উনিশ শতকের বাংলা গীতিনাট্য

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় উনিশ শতকের বাংলা গীতিনাট্য। গীতিনাট্য পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় এক প্রকারের গীতিনির্ভর নাটক। এটি পশ্চিমা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি প্রধানতম শাখা। এর উদ্ভব ইতালিতে, পরে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত মঞ্চনাটক ঘরানার মঞ্চ, অভিনয়, পোশাকসজ্জা এবং কখনো নৃত্য সহকারে এই গীতিনাট্য পরিবেশিত হয়। একটি ওপেরা হাউজে এই পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে ঐকতান-বাদকদল ও ক্ষুদ্র সঙ্গীতদল থাকে, উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে একজন সঙ্গীত পরিচালক এটি পরিচালনা করতে থাকেন।

উনিশ শতকের বাংলা গীতিনাট্য

 

উনিশ শতকের বাংলা গীতিনাট্য

 

গীতগোবিন্দ থেকে শুরু করে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ক্রমোত্তরণের মধ্য দিয়ে যে সকল উপাদানগুলি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিল ইউরোপীয় অপেরার আদর্শ অনুসরণে বাংলার সেই গীতিনাট্য ঊনিশ শতকের শেষদিকে একটি নতুন রূপ পেল তাকে কেউ বলেছেন নতুন যাত্রা, সখের যাত্রা বা গীতিনাট্য; কেউ বলেছেন গীতাভিনয় বা অপেরা। অনেক সময় ঠাট্টা ক’রে একে ‘অপ্পেয়েরা’ও বলা হত।

এর পাশাপাশি সমার্থক নাট্যরসক শব্দটিও কুচিৎ ব্যবহৃত হয়েছে। এই ধরনের গীতিপ্রধান নাটকের ধারা অন্যত্রও চোখে পড়ে; যেমন- অসমীয় ‘অংকীয়া নাট’, নেপালে প্রচলিত প্রাচীন গীতিনাট্য, দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট প্রদেশে প্রচলিত এক ধরনের নৃত্যাভিনয় ইত্যাদি।

বস্তুতঃ গীতিনাট্যের চাহিদা বা জনপ্রিয়তা এক সময় অনেক বেশী ছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে থিয়েটারের পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় অন্যদিকে পাঁচালী, হাফ্-আখড়াই, কবিগান ইত্যাদি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত দর্শকের কাছে রুচিকর ছিল না। নাট্যাভিনয় দেখারও তেমন সুযোগ ছিল না । অভিজাত পরিবারে বিশেষভাবে নিমন্ত্রিতদের জন্যেই সেগুলি অভিনীত হতো।

কাজেই মধ্যপন্থার প্রয়োজন হয়েছিল বলেই নাট্যাভিনয়ের বা গীতিনাট্যের উৎপত্তি। উনিশ শতকের নাটকের ইতিহাস এই দুইভাবে দ্বিধাবিভক্ত ছিল । গীতিনাট্যের আঙ্গিক সম্বন্ধে প্রথমদিকে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। ১২৮৫ সালের ৯ ই মাঘ তারিখে ‘সংবাদ প্রভাকর’ এ যে বিবৃতি প্রকাশিত হয় তা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়:

“বিগত শনিবার রজনীতে উক্ত জাতীয় নাট্যশালায় আমরা বিশুদ্ধ আনন্দ সম্ভোগ করিয়াছি। অধ্যক্ষগণ গীতাভিনয়ে সংসারের এবং তৎসহ সাধারণ দর্শকমন্ডলীর রুচি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেছেন দেখিয়া আমর চরম প্রীতি লাভ করিয়াছি। গত কয় বর্ষ ধরিয়া জাতীয় নাট্যশালায় ‘সংস্কৃত যাত্রা’, যাহা অপেরা নামে অভিনীত হইয়া আসিয়াছেন, অধ্যক্ষগণ
এক্ষণে তৎপরিবর্তে প্রকৃত গীতাভিনয় প্রদর্শনের জন্য অগ্রসর হইয়াছেন।”

