গীতিনাট্যের কাব্যবস্তু

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় গীতিনাট্যের কাব্যবস্তু

গীতিনাট্যের কাব্যবস্তু

 

গীতিনাট্যের কাব্যবস্তু

 

গীতিনাট্যের কাব্যবস্তু

কাব্যের মানদন্ডে গীতিনাট্যের বিচার যুক্তিযজ্ঞত নয়। কেননা এখানে গীতরসই মুখ্য, কাব্যরস নয় । রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে বলেছেন- ‘বাল্মীকিপ্রতিভা পাঠযোগ্য কাব্যগ্রন্থ নহে…।’ গীতিনাট্যগুলি সম্বন্ধে সামগ্রিকভাবে একথা প্রয়োজ্য। গান ও কবিতার মূল পার্থক্য হচ্ছে- গানে শব্দগত ধ্বনি ছাড়াও স্বরধ্বনির মিলন ঘটে এবং তারই ফলে প্রসঙ্গান্তরে আনন্দবর্ধন বা অভিনবগুপ্ত যাকে ‘রসধ্বনি’ বলেছেন তারও উদ্ভব হয়।

কথা ও সুরের এই যোগপতনের কারণে পুরোমাত্রায় কথা বা শব্দগত ধ্বনির মধ্যেই ছন্দ বা তাল আবদ্ধ রাখা প্রয়োজন হয় না। এই কারণেই গান ঠিক সুনিয়মিত ছন্দে রচিত পাঠযোগ্য কবিতা নয়। জীবনের প্রভাত-লগ্নে যা কিছু তিনি অনুভব করেছিলেন- যে অভিজ্ঞতা তিনি প্রথম জীবনে লাভ করেছিলেন- ব্যথা, বেদনা, শিল্পানুভূতি, সাহিত্যপাঠ, সুখদুঃখ- এসবই নবির সারাজীবনের সমস্ত সাহিত্যের সম্পদ ও উপাদানরূপে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিল।

বাল্মীকিপ্রতিভা থেকে মায়ার খেলা পর্যন্ত এই পর্বটিকে সংকুচিত করে এর মধ্যে কবিমানসের সন্ধান করতে গেলে ঐ কথাগুলিই মনে পড়ে। দ্বিতীয় দৃশ্য থেকেই বাল্মীকির মধ্যে একটা ব্যাকুলতা জেগেছে:

এ কেমন হল মন আমার।

কী ভাব এ যে কিছুই বুঝিতে যে পারি নে।

পাষাণ হৃদয় গলিল নেরে।

কেন আজি আঁখিজল দেখা দিল নয়নে!

কী মায়া এ জানে গো

পাষাণের বাঁধ এ যে টুটিল,

সব ভেসে গেল গো, চরে ভেসে গেল গো-

মরুভূমি ডুবে গেল করুণার প্লাবনে।।

এবং-

কোথায় জুড়াতে আছে ঠাই, কেন প্রাণ কাঁদে রে!

বাল্মীকি-চরিত্রের অনুরূপ চরিত্র কিভাবে পরবর্তীকালে বিভিন্ন নাটকে দেখা দিয়েছে, ‘রূপান্তরের’ আলোচনায় সে কথা উল্লেখ করেছি। সে কথা স্মরণ করে বলতে পারি, আসলে এই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মানবজীবনের এক সত্যরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। পাপ সম্বন্ধে তাঁর অভিমত এই যে, আংশিকের প্রতি আসক্তিবশত: সমগ্রের প্রতি অন্যায় ।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

কালমৃগয়া এ গিক থেকে বাল্মীকি-প্রতিভার সঙ্গে তুলনীয় নয়। নাট্যরসের মতো ভাবের দিক থেকেও বিশেষ কোনো গভীরতা চোখে পড়ে না। সে দিক থেকে বরং মায়ার খেলা অনেক বেশী উল্লেখযোগ্য সামগ্রিকভাবে কবিকাহিনী, ভগ্নহৃদয়, নলিনীর ভাবগত স্বজাত্য ছাড়াও এই গীতিনাট্যের উপজীব্য প্রেম সম্বন্ধে কবির ধারণাটি উত্তরকালে নানা লেখায় রূপায়িত হয়ে উঠেছে।

এই কাহিনীর উপজীব্য- প্রেমের বিচিত্র রূপের স্বরূপ উদ্ঘাটন। অমর, শান্তা ও প্রমদাকে ভালোবেসেছে। প্রশ্ননাও অমরকে ভালোবাসে, তবে সে ভালোবাসা চপল; নিজেকে সখীদের কাছ থেকে লুকিয়ে র খতে চায়। স্বভাবতই প্রত্যাখ্যান ভেবে অমরকে ফিরতে হয় শাস্তার কাছে। শেষে প্রমদা যখন আবার দুজনের মাঝে গিয়ে উপস্থিত হল- অমর ও শান্তার কাছে তার ‘গোপন কথা’ প্রকাশিত হল। গভীর বেদনা বুকে নিয়ে ফিরতে হলো তাকে।

প্রমদা তাই মধ্যবর্তিনী, বিচিত্র প্রেমের মূর্তিমতী। শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ বিশীও এই গীতিনাট্যের আলোচনা-প্রসঙ্গে অন্য দিক থেকে বলেছেন যে, এখানে প্রেম সম্বন্ধে পরিণত ধারণার পূর্বাভাস ফুটে উঠেছে। সে ধারণা হচ্ছে প্রথমতঃ প্রেমের পরিপূর্ণতার জন্যে বিরহ ও দুঃখের প্রয়োজন আছে। দ্বিতীয়ত প্রেমের মোহ বা রোমান্সের চেয়ে মানুষের পক্ষে আশ্রয়ের প্রয়োজন বেশী। এই মন্তব্য গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ।

বস্তুতঃ কবির প্রেমচেতনাই মায়ার খেলা গীতিনাট্যে ফুটে উঠেছে। প্রেম বিচিত্র বলেই বাইরে থেকে তার সবটুকু পরিচয় পাওয়া যায় না। কেননা মনের অন্তরালে সে তার আপন বাণী লিখে যায়। এই বিচিত্র প্রেমজালে নরনারী ধরা পড়ে; ধরা দিতে বাধ্য হয়।

 

গীতিনাট্যের কাব্যবস্তু

 

অবশেষে একটু একটু করে সেই রহস্যের আবরণ সরে যেতে থাকে, তখন সেই প্রান্তভূমিতে দাঁড়িয়ে পুলক ও বেদনায় অভিভূত হয়ে পরস্পরকে চিনতে পারে। এই তো প্রেমের স্বরূপ, প্রেমের বিচিত্রতা! আর বিশ্ব জুড়ে এমনিই ফাঁদ পাতা রয়েছে প্রেমের-

প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে-

কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে!

আরও দেখুন :

Leave a Comment