কথা ও সুরের যুগল মিলন নাটকের গানে

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় কথা ও সুরের যুগল মিলন নাটকের গানে

কথা ও সুরের যুগল মিলন নাটকের গানে

 

কথা ও সুরের যুগল মিলন নাটকের গানে

 

কথা ও সুরের যুগল মিলন নাটকের গানে

আমরা জানি গানে কথা ও সুরের মধ্যে কে কার অনুগত্য স্বীকার করবে, এই তর্কে বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ; কখনো কথার দিকে তাঁর ঝোঁক, কখনো তাঁর পক্ষপাত সুরের প্রতি। কুড়ি বছর বয়স থেকে জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এই দ্বিধা দেখা যায় তাঁর সংগীত সম্পর্কিত ভাবনায়। এক বয়সে তাঁর মনে হয়েছিল শুধু কথা অনুভবের যে প্রাপ্ত স্পর্শও করতে পারে না, সুর সেখানে পৌঁছে যায় অনায়াসে।

এই চিন্তার ছাব্বিশ বছর পরে এই প্রসঙ্গে তিনি স্পষ্টই জানালেন; ‘মত বদলিয়েছি। কতবার বদলিয়েছি তার ঠিক নেই।… শেষ দিন পর্যন্ত যদি মত বদলাবার শক্তি অকুণ্ঠিত থাকে তা হলে বুঝব এখনো বাঁচবার আশা আছে। এই সময় সংগীতে ‘যুগলমিলনে’র প্রতিই তাঁর আগ্রহ, যে আগ্রহ এর একবছর আগেই দেখা গেছে ‘কথা ও সুর’ প্রবন্ধে

‘আমরা যে গানের আদর্শ মনে রেখেছি তাতে কথা ও সুরের সাহচর্যই শ্রদ্ধেয়, কোনো পক্ষেরই আনুগত্য বৈধ নয়। সেখানে সুর যেমন বাক্যকে মনে তেমনি বাক্যও সুরকে অতিক্রম করে না। কেননা, অতিক্রমণের দ্বারা সমগ্রসৃষ্টির সামজ্ঞস্য নষ্ট করা কলারীতিবিরুদ্ধ।

রবীন্দ্রনাথের নাটকের ধারাটি লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে নাটকে গানের ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর সচেতন পরিকল্পনা ছিল, এবং সে পরিকল্পনা নাট্যগঠনের সঙ্গেই যুক্ত। কথায় যে ভাব প্রকাশ করা যায় না, যে পরিবেশ নিছক সংলাপে গড়ে ওঠে না, তারই জন্য নাটকে একেছে গান।

বিশু গায়

‘তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো… ওগো দুখজাগানিয়া।’

নন্দিনী তাকে প্রশ্ন করে

‘তুমি আমাকে বলছ ‘দুখজাগানিয়া’?

এই প্রসঙ্গেই আসে বিশুর ব্যক্তিগত দুঃখের কথার পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে যে গান, সে দুখের কথা বলেও অনুভবকে নিয়ে যায় দুঃখের সীমার বাইরে, ব্যথার অতীত অনির্বচনীয় লোকে। শুধু কথায় যা হতে পারত অভিপ্রত্যক্ষ, ব্যক্তিগত বেদনায় যা পড়ত বাঁধা, সুর তাকে উত্তীর্ণ করে দেয় নিভৃত নিবিড় প্রেমের অনুভবে।

অথচ গানের মধ্যে তো গানের আনন্দই নয় কেবল, দুঃখের উপলব্ধিটিও থাকে জড়িয়ে? এই যে একই সঙ্গে দুঃখবোধ এবং উত্তরণ, এ উঠে আসে বিশুর স্বভাব থেকেই, আর সুর তাকে দেয় যোগ্য ভাষা। এ হল কথার ভাষা আর সুরের ভাষাকে তাদের স্বতন্ত্র রূপে যুক্ত করার আয়োজন।

আবার কোথাও কথার ভাষা আর সুরের ভাষা মিলে গেছে অভিন্ন চেহারায়, এর সূচনা ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’, ‘চিরকুমার সভা’ আর ‘তাসের দেশ’ এ আছে এমন কিছু উদাহরণ। ‘চিরকুমার সভা’র অক্ষয় সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে সুরে গেয়ে উঠেছে দু’চারটি কলি, সে সুরে কৌতুকময় কথা বলার ধরনটিই প্রধান; প্রচলিত অর্থে এদের ‘গান’ বলা যাবে কি না সংশয় হয়, সংলাপের সঙ্গে যোগেই এগুলির সার্থকতা।

 

কথা ও সুরের যুগল মিলন নাটকের গানে

 

একটি উদাহরণ;