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

একথা বলা হয়েছে ‘কামীনিকুঞ্জ’ এ তিনাট্যের অভিনয় সম্বন্ধে। মন্তব্যে বলা হয়েছে, … পেশাদার যাত্রার যেমন দুই একটি কথা এবং তৎপরেই গান থাকে, এতদিন সেই প্রণালীর অপেরা বা যাত্রা অভিনীত হইতেছিল: অধ্যক্ষসমাজ এক্ষণে ইটালিয়ান অপেরার ন্যায় আদি হইতে অভ্য পর্যন্ত সমস্তই সংগীত দ্বারা উত্তর-প্রতুত্তর, স্বাগত বিলাপযুক্ত প্রকৃত গীতাভিনয় প্রদর্শন করিতেছেন।’

এই গীতিনাট্য রচনা করেন গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রচনাকাল ১২৮৫। মোট পাঁচটি দৃশ্য, আগাগোড়া গানে রচিত। কোন গদ্যসংলাপ নেই। উদাহরণস্বরূপ :

খাম্বাজ – তাল ফেরতা

ললিতা – সইলো! আজি সাজাব যতনে ফুলহারে শ্রীরাধারে আর বাঁকা শ্যামধনে।

বিশাখা – বিকচ কমল ফুলে সাজাব হৃদয় খুলে জুড়ায় জীবন সখী, নেহারি নয়নে।

চিত্রা – কোমলাঙ্গী শ্রীরাধার সবে না কুসুমভার বিনাসূতে গাঁথি হার পরাব দুজনে।

কাহিনী এই রাত্রিশেষে সখীদের সঙ্গে ব্যাকুল রাধা কৃষ্ণের আগমন প্রত্যাশায় রত।

চন্দ্রাবলীর গৃহ থেকে বিদায় নিয়ে এলে রাধা অভিমানে কৃষ্ণকে প্রত্যাখ্যান করলেন। পরে অনুতাপ এবং মিলন । ইউরোপীয় অপেরার আদর্শে ‘কামিনীকুঞ্জ’ কে পূর্ণাঙ্গ গীতিনাট্য বলা যায়। কিন্তু তখনো অনেকের মনে ধারণা ছিল, নাটকে গনের প্রাচুর্য থাকলেই তাকে গীতিনাট্য বলা চলে। পূর্বেত্ত মন্তব্যের সঙ্গে তাই এ সম্বন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে-বলা বাহুল্য, যে, এরূপ প্রথা বঙ্গীয় নাট্য সমাজে সম্পূর্ণ নূতন।’

 

উনিশ শতকের বাংলা গীতিনাট্য

 

১২৮৫ সালের ১১ ই মাঘের অভিনয়ের পর সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদকের কাছে একখানি চিঠি প্রেরিত হয় ‘কেনচিৎ দর্শকেন তাতে জনৈক দর্শক অভিনয়ের প্রশংসা করে বলেন- “পরিশেষে এক বিষয় তাঁহাদিগকে একটি সৎপরামর্শ দিতেছি।….যদি ‘কামিনীকুঞ্জ’ নাট্যরসের মধ্যে প্রত্যেক গীতের অবসর স্থানে বাক্‌চাতুর্য থাকিত, তাহা হইলে সেদিন নাটকাভিনয় সম্বন্ধে একটি যুগান্তর উপস্থিত হইত।

সম্পাদক টীকাতে বলেন, দর্শক মহাশয়ের রুচি ভিন্ন দেখিতেছি। ‘গীতের অবসর স্থনে বাকচাতুর্য’ থাকিলে তাহাকে প্রকৃত গীতাভিনয় বলা যায় না। তাহা সংস্কৃত যাত্রা মাত্র। নাট্যশালার অধ্যক্ষগণ বিজ্ঞাপন দেন যে, ‘কামিনীকুঞ্জ’ ইটালিয়ান অপেরা অনুসারে রচিত, বাস্তবিক তাহাই যথার্থ।”

