন শিখিছে আজিও তব
আদর্শ নিখিল মানবের প্রথমা ধাত্রী, শিক্ষা সভ্যতা দীক্ষাদাত্রী !
আসিল যুগে যুগে দেবতা মুনি ঋষি লভিতে
তোমারি চরণস্পর্শ শিল্প সঙ্গীত বেদ বিজ্ঞান সাংখ্য দর্শন পুণ্য প্রেমধ্যান।
যাহা কিছু সুন্দর যাহা কিছু মহীয়ান বিশ্ব সাক্ষী মাগো সকলি তোমার দান।
জগৎসভা মাঝে তাহারি সন্ধান আজি, মলিন মুখ লাজে বিমর্ষ
২৩ . গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ওই,
বহিয়া চলেছে আগের মতন কইরে আগের মানুষ কই ।
মৌন স্তব্ধ সে হিমালয়, তেমনি অটল মহিমময়,
নাই তার সাথে সেই ধ্যানী ঋষি, আমরাও আর সে জাতি নই।
আছে সে আকাশ-ইন্দ্ৰ নাই, কৈলাসে সে গোগীন্দ্র নাই,
অন্নদা-সূত ভিক্ষা চাই, কি কহিব এরে কপাল বই
সেই আগ্রা, সে দিল্লী ভাই, পড়ে আছে সেই বাদশা নাই,
নাই কোহিনূর ময়ূর-তপ্ত নাই সে বাহিনী বিশ্বজয়ী।
আমরা জানি না, জানে না কেউ, কূলে বসে কত গনিব ঢেউ,
দেখিয়াছি কত দেখিব এ-ও নিঠুর বিধির লীলা কতই।
২৪ . চল্ রে চপল তরুণ দল বাঁধন হারা চল্ অমর সমরে,
চল ভাঙি’ কারা জাগায়ে কাননে নব পথের ইশারা
প্রাণ-স্রোতের ত্রিধারা বহায়ে তোরা ওরে চল।
জোয়ার আনি, মরা নদীতে পাহাড় টলায়ে
মাতোয়ারা ডাকে তোরে স্নেহভরে ওরে ফিরে
আয় ফিরে ঘরে তারে ভোল ওরে ভোল তোরা
যে ঘর-ছাড়া তাজা প্রাণের মঞ্জরি ফুটায়ে পথে তোরা চল,
রহে কে ভুলে ছেঁড়া পুঁথিতে তাদের পরানে দে রে সাড়া।
রণ মাদল আকাশে ঘন বাজে গুরু গুরু ।
আঁধার ঘরে কে আছে প’ড়ে তাহার দুয়ারে দে রে নাড়া
২৫ . চাঁদের কন্যা চাঁদ সুলতানা, চাঁদের চেয়েও জ্যোতি।
তুমি দেখাইলে মহিমান্বিতা নারী কী শক্তিমতী ॥
শিখালে কাঁকন চুড়ি পরিয়াও নারী,
ধরিতে পারে যে উদ্ধৃত তরবারি,
না রহিত অবরোধের দুর্গ, ভারতের নব হতো না এ দুর্গতি ॥
তুমি দেখালে নারীর শক্তি স্বরূপ চিন্ময়ী কল্যাণী,
ভারত জয়ীর দর্প নাশিয়া মুছালে নারীর গ্লানি।
তুমি গোলকুণ্ডার কোহিনূর হীরা সম আজো ইতিহাসে জ্বলিতেছে নিরূপম,
রণরঙ্গিণী ফিরে এসো, তুমি ফিরিয়া আসিলে, ফিরিয়া আসিবে লক্ষ্মী ও সরস্বতী
২৬ . জগতে আজিকে যারা আগে চলে ভয়-হারা
ডেকে যায় আজি তারা, চল রে সুমুখে চল।
পিছু পানে চেয়ে’ মিছে প’ড়ে আছি সব নীচে,
চাসনে রে তোরা ভারতের নব পিছে অগ্র-পথিক দল
চলার বেগে উঠবে জেগে বনে নূতন পথ
বর্তমানের পানে মোদের চলবে অরুণ-রথ
অতীত আজি পতিত রে ভাই, রব ভবিষ্যৎ।
স্বর্গ মোৱা আনব, না হয় যাব রসাতল ।
রইব না পিছে প’ড়ে অতীতের কঙ্কাল ধরে,
বইবে নব জীবন-স্রোত যৌবন-চঞ্চল।
