Site icon Arts and Culture Gurukul [ শিল্প ও সংস্কৃতি গুরুকুল ] GOLN

গান কখনও কথায় পূর্ণ প্রয়াস

গান কখনও কথায় পূর্ণ প্রয়াস

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় গান কখনও কথায় পূর্ণ প্রয়াস

গান কখনও কথায় পূর্ণ প্রয়াস

 

 

গান কখনও কথায় পূর্ণ প্রয়াস

রবীন্দ্র নাটকে কিছু গান আছে তা যেন কথারই ভাষ্যকার, যেন প্রগলভ ব্যাখ্যা তার অবয়ন ধরে গান, যেমন ‘রাজা’ বা মুক্তধারা’ আমরা জানি যে রবীন্দ্রনাথের গান বাদী প্রদান, ফলে তা কেবল সুরের মায়াজালই বোনে না, সেই সঙ্গে একে যায় কথার রেখাও, তেমনি রবীন্দ্রনাটকের গানের কথায় আমরা অতিরিক্ত কিছু পাই যা তার অব্যবহিপূর্ব সংলাপেই ধরা পড়ে।

সংলাপের যে বিষয়ের উত্থাপন, সাথে তারই বিস্তার। বিস্তার না বলে কখনো তাকে পুনঃপ্রয়োগ বলা যায়। কেননা পূর্ববর্তী সংলাপে সেই গীতিভাষায় পুরোটাই অনেক সময়ে মিলে যায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক-

ধনঞ্জয়। রাজা, ভুল করছ এই যে ভাবছ জগৎটাকে কেড়ে নিলেই

জগৎ তোমার হল। ছেড়ে রাখলেই থাকে পাও মুঠোর

মধ্যে চাপতে গেলেই দেখবে সে ফসকে গেছে

ভাবছ, তবে তুমি যা চাও

জগৎটাকে তুমিই নাচাও,

দেখবে হঠাৎ নয়ন মেলে

হয় না যেটা সেটাও হবে।

কিংবা বিপরীত উদাহরণ :

ধনঞ্জয়। রইল বলে রাখলে কারে?

হুকুম তোমার ফলবে কবে?

টানাটানি টিকিবে না ভাই

রবার যেটা সেটাই রবে।

রাজা। টেনে কিছুই রাখতে পারবে না। সহজে রাখবার

শক্তি যদি থাকে তবেই রাখা চলবে।

আবার অন্যত্র

ঠাকুর্দা ফাঁকা। আমাদের দেশে রাজা এক জায়গায় দেখা

দেয় না বলেই তো সময় রাজাটা একেবারে রাজায়

ঠাসা হয়ে রয়েছে- তাকে বল ফাকা। সে যে

আমাদের সবাইকেই রাজা করে দিয়েছে।

জায়গা ছেড়ে দেয়।

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে

নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে

রাজা সবারে দেন মান

সে মান আপনি ফিরে পান

মোদের খাঁটো করে রাখেনি কেউ কোন অসত্যে

নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে।

এসব অংশ বস্তুত একই কথার গদ্য পদ্য দুই ভিন্ন রূপ ।

নাটকের গান প্রকাশের সামগ্রিক আলোচনার প্রেক্ষিতে বলতে পারি কেবল পরিবেশ রচনার সার্থক ব্যবহার আমরা কখনো বিষয়টি দেশের ঈষৎ প্রয়োজন ভিন্ন অন্ন অনেক সময়েই রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে গান একটা অলংকার হয়ে ওঠে। সংস্করণের পরিবর্তনে বা অভিনয়ের প্রয়োগে গানগুলি যথেষ্ঠ যোজনবর্জনে ও এই সিদ্ধান্তের সমর্থন পাওয়া যায়। আবার কখনো একই মান নাট্যরূপান্তরে হচ্ছে অন্য চরিত্রের গান।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

‘ঋনশোধ’ এ শেখরের তিনটি গান, ‘শারসোৎসব’ শুনি সন্ন্যাসী আর ঝাকুদার মুখে

আমি রূপে তোমার ভোলাব না’

‘অরূপরতনে’- এ আছে সুরঙ্গমার কণ্ঠে, ‘রাজা’তে এ গান স্বয়ং রাজার

“অলংকার যে মাঝে পড়ে

মিলনেতে আড়াল করে ।

তোমার কথা ঢাকে যে তার মুখর ঝংকার’

রবীন্দ্রনাট্য গানগুলি কখনো বা শিল্পের লক্ষভূমির বাক্যে শিল্পের আড়াল তৈরী করে দেয়। এখানেও হয়তো কবি ভাবছিলেন।-

‘আমার সুরগুলি পায় চরণ

আমি পাই নে তোমারে।’

