আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় নৃত্যনাট্য উদ্ভবের প্রাচীন কথা
নৃত্যনাট্য উদ্ভবের প্রাচীন কথা
নৃত্যনাট্য উদ্ভবের প্রাচীন কথা
বিশ্বজগতের মধ্যে নিরন্তর গতির চাঞ্চল্য ও আবেগ আত্মপ্রকাশ করে নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র ছন্দে। প্রকৃতি তার বৃক্ষ-ফুল-ফলের সৃষ্টি ও পরিনতিতে ষড়ঋতুর আবর্তনে, এই গতিছন্দকে রূপায়িত করে প্রতি মুহুর্তে নানাভাবে। বিশ্বের এই গতিছন্দই প্রানিজগতে নৃত্যের মূল প্রেরণা। ভাষাহীন পশু এই ছন্দকেই অজ্ঞাতসারে অনুকরণ করে তার নানা ভঙ্গির লাফ-ঝাঁপ- দৌড়, পাখি তর বিচিত্র লেজ দোলানো নাচে নব নব ভঙ্গিতে আকাশে উড়বার চেষ্টায়।
মানুষও যে গতিভঙ্গি দেখেছে পশুপাখীর দেহ বিক্ষেপের মধ্যে যে ছন্দ দেখেছে সৃষ্টির অগ্রগতির মধ্যে তারই অনুকরণ করে প্রথম নৃত্যের চেষ্টা করা হয়েছে। এই গতির দোলার মধ্য দিয়েই সে তার আনন্দ-বেদনা, বিরাগ-অনুরাগকে প্রকাশ করবার পথ খুজেঁ । সাহিত্য সৃষ্টির পূর্বে নৃত্যই ছিল তার ভাব প্রকাশের বাহন। নৃত্যই তার আত্মপ্রকাশের, তার শিল্পপ্রেরণার প্রথম স্তর।
তারপর যুগে যুগে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে নৃত্য-উদ্ভব হয়েছে নতুন নতুন আঙ্গিকের তার ব্যবহার হয়েছে বিভিন্ন সমানের বিভিন্ন উদ্দেশ্যে। বাস্তবিক কোথাও সামাজিক অনুষ্ঠানের কর্তব্য হিসেবে, কোথাও ধর্মসাধনার অঙ্গরূপে, কোথাও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আনন্দ ও দুঃখ প্রকাশের বাহন হিসেবে নৃত্য জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে যায় ।
বহু প্রাচীন কাল থেকে নৃত্যকলা ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ধর্মের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে। দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং নৃত্য করতেন বলে উল্লেখ আছে। দেবসভায় ঊর্বশী, মেনকা, রম্ভা, ঘৃতাচি প্রভৃতি অপ্সরারা বিখ্যাত নর্তকী বলে খ্যাতি সম্পন্না ছিলেন। কাব্য-পুরানাদিতে তাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। বৌদ্ধ মূর্তি শিল্পে অনেক নৃত্যপরা দেবীর মূর্তি পাওয়া যায়। দেবর্ষি নারদ স্বর্গে বীণা বাজিয়ে নৃত্য করতেন।
মহাদেবের নৃত্য পরিকল্পনা ভারতীয় কাব্য ও শিল্প প্রতিভার চরম দান। মহাদেবই নৃত্যাভিনয়ের আদিগুরু বলে কল্পিত, তই তাঁর নাম নটরাজ। নটরাজ মহদেবের নৃত্যপর মূর্তি দাক্ষিণাত্যের প্রায় প্রত্যেক মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত।
