আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বাদ্যযন্ত্রের কালানুক্রমিক বিবর্তনের ইতিহাস। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে সব ধরণের তারের যন্ত্র বীণা নামে পরিচিত ছিলো। মনোকর্ড অথবা পলিকার্ড, ছড় দিয়ে বাজানোর যন্ত্র অথবা টোকা দিয়ে বাজানোর যন্ত্র, পর্দাযুক্ত অথবা পর্দাবিহীন যন্ত্র সবই এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এর মধ্যে কোনটা ছিলো জিথার দলভুক্ত, কোনটা লিউট দলভুক্ত। ভরত রচিত ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থে বিভিন্ন প্রকার বীণার নাম পাওয়া যায়। তবে কোনটি কোন ধরণের হতে পারে তা বলা হয় নি।
বাদ্যযন্ত্রের কালানুক্রমিক বিবর্তনের ইতিহাস
তেমনি ‘সংগীত মকবুল’ গ্রন্থে উনিশটি সংগীতপনিষতসারদ্ধার’ গ্রন্থে তেরটি এবং ‘সংগীতরত্নাকর’ গ্রন্থে দশটি বাঁণার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আকার ভেদে কোনটি কোন দলভুক্ত হতে পারে সে বিষয়ে বিশদ বিবরণ নাই। গঠন নির্বিশেষ সবগুলোই বীণা। পরবর্তীকালে নাট্যশাস্ত্রের টীকাকার কল্পিনাথ নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত বীণাগুলোর ব্যাখ্যা দান করেছেন।
‘চিত্রা’ এবং ‘বিপক্ষী হার্পের মত পলিকর্ড জাতীয় বীণা। ‘রুদ্রবীণা’ এবং ‘স্বরস্বতী বীণা মনোকর্ড জাতীয়। আবার ‘রাবন হস্ত বীণা” এবং ‘পিনাকী বীণা’ হচ্ছে ছড় দিয়ে বাজানো হয় এমন ধরণের যন্ত্র। বেহালার সাথে এগুলোর তুলনা করা যেতে পারে। আধুনিক যুগে আমরা এগুলোকে বীণা বলে ভাবতে পারি না। আবার ‘নাগস্বরম’ বা “শানাই এর মত শুষির বাদ্যযন্ত্র পরিচিত ‘মুখরীণা’ হিসেবে।
আজও ‘বীণ’ বলতে ‘রুদ্রবীণা’ এবং সাপুড়ের বাঁশি দু’টোকেই বোঝানো হয়। ৯৬ বিষয়টি বাদ্যযন্ত্রের বিবর্তন উদ্ঘাটনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
এ কারণে বি.সি. দেব তাঁর ‘ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন “প্রাচীন পুস্তকে এই শব্দটি (অর্থাৎ বীণা) পেয়ে যদি কোন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত করেন যে, আধুনিক বীণার ঐতিহ্য (আধুনিক বলতে এখানে রুদ্রবীণা অথবা তাঞ্জৌরী বাঁধার মত তুলনামূলক আধুনিক যুগের বাদ্যযন্ত্রের কথা বোঝানো হয়েছে) অতি পুরাতন, তিনি হয়তো ভুল করবেন। কারণ, এই পুরাতন শব্দটি সম্ভবত হার্প জাতীয় অন্য কিছু বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। ”
এই কারণে অত্যন্ত সতর্কভাবে বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস অনুসন্ধান করা দরকার। প্রাচীন নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে বাদ্যযন্ত্রগুলোর বিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে এদের গঠনগত পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা তাই খুব জরুরী।
মধ্যযুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগীত বিষয়ক রচনা হচ্ছে শাঈদের রচিত ‘সংগীতরত্নাকর’। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এটি রচিত হয়।