আবার এমন ভাবাও অসংখ্য যে গানগুলির দ্বারা নাট্যরস কখনো ক্ষুণ্ন হলেও তার দ্বারা কার্যহীন হয়েছে বাক্যসৌন্দর্য। যেটার লিঙ্ক প্রকাশে এলিয়েট বলেছিলেন।

‘In failing to be dramatic (he) failed also to be paitic’

তেমনি এখানে বলতে পারি, যে সমস্ত অংশ নাটক হিসেবে সুন্দর নয় তা বাক্য হিসেবেও ততটাই অগ্রাহ্য। সন্দেহ নেই যে, রবীন্দ্রনাথ এসব রচনার দেশীয় চিত্তের অনুকূল এক সাংগেতিক কাঠামো প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দেখতে হবে যে সেটা শিল্প অভিপ্রায় অতিক্রম করে মোহমাত্রে পর্যবসিত হল কি না ।

এই মোহরচনা রবীন্দ্রনাথের কাছে মূল ছিল না, কিন্তু ক্রমে তিনি তার বশে এসেছিলেন। আবার এর থেকে মুক্তির একটা ছোট ইশারা মেলে ‘মুক্তধারা’র পর। প্রহসন ‘চিরকুমার সভা’ এবং রূপক ‘তাদের দেশ এর ব্যতিক্রম বাদ দিলে পরবর্তী নাটকে গানের সংখ্যা বহুল পরিমানেই কমে যায়।

‘মুক্তির উপায়’ এ দুটি শোধবোধ এ তিনটি, বাঁশরীতে পাঁচ, রক্তকরবী’তে আট, ‘গৃহপ্রবেশ’ ‘শেষ রক্ষা’ এবং ‘তপতী’তে গানের সংখ্যা নয়। ‘নটীর পূজা’ গানের আলেখ্য, সেখানে গান বারোটি। এর কাছে তুলনায় প্রাঙ্গন যুগ; ‘প্রায়শ্চিত্য’ তে চব্বিশ ‘রাজা’য় ছাব্বিশ, ‘অচলায়তন’-এ তেইশ আর ‘ফাল্গুণী’তে গান আছে তিরিশটি।

‘মুক্তধারা’ যুগে গানের এই অপ্রতুলতা একেবারে কারণ হীন ছিলনা। একদিকে যেমন এ সময় অধ্যাত্ম-পক্ষ থেকে মুক্ত, অন্যদিকে তেমনি এর সমকালে ১৯২৩ সালে তৈরী হল ‘বসন্ত’পালানাট্য- অথবা বলা যেতে পারে পালা গান। তারপর অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে আমরাপাই ‘শেষবর্ষন’ ‘নবীন’ বা ‘শ্রাবণ ধারা’। এই রচনাগুলিতে কবি তার গানকে ক্রমে একটা ব্যবহারিক মুক্তি দিতে পেরেছিলেন।

যে প্রমোদের প্রয়োজন অনেক সময়ে সংগীতকে নাটকের অন্তর্গত করে, তাকে তৃপ্ত করবার মতো অন্য এক আয়োজন দেখা দিল রবীন্দ্র রচনার সমৃদ্ধভান্ডারে। ফলে তার জীবনের অবসান ভার্সে ‘বসন্ত’ ‘নবীন’ প্রমুখ গীতিসম্ভার একদিকে গানকে নাটক থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত করে একটা গীতি ‘প্রয়োগে পরিণত করেছে।

অন্যদিকে নাচ-গান অভিনয় বহুযোগে যে পূর্ণাঙ্গ নাটক রবীন্দ্র কল্পনার গভীর আদেশে ধরা দিয়েছিল তার রূপ দেখা দিল ‘নটীর পূজা’র মধ্য দিয়ে নৃত্যনাট্যাবলীতে। সংলাপের অন্তর্গত যে সুরের ইঙ্গিত আমরা পুরানো আলোচনায় লক্ষ করেছি, সেই সুরকে গান এবং কথার মধ্যে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় তাঁর রচনা প্রতিদিন ছিল যেন দ্বিধাগ্রস্থ।

 

 

কিন্তু জীবনের উপাত্ত, সেই দ্বিধাদূর হলো, সম্পূর্ণ সুরারোপে, সম্পূর্ণ গীতিব্যবহারে এবং তাঁর নাটকের সংলাপ হল সম্পূর্ণ গান আর সেই গানের অভিনয় হলো পূর্ণাঙ্গ নৃত্য। রবীন্দ্রনাটকে গান এতোদিনে লক্ষ্যের সমুদ্রে পৌঁছেছিল। কুল থেকে তার গানের তরী ভেসে গেল।

আরও দেখুন :

Exit mobile version