বিশ্বের অণু-পরমাণু হতে আরম্ভ করে জড়জগৎ ও প্রানিজগতের মধ্যে আত্মসংরক্ষণ ও বিলয়ের একটা প্রবল ঝড় অনুক্ষণ ধ্বংস হতে সৃষ্টিতে বিরামহীন সঞ্চরণ করছে। বিশ্বের মধ্যে চলছে বিরামহীন পরিবর্তন, বিশ্বসৃষ্টির এই ক্রমাগত পরিবর্তনের উদ্ভব হয়েছে নটরাজের নৃত্যেরই ফলে। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জুড়ে এই তান্ডব নৃত্য চলছে। সৃষ্টির গতিশীল বৈচিত্র্যই তার নৃত্যের রূপ ।
রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি ও ধ্বংসকে শিব তান্ডব নৃত্যের অঙ্গরূপে দেখেছিলেন- আদিদেবের আহ্বানে সৃষ্টি উৎসব জাগল তখন তার প্রথম আর হল আকাশে আকাশে বহ্নিমালার নৃত্যে। সূর্যচন্দ্রের নৃত্যে আজও বিাম পেল না, ষড়ঋতুর নৃত্য আজও চলছে পৃথিবী ……. যখন প্রদক্ষিণ করে। সুরলোকে আলোক অন্ধকারে যুগল নৃত্য, নরলোকে অশ্রান্ত নৃত্য জন্মমৃত্যুর সৃষ্টির আদিম ভাঙ্গাই এই নৃত্য, তার অন্তিমেও উন্মত্ত হয়ে উঠবে এই নৃত্যে ভাঙ্গাতেই প্রলয়ের অগ্নিনটিনী।”
গোপিনীসহ কৃষ্ণের রাসনৃত্য, কালীয়দমন নৃত্য, বাল গোপলের ননিচুরী নৃত্য প্রভৃতি আমাদের নিকট বিশেষ সুপরিচিত, বৈদিক যুগে যাগযজ্ঞাদি ও ধর্মানুষ্ঠানে নৃত্যের প্রচলন ছিল। বেদে মন্ডল নৃত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাব্রত-অনুষ্ঠানে জলপূর্ণ কলসী মাথায় করে বীণার তালে তালে এবং স্তোত্রগানের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী লোকেরা আগুনের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করতে এবং আগুনের উপর জল ঢেলে বৃষ্টি কামনা করত।
পুরাণাদি প্রায় সমস্ত ধর্মশাস্ত্রেই নৃত্যের উল্লেখ আছে। দেবোদ্দেশে অনুষ্ঠিত নৃত্যকে মানবের ঐহ্যিক ও পারত্রিক মঙ্গলের সোপান বলে কথিত আছে। ‘পদ্মপুরাণ’-এ কৃষ্ণভক্তের নৃত্যের শক্তি বর্ণিত আছে-
প্যাৎ ভূমে দিশো দৃগড্যাম
দোক্র্যাঞ্চা ন্দলং দিবঃ।
বহুধোৎসার্থতে রাজিন
কৃষ্ণভক্তস। নৃত্যতঃ ।
কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ দেখা যায়, সে যুগে রাজদরবারে নর্তকী নিয়োগের ব্যবস্থা ছিল । তাছাড়া সর্বসাধারনের আনন্দবর্ধনের জন্য পেশাদার নর্তকীরও উল্লেখ আছে। বাৎস্যায়ন তার ‘কামসূত্র’ গ্রন্থে নৃত্যকে চৌষট্টি কলার অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। বৌদ্ধযুগে নৃত্যশিল্প প্রভূত উন্নতি লাভ করেছে। ‘বিদ্যাবদনে’-এ রাজা রুদ্রায়ন বীণা বাজাতেন ও তাঁর পত্নী চন্দ্রাবতী নৃত্য করতেন। বলে উল্লেখ আছে।
“মহাবংশ’-এ আছে সিংহল রাজা রাকেশ রাহু’র প্রথম রানী রূপবর্তী যেমন ছিলেন, সুন্দরী তেমনি ছিলেন নৃত্যে পটিয়সী। অজন্তা, উলোরা, বাঘগুহা, কনারক মন্দির প্রভৃতির প্রাচীর গাত্রে নৃত্যরত নারীর বহুচিত্র দেখা যায়। মন্দিরে দোসী নিয়েগ প্রথার মধে ভারতীয় নৃত্যের ব্যাপক প্রচলনের দৃষ্টান্ত মিলে। বিগ্রহের নৈবেদ্য, ভোগ, আরতি প্রভৃতি ছিল যেমন প্রাত্যহিক পূজার অস, নৃত্যও সেইরূপ দৈনিক পূজার অঙ্গরূপে প্রচলিত ছিল।