এই গ্রন্থে শাঈদের প্রাথমিক যুগের একটি বাঁণাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করছেন, এর নাম ‘একতন্ত্রী বীণা’। শাঙ্গদেবের মতে এটি তখনকার সময়ে বীণা জাতীয় যন্ত্রের মধ্যে প্রধাণ হিসেবে পরিগণিত হতো। এটি উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে, এটিই প্রথম এক তার বিশিষ্ট ফিংগারবোর্ড যন্ত্র যাতে সুর বাজানো যায়। মনোকার্ড যন্ত্র হিসেবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার। কারণ এর পূর্ববর্তী যন্ত্রগুলো ছিলো পলিকার্ড জাতীয়।
একাধিক তারকে বিভিন্ন সুরে বেঁধে নিয়ে এসব পলিকার্ড জাতীয় বীণা বাজানো হতো। এইসব যন্ত্রে এক একটি সুরের জন্য এক একটি তার ব্যবহৃত হতো। আলাদাভাবে বিভিন্ন তারে টোকা দিয়ে এইনর বীণা বাজনো হতো। বাঁ হাতের আঙুলের সাহায্যে ফিংগারবোর্ডে তার চেপে কার্যত এর দৈর্ঘ্য কম বেশি করে বিভিন্ন সুর উৎপন্ন করার ব্যবস্থা এসব বীণায় ছিলো না। এ পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে আধুনিক।
তারের যন্ত্রে পর্দা (ফ্রেট) ব্যবহার করে অথবা অথবা পর্দাবিহীন যজ্ঞে ফিংগারবোর্ডের উপরে আঙুল চেপে কার্যত তারের দৈর্ঘ্য কমানো অথবা বাড়ানো হয়। ইংরেজিতে একে বলে Active vibration length । এক পর্দা থেকে আরেক পর্দায় আঙুল সরিয়ে নিলে Active vibration length পরিবর্তিত হয়। খাদের সুর বাজাতে হলে Active vibration length দীর্ঘ হওয়া দরকার।
আবার চড়া সুর বাজাতে হলে Active vibration length খাটো হওয়া দরকার। এই প্রয়োজন অনুসারে ফিংগাবোর্ডে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতে হয়। ভরত বর্ণিত ঘোষ বীণা অথবা ঘোষিকা বাঁধার পরিমার্জিত রূপ ছিলো একতন্ত্রী বীণা। এটি ছিলো শিখার গোত্রের বাদ্যযন্ত্র। ডান হাতের আঙুল দিয়ে তারে আঘাত করে একতন্ত্রী বীণা বাজানো হতো। বাঁ হাতের তিনটি আঙুল তর্জনী, মধ্যমা এবং অনামিকার সাহায্যে ফিংগারবোর্ডে তার চেপে যন্ত্রটি বাজানো হতো।
তবে বাজানোর সময়ে বাঁ হাতের আঙুলে পাতলা এক খণ্ড বাঁশের চটা বেঁধে নেওয়া হতো। বাঁ হাতের সাহায্যে তারের দৈর্ঘ্য কম বেশি করে যজ্ঞে সুর তোলার কারণে এটি একটি উৎকৃষ্ট যন্ত্র হিসেবে সমাদর লাভ করে হার্প জাতীয় অন্যান্য যজ্ঞের তুলনায়। পর্দাবিহীন হওয়ার কারণে দক্ষ শিল্পীরা এতে সূক্ষতম শ্রুতি পরিবেশন করতে পারতেন। ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র’-এর আমল থেকে শাস্ত্রদেবের ‘সংগীতরত্নাকর – এর রচনাকাল পর্যন্ত এটি প্রায় হাজার বছর ধরে প্রচলিত ছিলো।
পঞ্চম শতাব্দীর শেষ দিকে এসে এটি অন্যতম প্রধাণ বাঁণা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দীতেও একতন্ত্রী বীণা সমান জনপ্রিয় ছিলো। ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দীর শেষদিকে কিন্নরী বীণার উন্নততর সংস্করণ আবিস্কার হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে একতন্ত্রী বীণার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। কিন্নরী বীণা ছিলো ফ্রেটযুক্ত জিয়ার। কিন্নরী বাঁধার কয়েকটি রূপ প্রচলিত ছিলো।