বিশ্ব সভাঙ্গনে সকল জাতির সনে বসিব সম-আসনে গৌরব-উজ্জ্বল ॥
২৭ . জননী! জননী! আবার জাগো শুভ্র শারদ প্রাতে।
আঁখি তোল অনসিত অনাহত মহিমাতে।
আকশে তরুণোদয় স্বপ্ন কুহেলিময়,
তরুণ উষার জয় জয় কনক কিরীট মাথে ॥
পত্রে পুষ্পে গন্ধে বনানী মুখরিত শিশিরসিক্ত তৃণে অঞ্চল আদুলিত।
বন্দিনী মোর মা গো ক্রন্দন রাখি জাগো, নব চেতনার ছন্দে,
২৮ . জননী মোর জন্মভূমি, তোমার পায়ে নোয়াই মাথা।
স্বর্গাদিপি গরীয়সী স্বদেশ আমার ভারত মাতা ॥
তোমার স্নেহ যায় ব’য়ে মা শত ধারায়
নদীর স্রোতে ঘরে ঘরে সোনার ফসল ছড়িয়ে পড়ে আঁচল হ’তে,
স্নিগ্ধ-ছায়া মাটির বুকে তোমার শীতল পাটী
পাতা স্বর্গের ঐশ্বর্য লুটায় তোমার ধূলি-মাখা
পথে তোমার ঘরে নাই যাহা মা,
নাইক তাহা ভূ-ভারতে ঊর্ধ্বে আকাশ
নিয়ে সাগর গাহে তোমার বিজয়-গাথা।
আদি জগদ্ধাত্রী তুমি জগতেরে প্রথম প্রাতে
শিক্ষা দিলে দীক্ষা দিলে, করলে মানুষ আপন হাতে,
তোমার কোলের লোভে মা গো রূপ ধরে আসেন বিধাতা
ছেলের মুখের অন্ন কেড়ে খাওয়ালি মা যাদের ডেকে
তারাই দিল তোর ললাটে চির-দাসীর তিলক এঁকে,
দেখে শুনে হয় যা মনে নেইক বিচার নেই বিধাতা ।
২৯ . ‘ভারতী আরতি’
জয় ভারতী শ্বেত শতদলবাসিনী,
বিষ্ণু শরণ-চরণ আদি বাণী ।
কণ্ঠ- লীনা বাজিছে বীণা,
বিশ্ব ঘুরে গাহে সে সুরে জয় জয় বীণাপাণি ।
শুনি সে-সুর অন্ধ নভে উদিল গ্রহ তারকা সবে,
মাতিল আলো-মহোৎসবে মা, বিশ্বরানী ॥
আদি সৃজন-দিনে অন্ধ ভুবনে,
তোমার জ্যোতি আলো দিল মা নয়নে।
জ্ঞান-প্রদায়িনী হৃদয়ে আলো দিলে,
ধেয়ান-সুন্দর করিলে সব নিখিলে,
উর মা উর আঁধার-পুরে আলো দানি
৩০ . জয় হে জনগণ-অধিপতি জয়।
হে দেবপূজ্য-নিঃশঙ্ক নিৰ্ভয় প্রতাপে
ভাম্বর তুমি আদিত্য হে মৃত্যু তোমার চরণে ভৃত্য হে,
সিংহাসন তব ব্যথিত চিত্ত
হে হে রাজ সন্ন্যাসী চির-অসংশয় ॥
সিংহ- বিক্রম শত্রুজিৎ শূর চক্রপথে
তব ঊষর বন্ধুর দুর্দিনে এই দুর্গশিরে ভূমি-
আশার কেতন-মন্ত্র অভয় জয় হে ॥
৩১ . জয় হোক জয় হোক শান্তির জয় হোক,
সাম্যের জয় হোক, সত্যের জয় হোক, জয় হোক ॥
সর্ব অকল্যাণ পীড়ন অশান্তি সর্ব অপৌরুষ মিথ্যা ও ভ্রান্তি,
হোক ক্ষয় ক্ষয় হোক জয় হোক জয় হোক
দূর হোক অভাব ব্যাধি শোক দুখ দৈন্য গ্লানি বিদ্বেষ অহেতুক,
মৃত্যুবিজয়ী হোক অমৃত লভুক-ভয়-ভীত দুর্বল নিৰ্ভয় হোক।
রবে না এ শৃঙ্খল উচ্ছৃঙ্খলতার বন্ধন কারাগার হবে হবে চুরমার,
পার হবে বাধার গিরি মরু পারাবার- নির্যাতিত ধরা মধুর,
সুন্দর প্রেমময় হোক, জয় হোক জয় হোক
আরও দেখুন :