এই নৃত্যের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক মন্দিরেই স্থায়িভাবে নৃত্যকুশলা দেবদাসী নিযুক্ত করা হতো। এক সময় ভারত য় নৃত্যকলা সমস্ত এশিয়া খন্ড ছেয়ে ফেলেছিল। বিখ্যাত চীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার রেল স্টেইন মধ্য-এশিয়ার মন্দিরগাত্রে নৃত্যরত মূর্তি অঙ্কিত
দেখেছিলেন। ঐ সকল মূর্তিতে ভারতীয় নৃত্য লার প্রভাব লক্ষিত হয়। এছাড়াও সারাভারতে নানাবিধ লোকনৃত্যের প্রচলন ছিল।
রাজশেখনের প্রাকৃত নাটক কর্পূরমঞ্জরী’তে ‘দন্ডরাস’ নামে একপ্রকার নৃত্যের উল্লেখ আছে। এই নৃত্যে নর্তক-নর্তকী এক একটি ছেলে লাঠি হাতে নিয়ে বক্রাকারে নাচতে থাকে এবং প্রত্যেকবার পার্শ্ববর্তী নর্তক-নর্তকীর লাঠিতে আঘাত করে। এর
অনুরূপ নৃত্য আমাদের বাংলার কাঠি নৃত্য। খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতব্দী হতে ভারতীয় নৃত্যকলার বিশেষ অবনতি ঘটে । এর প্রধান কারণ মুসলমানী প্রভাব। মোগল বাদশাহদের যুগে ভাাতীয় নৃত্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় –
ক) হিন্দুস্থানী বা উত্তর ভারতীয় এবং
খ) দক্ষিণী বা দক্ষিণ ভারতীয়
হিন্দুস্থানী নৃত্যে আঙ্গিকের বিশেষ নৈপূণ্য থাকলেও তার ঘাড়ের ভঙ্গী, চোখের খেলা ও কোমরের দোলায় আদিম ইন্দ্রিয়াশক্তির ব্যঞ্জনা প্রকাশ পায়। অবশ্য ভারতীয় নৃত্যেও গ্রীবাভঙ্গী, কটাক্ষক্ষেপ প্রভৃতি বিহিত, কিন্তু সেগুলি যেমন, অতি-পরিমিত তেমনি সংযত এবং বিভিন্ন ভাবের দ্যোতক হয়ে রসসৃষ্টির সহায়তা করে।
হিন্দুস্থানী নৃত্যের উপর মুসলমানী প্রভাব পড়ায় ভারতীয় নিজস্ব রূপটির অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়. কিন্তু দাক্ষিণাত্যে মুসলমান প্রভাব কম বলে ভারতীয় রূপটি তাতে অনেক পরিমাপে বজায় থেকেছে। বাদশাহী আমলে সামাজিক ও জাতীয় জীবনের বহু পরিবর্তন ঘটায় নৃত্য ক্রমে ক্রমে সভ্যজীবনের অঙ্গ হইতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
তারপর ভারতীয় নৃত্যের চরম অবনতি ঘটে ইংরেজ আমলে এবং সভ্য ও শিক্ষিত জীবন হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। থিয়েটার ও বাইজীর নাচের মধ্যে দক্ষিণী, মুসলমানী ও ইউরোপীয় নৃত্যের প্রভাব জগা-খিচুড়িরূপে বিরাজ করতে থাকে। অপরদিকে ভারতীয় নৃত্যের ক্ষীণ কঙ্কালটুকু শ্রীহীন রূপ ধারণ করে নানা লোকনৃত্যের মধ্যে বিশেষ করে বাংলায় রামায়ণ গান, জারি গান প্রভৃতির মধ্যে আত্মরক্ষা করতে থাকে ।