এর কোনটি লোক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে এবং কোনটি উচ্চাঙ্গ বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিগণিত হতো। ঐতিহাসিক আবুল ফজলের রচনায় যে ধরণের বিশ্বরী বীণার উল্লেখ করা হয়েছে তাতে দু’টি তার এবং তিনটি লাউ ব্যবহার করা হতো। আরো পরে কিন্নরী বীণার উন্নততর সংস্করণ হিসেবে রুদ্র বীণা এবং স্বরস্বতী বীণার আবির্ভাব হয়। কিন্নরী বীণায় চৌদ্দটি পর্দা থাকতো, এগুলো সরানো যেতো। রুদ্র বীণায় পর্দার সংখ্যা হলো বাইশটি।
এগুলো বাঁশের গায়ে মোম দিয়ে আটকিয়ে দেওয়া হতো। দক্ষিণ ভারতে ক্রমান্বয়ে পর্দাযুক্ত বীণার নানা পরিবর্তন এবং বিবর্তন সাধিত হতে থাকে যা পরবর্তীকালে স্বরস্বতী অথবা তাঞ্জৌরী বীনার রূপ লাভ করে। রুদ্র বীণা নামের উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যায় নারদ রচিত ‘সংগীত মকরন্দ গ্রন্থে। কিন্নরী বীণায় সাথে রুদ্র বীণার মূল পার্থকা দু’টি। প্রথমটি হচ্ছে পর্দার সংখ্যা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে লাউয়ের সংখ্যা।
কিন্নরী বীণার তুলনায় রুদ্র বীণায় পর্দার সংখ্যা আটটি বেশি এবং এগুলোর বিন্যাসেও পার্থক্য বিদ্যমান। রুদ্রবীণায় বারোটি স্বরের প্রত্যেকটির জন্য পৃথক পৃথক পর্দা থাকে। এই কারণে পর্দা না সরিয়েও এই যন্ত্রে যে কোন রাগ পরিবশেন করা যায়। এছাড়া কিন্নরী বীণায় তিনটি লাউ ব্যবহৃত হতো। সকল বাদ্যযন্ত্র রুদ্রবীণায় লাউয়ের তুম্মা রইলো দু’টি। ক্রমে রুদ্র বীণা উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বীণায় পরিণত হয় এবং সংক্ষেপে শুধু ‘বীণ’ নামে পরিচিত হয়।
এর জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে বীণা বলতে আধুনিক যুগে শুধু রুদ্র বীণাকেই বোঝায়। রুদ্র বীণার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে তিন ফুট। এর দৈর্ঘ্য বলতে প্রকৃতপক্ষে এর ফিংগারবোর্ডের দৈর্ঘাকেই বোঝায়। সকল বাদ্যযন্ত্র এটি বাঁশের তৈরি। এর পেছন দিকে দু’টি লাউয়ের তুম্মা সংযুক্ত থাকে। লাউয়ের ব্যাস সাধারণত চৌদ্দ ইঞ্চি। তবে বাঁশ খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় এবং প্রতি বছর পরিবর্তন করতে হয় বলে আধুনিক যুগে বাঁশের পরিবর্তে সেগুন কাঠের ফিংগারবোর্ড ব্যবহৃত হয়।
রুদ্রবীণার পর্দাগুলো কাঠের তৈরি। বিশেষভাবে তৈরি এক ধরণের মোম দিয়ে এগুলো ফিংগারবোর্ডের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি পর্দার উপরে পিতলের পাতলা পাত লাগানো হয়। বাদকের ইচ্ছা অনুযায়ী পর্দার সংখ্যা কম অথবা বেশি হতে পারে।
রুদ্র বীণায় তার থাকে সাতটি। চারটি মূল তার। বাকী তিনটি শ্রুতি তন্ত্রী অর্থাৎ ড্রোন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে দু’টি লাগানো হয় বাঁণার ডান পাশে এবং একটি লাগানো হয় বাম পাশে।