১৮২২, ১৩ ই জুলাই (৩০শে আষাঢ়, ১২২৯) তারিখেরে ‘সমাচার দর্পণ’-এ এর আগে বলা হয়েছিল-‘নূতন যাত্রা ….. নানাপ্রকার রাগরাগিণী সংযুক্ত গান হয় ও বাদ্যনৃত্য এবং গ্রন্থত পরস্পর কথোপকথন, এ অতি চমৎকার ব্যপার সৃষ্টি।’ ১৮৫৯ এ রাজেন্দ্রলাল মিত্র বলেন, ‘গত বিংশতি বৎসরের মধ্যে কবির হ্রাস পাইয়াছে। তাহার ত্রিংশবৎসরের পূর্ব হইতে যাত্রা বিশেষ প্রচলিত হইয়া আসিতেছিল।’

এই নূতন যাত্রাকেই বলা হয়েছে গীতাভিনয় বা অপেরা- *আমরা যে যুগের কথা বলিতেছি, সেই যুগে আবার গীতাভিনয় নামে যাত্রা ও নাটকের মাঝামাঝি ধরনের একপ্রকার অভিনয় এ দেশে দেখা দিয়াছিল। এই সকল অভিনয় পুরাদস্তুর নাটকেরই
মত; তফাতের মধ্যে অভিনয় দৃশ্যপটাদির বালাই ছিল না। নাটকাভিনয় এ দেশে বিশেষ জনপ্রিয় হইবার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই খুব উৎসাহিত হইয়া উঠে, কিন্তু রঙ্গমঞ্চ স্থাপন সম্ভব ছিল না।

অনেকেই ভেবেছিলেন যে, অপেরায় পূর্ববর্তী যাত্রার প্রয়োজন মিটবে। অবশ্য তাও শেষে প্রহসনের রুপ নেয় এবং সুরুচিরকর নাটকের প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে। সেই শতকের সপ্তম-অষ্টম দশক পর্যন্ত পুরোনো ধারার অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন যাত্রার যেমন উদ্ভব হয়েছিল, তেমনি তারই পাশাপাশি ছিল থিয়েটার।

কবিগান যদিও তখন জনপ্রিয়তা হারাতে বসেছিল, তথাপি নিব শ্রেণীর লোকদের মধ্যে তার প্রভাব বর্তমান ছিল; গীতিনাট্যের শুরু থেকেই- আঙ্গিকের দিক থেকে ইউরোপীয় আদর্শের অনুসারী হলেও, সেই অশ্লীল রুচি তার মধ্যে বিশেষভাবে ছায়াপাত করে। অন্যদিকে থিয়েটারও পুরোপুরি অগ্রসর হবার পথ পায়নি । এরই মধ্যে দিয়েই উনিশ শতকের গীতিনাট্যের জন্ম। মূলত থিয়েটারের প্রয়োগকলা ও যাত্রার বিষয়বস্তু ছিল গীতিনাট্যের উপজিব্য ।এই গীতিনাট্যকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হত-

১. যেগুলি আদ্যন্ত গানে বাঁধা

২. যেখানে গানের প্রাচুর্য, কিন্তু সংলাপ গদ্যে অথবা পদ্যে।

বলা বাহুল্য, এই দুই রীতিকে গীতিনাট্য বলা হলেও, প্রথম ধারাকেই গীতিনাট্যের আখ্যা দেওয়া চলে। গীতিনাট্যের মধ্যে যুগপৎ ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত, পাশ্চাত্য ঐকতান এবং নৃত্যের একত্র সমাবেশ ছিল। ঘেসেড়ে ঘেসেড়নী, কলু-ভুলুর হীন কদর্য নৃত্য সৌভগ্যবশত রুচিকর নৃত্যের দিকে ঝুঁকেছিল। এর থেকে একথাই বা যয়, বাংলা গীতিনাট্য ধীরে ধীরে সংহতির পথে চলতে শুরু করেছিল। পূর্বতন নাট্যগীতির ধারটি নতুন ভাবে এ যুগের গীতিনাট্যের মধ্যে দানা বাঁধবার সুযোগ পায়।

 

উনিশ শতকের বাংলা গীতিনাট্য

কবির জন্মবার্ষিকীতে একটি নৃত্যানুষ্ঠান

আরও দেখুন :

Leave a Comment