ভারতের ‘নাট্যশাস্ত্র’ হতে আরম্ভ করে নন্দিকেশরের অভিনয়দর্পণ’, ‘নর্তননির্ণয়’, ‘নৃত্যবিলাস’, ‘নৃত্যসর্বস্ব’, ‘নৃত্যশাস্ত্র’, অকেমগ্ন বিরচিত ‘নৃত্যাধ্যায়,’ ‘সংগীতনারায়ণ’, সঙ্গীতদামোদর, প্রভৃতি প্রাচীন ও প্রমাণিক এ ন্থে ভারতীয় নৃত্যের একটা রূপ দেখতে পাওয়া যেতো। মল্লিনাথ ‘কিরাতার্জনীয়’ নাটকের টীকায় ‘নৃত্যবিলাস’ ও ‘নৃত্যসর্বস্ব’ এর উল্লেখ করেছিলেন।
অর্থাৎ নৃত্য ছাড়া ভাবের সুষ্ঠু প্রকাশ হয় না; গীত ও মুদ্রাদির সঙ্গে নৃত্যের প্রয়োজন। তাই নর্তক- নর্তকীর পদদ্বয় তালানুগত হয়ে নৃত্য প্রদর্শন করে। পাশ্চাত্য নৃত্যে কণ্ঠ-সংগীতের একান্ত অভাব, সুতরাং এই নৃত্যের সঙ্গে সুরের অনির্বচনীয় ভাবলোক রচিত হয় না। নানা যন্ত্রের ছন্দ বহুল ধ্বনিকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছিল পাশ্চাত্য নৃত্য। এর মূলভিত্তি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের তাল।
খন্ড খন্ড নৃত্যের মধ্যে কোনো লোকোত্তর রস-ব্যঞ্জনা নেই। দীর্ঘায়ত ব্যালে (ballet) নৃত্যের মধ্যেও নানা যন্ত্রের বিচিত্র ধ্বনি ও তালের অক্ষুণ্ণ প্রভাব দেখা যায়। পাশ্চাত্য নৃত্যের আদর্শ চোখ ও কানের তৃপ্তিসাধন-ইন্দ্রিয়জ-ভোগবর্ধন। ভারতীয় নৃত্যের আদর্শ সূক্ষ্ম ভাবের রসপরিবেশণ দ্বারা প্রাণের তৃপ্তিসাধন।
পাশ্চাত্ত্যের ওয়ালস, কোয়াড্রিল ল্যানসারস, পোলকা, পোলকা- মাজরুকা, ব্যাল, মিনেট প্রভৃতি নৃত্য নিঃসন্দেহে নিখুত ও অপূর্বকারূকার্যময় দেহ সঞ্চালনের দৃষ্টান্ত, কিন্তু তাদের অন্তরে প্রাণের প্রতিষ্ঠা নেই- দেহ সঞ্চালনকে কেন্দ্র করে মূলগত ভাবরসের কোনো ইঙ্গিত নেই। ভারতীয় নৃত্যশিল্প অন্তর্মুখী, পাশ্চাত্ত্য নৃত্যশিল্প বহির্মুখী। পাশ্চাত্য নৃত্যকলার দূর্বলতা সম্বন্ধে সেদেশের শ্রেষ্ঠ কলাবিদগণ দিন দিন সচেতন হয়ে উঠেছিলেন।
নৃত্যের মধ্যে তারা দৈহিক ব্য গ্রামের অনবদ্য কৌশলের উপরেও আরও কিছু চাইতেন। বিখ্যাত পাশ্চাত্য নর্তকী Isadora Duncan তাঁর আত্মজীবনীর একস্থানে লিখেছেন- “This method (পাশ্চাত্ত্য ব্যালে নৃত্যের প্রথা) produces an artificial mechanical movement not worthy of the soul” তাই তিনি ভারতীয় নৃত্যের আদর্শ খোঁজছিলেন।
তাঁর কথায় “…the source of the spiritual expression to flow into the channels of the body filling it with vibrating light – the centifrugal force reflecting the spirit’s vision.” সুবিখ্যাত নর্তকী Anna Pavlova ও পাশ্চাত্য নৃত্যের প্রাণহীনতার কথা বহুবার বলে গেছেন। পাশ্চাত্যের যান্ত্রিক সভ্যতার সঙ্গে তাঁর নৃত্যকলাও যে এক প্রকার যান্ত্রিক মূর্তি পরিগ্রহ করেছিলো একথা বহু পাশ্চাত্য মনীষী অনুভব করে গেছেন।
আরও দেখুন :