এতক্ষণ যে সকল বাদ্যযন্ত্রের কথা বলা হলো সেগুলো সব জিথার গোত্রের। এগুলো ছাড়াও প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে লিউট জাতীয় যন্ত্রেরও কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী সময়ের মধ্যে অজন্তা, নাগার্জুনকরা এবং অমরাবতীর গুহাচিত্রে অঙ্কিত ভাস্কর্য এবং দেয়ালচিত্রে স্পষ্টভাবে লিউট জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের চিত্র পাওয়া যায়।
নাট্যশাস্ত্রের টাকাকার অভিনব গুপ্ত সকল বাদ্যযন্ত্রকে তিনটি গোত্রে বিভক্ত করেছিলেন – (১) বক্র, (২) কুর্মি এবং (৩) অলাবু। কুর্মি অর্থ কাপ, – সুতরাং যে সব যন্ত্রের দেহ গোলাকার এবং চেষ্টা, নাতিদীর্ঘ ফিংগারবোর্ড বিশিষ্ট সেই সকল সঙ্গকে তিনি দ্বিতীয় গোত্রভুক্ত বলে বর্ণনা করেছেন। অজন্তা, নাগার্জুনকরা এবং অমরাবতীর চিত্রগুলোতে যে ধরণের লিউটের ছবি পাওয় যায় তা হুবহু অভিনব গুপ্তর বর্ণনার সাথে মিলে যায়।
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে মধ্য প্রদেশের একটি বৃন্দ বাদনের চিত্রে দেখা যায় একজন মহিলা বাদক কোলে একটি লিউট ধরণের যন্ত্র নিয়ে বাজাচ্ছে। ছবিটি এত স্পষ্ট যে, এতে অঙ্কিত তারের সংখ্যাও শুনে দেখা যায় যে যন্ত্রটিতে সাতটি তার রয়েছে। চিত্রে বাদক তার ডান হাত দিয়ে যন্ত্রের তারে টোকা দিচ্ছে এবং বাঁ হাত দিয়ে তার চেপে ধরেছে। যন্ত্রটির ফিগারবোর্ডে কোন পর্দা নাই। ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে উল্লেখ করেছিলেন যে চিত্রা বীণা সাত তার বিশিষ্ট।
সম্ভবত সেই কথার উপর ভিত্তি করে অধ্যাপক লাল মণি মিশ্র এবং ড.বি.সি. দেব এই যন্ত্রটিকে চিত্রা বাঁণা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ঐতিহাসিক নিদর্শনে এইসব বাদ্যযন্ত্রের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার কারণে বাস্তবে সকল বাদ্যযন্ত্র এ ধরণের যন্ত্রের উপস্থিতি সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া যায়। যদিও তদানীন্তন সংগীতের ইতিহাসে পণ্ডাকৃতি জিগারের তুলনায় এগুলোর উপস্থিতি খুবই নগন্য।
সংগীতের ইতিহাসে দীর্ঘদিন এ ধরণের যন্ত্রের বহুল ব্যবহার চোখে না পড়লেও এই ধরণের যন্ত্র থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সংগীতের ইতিহাসে উদ্ভব হয়েছে রবাব নামক যন্ত্রের। সংগীতের ইতিহাসে এটি একটি প্রধান বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিগণিত। সম্রাট আকবরের আমলে যন্ত্রটি উৎকর্ষ লাভ করে। তাঁর দরবারের সভা সংগীতজ্ঞ মিঞা তানসেন অসাধারণ রবাব বাজাতে পারতেন।
রবারের একাধিক সংস্করণ রয়েছে। মিঞা তানসেন যে ধরণের রবাব বাজাতেন সেটি তাঁর নামের অনুসরণে সেনিয়া রবার নামে পরিচিত। এর অপর নাম ধ্রুপদী রবার। চিত্রা বীণার কোন একটি সংস্করণ থেকে পরিমার্জনের মাধ্যমে মিঞা তানসেন একে ধ্রুপদী সংগীতের উপযোগী করে তোলেন বলে “অধ্যাপক লাল মণি মিশ্র দৃঢ়ভাবে মতামত ব্যক্ত করেেছন। ধ্রুপদী রবাবের দৈর্ঘ্য তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট হয়ে থাকে।
আরও দেখুন :