‘দেখো, ধর্মে-কর্মে স্বামীকে এগিয়ে যেয়ো না; স্বর্গে তুমি যখন ডবল প্রমোশন পেতে থাকবে আমি তখন পিছিয়ে থাকব তোমাকে বিষ্ণুদূতে রথে চড়িয়ে নিয়ে যাবে, আর আমাকে যতদূর কানে ধরে হাঁটিয়ে দৌঁড় করাবে

গান

স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাবে উড়িয়ে

পিছে পিছে আমি চলব খুঁড়িয়ে

ইচ্ছা হবে টিকির ডগা ধরে

বিষ্ণুদূতের মাথাটা দিই শুঁড়েয়ে।

কোনো কোনো গানে রাগরাগিনীর স্পর্ণও আছে, যেমন ‘পাছে চেয়ে বসে আমার মন গানে আছে রাগিনীর লক্ষণ, কিন্তু রাগরূপকে অতিক্রম করে লঘু চাপল্যের প্রকাশই এখানে উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে, যা অক্ষরের স্বভাবসূত্রেই আগত। যে উক্তি এই গানকে সঙ্গে করে নিয়ে এল তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে: ‘গরিবের ছেলে, স্ত্রীকে কথা বলতে দিতে ভরসা হয় না, পাছে খপ করে বাজুবন্ধ চেয়ে বসে’:

গান

পাছে চেয়ে বসে আমার মন

আমি তাই ভয়ে ভয়ে থাকি।

পাছে চোখে চোখে পড়ে বাঁধা

আমি তাই তো তুলি নে আঁখি।’

“চিরকুমার সভা’র কৌতুকমুখর পরিবেশের সঙ্গে এই গানগুলি মিলে যায় অনায়াসে, যেমন মিলে যায় ‘তাসের দেশ’ এর চরিত্রের সঙ্গে কাটা কাটা সুরের বিন্যাসে রচিত ‘তোলন নামন পিছন সামন’ কিংবা “চিঁড়েতন হরতন ইস্কাতন’ গান। ‘হাই’, ‘হাচি’, আর ‘ইচ্ছে’র গানেও আছে এইরকম কথা বলার ভঙ্গি।

‘চিরকুমার সভা’ আর ‘তাসের দেশ’-এর এই গানগুলি আমাদের স্মরণ করায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের নাট্যভাবনা; সুর করিয়া নানা ভাবকে গানের ভিতর দিয়া প্রকাশ করিয়া অভিনয় করিয়া গেলে চলিবে না কেন?”

এরই পূর্ণতর রূপ দেখি ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যে, গানই যেখানে সংলাপ। আমাদের মুখের ভাষা সে গানের বাণী, আর সুরবিন্যাসের ধরণে সেগুলি যত গান তার চেয়ে বেশি সুরে কথা বলা।

প্রকৃতির গানে আনন্দের জল চাওয়ার সেই আশ্চর্য বর্ণনা, গদ্যনাটক ‘চণ্ডালিকা’র সংলাপের সঙ্গে এর দূরত্ব আর এই বর্ণনা যে প্রকৃতিরই নয় কেবল, আমাদের মনেও নিয়ে আসে শিহরণের স্পর্শ, সে তো সুরের যোগ্য উচ্চারণেই? অবশ্য সুর এখন আর প্রথম যুগের গীতিনাট্যের মতো কথার বা ভাবের বাহনমাত্রই নয়, কথা আর সুর এই অন্ত্যপর্বে পেয়েছে অনায়াস সংগতি।

সেইসঙ্গে নাটক আর গানও মিলে গেছে নিবিড় একাত্ততায়। বোধহয় এটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রেত। কথার আবেষ্টন থেকে সুরের মধ্যে ভাবকে বিস্তার দেওয়া, কিংবা সুরের সহায়তায় কথার গভীরে প্রবেশ করার যে টুকরো টুকরো উদাহরণ ছড়ানো আছে রবীন্দ্রনাটকে, তাঁর শেষ জীবনের নৃত্যনাট্যগুলি তারই সংহত সার্থকতম প্রকাশ। এ সেই সময় যার স্বল্পকাল পরেই তিনি লিখেছেন;

 

কথা ও সুরের যুগল মিলন নাটকের গানে

 

‘বাক্যের সৃষ্টির উপরে আমার সংশয় জন্মে গেছে।’

গান তাঁর অন্যতম আশ্রয়। আর গানের ভিতর দিয়েই সম্পন্ন হয়েছে তাঁর নাট্যমুক্তির আকাঙ্খা। নাটকের ভাষা একটিই, কথা-সুরে সমগ্র সেই অখন্ড রুপের নাম গান। গান আর নাটককে মিলিয়ে দেবার সাধনা এতদিনে পেল প্রত্যাশিত নাট্যম্পূর্ণতা। ‘গানের সুরে আমার মুক্তি’ শুধু গীতরচয়িতা রবীন্দ্রনাথের কথাই নয়, এ যেন নাট্যস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথেরও অন্তরতম অনুভব।

আরও দেখুন :

Leave a Comment