আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় গীতিনাট্যের গায়ন পদ্ধতি
গীতিনাট্যের গায়ন পদ্ধতি
গীতিনাট্যের গায়ন পদ্ধতি
গীতিনাট্যের প্রধান উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নাটকটি আদ্যন্ত গানে রচিত এবং গেয়ে অভিনয় করা হয়। গানের ভিতর দিয়ে নাট্যবস্তুকে রূপ দেওয়াই হচ্ছে গীতিনাট্যের মূল কথা। নাটকের সংলাপ গদ্যে অথবা কখনো ছন্দোবদ্ধ পদ্যে (কবিতায়) রচিত হয়ে থাকে। দুইয়েরই সাধারণ ধর্ম অভিনয়। পার্থক্য হচ্ছে একটি সুরহীন বাণীর আশ্রয় নেয়, অপরটি সুরান্বিত বাণীকে আশ্রয় করে একটি সাধারণ ভাষা, অপরটি সুরসমন্বিত ভাষা।
নাটকের সংলাপ গদ্যে অথবা পদ্যে, যেভাবেই রচিত হোক না কেন, তার লক্ষ্য মনের ভাবকে প্রকাশ করা এবং সেইজন্যেই বলতে পারি, সংলাপের মূল্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বাকরীতি বা কথাবলার ঢংটি ফুটিয়ে তোলা; এই অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাকে রূপদান করতে হয়। মানবমনের অন্তরীণ রহস্যকে রূপ দেওয়াই হচ্ছে অভিনয়ের লক্ষ্য। নানাভাবে আমরা নিজেদের প্রকাশ করে থাকি।
গীতিনাট্যে সংলাপের ভূমিকা নেয় সঙ্গীত। সাধারণ অভিনয়ের সব রীতিই তার মধ্যে বজায় রাখতে হয়, শুধু নাট্যবিষয়টি গানের (বা সুরের) মধ্যে দিয়ে অভিব্যক্ত হয়। গীতিনাট্য রচনা করতে গিয়ে সঙ্গীতকে কিভাবে গীতিনাট্যের কাজে লাগিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ তা নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন।
হার্বার্ট স্পেনসরের মতবাদ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন ভাবিয়াছিলাম এই মত-অনুসারে আগাগোড়া সুর করিয়া নানা ভাবকে গানের ভিতর দিয়া প্রকাশ করিয়া অভিনয় করিয়া গেলে চলিবে না কেন।
অতঃপর তিনি কথকতার প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং অনতিপরেই মূল কথাটি বললেন- ছন্দ হিসাবে অমিত্রাক্ষর ছন্দ যেমন, গান হিসাবে এও সেইরূপ- ইহাতে তালের কড়াক্কড় বাঁধন নাই, নাটকের সংলাপ একটা লয়ের মাত্রা আছে- ইহার একমাত্র উদ্দেশ্য কথার ভিতরকার ভাবাবেগকে পরিস্ফুট করিয়া তোলা, কোনো রাগিনী বা তালকে বিশুদ্ধ করিয়া প্রকাশ করা নহে।
ভাবাবেগকে পরিস্ফুট করে তুলতে সঙ্গীতের ক্ষমতা কতখানি বা গীতিনাট্যের অভিনয়ের লক্ষ্য কী, নানা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে যে, নাটকের সংলাপ আমরা যখন রোদন করি তখন দুটি পাশাপাশি সুরের মধ্যে অতি অল্প ব্যবধান থাকে এবং স্বরগুলি কোমল সুরের উপর দিয়ে গড়িয়ে যায়, সুর বিলম্বিত হয়ে ওঠে। তার বিপরীত হাসি।
হাসিতে কোমল সুর লাগে না তো বটেই, উপরন্তু তালে রীতিমতো ঝোঁক লাগে। দ্রুত তাল হচ্ছে সুখের ভাব প্রকাশের অঙ্গ। ভাবের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তালেও পরিবর্তন ঘটে। এরই সূত্র ধরে গীতিনাট্য সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম উল্লেখযোগ্য। তাঁর অভিমত এই যে, গীতিনাট্য আগাগোড়া সুরে অভিনয় করতে হয় বলে স্থানবিশেষ তাল থাকা দরকার। তা না হলে অভিনয়ের স্ফূর্তি বা পূর্ণ প্রকাশ সম্ভবপর নয়।
এদিক থেকেই গীতিনাট্যের গায়কী বা গায়ন-পদ্ধতির আলোচনা বিধেয়। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্যগুলি এই রীতিরই অনুসারী। ঊনিশ শতকের অন্যান্য পূর্ণাঙ্গ গীতিনাট্যগুলি কিভাবে পরিবেশন করা হতো, তার আলোকপাত অন্যত্র করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্যগুলি তার ব্যতিক্রম।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভালো, অভিনয়ের উৎকর্ষ অথবা অপকর্ষ শিল্পীর বা পরিচালকের দক্ষতার তারতম্যের উপর নির্ভরশীল; স্বভাবতই যা প্রত্যক্ষভাবে অভিনয়ের ব্যাপার। লিখিতরূপে তার সম্পূর্ণ প্ৰকাশ সম্ভব নয় । নিম্নে কতিপয় গীতিনাট্যের গায়ন পদ্ধতির পর্যালোচনা করা হলো।
বাল্মীকিপ্রতিভা
বল্মীকিপ্রতিভা গীতিনাট্যের গায়কীর মূল কথা হচ্ছে গানগুলি যেহেতু অভিনয়ের ঢঙে গাইতে হয়, সেজন্যই সাধারণ গায়ন পদ্ধতির বাতিক্রম ঘটে অর্থাৎ গানগুলি বিনাতালে কিংবা ভাঙ্গা তালে গাওয়া যায়। গীতিনাট্যের গানগুলিও অনুরূপভাবে পরিবেশন করতে হয়। এই গীতিনাট্যের গানগুলি নিবলিখিতভাবে ভাগ করা যায়:
প্রথম দৃশ্য
১. সহে না সহে না কাঁদে পরাণ
২. আঃ বেচেছি এখন
৩. আজকে তবে মিলে সবে
৪. এখন করব কী বল
৫. শোন তোরা তবে শোন
৬. ওই মো করে বুঝি গগনে
৭. এ কী ঘোর বন
৮. পথ ভুগেছিস সত্যি বটে
দ্বিতীয় দৃশ্য
১. রাঙ্গাপদ পদ্মযুগে প্রণমি
২. গো দেখো কো ঠাকুর
৩. নিয়ে আর কৃপাণ
৪. কী দোমে বাঁধিলে আমায়
৫. এ কেমন হলো আমার
৬. এ কেমন হলো আমার
৭. শোন্ তোরা শোন্ এ আদেশ
তৃতীয় দৃশ্য
১. ব্যাকুল হয়ে বনে বনে
২. ছাড়বা না ভাই, ছাড়ব না ভাই
৩. রাজা মহারাজা কে জানে
৪. আছে তোমার বিদ্যেসাধ্যি জানা
৫. আঃ কাজ কী গোলমালে
৬. হা, কী দশা হলো আমার
৭. অহো! আস্পর্ধা একি তোদের
৮. আয় মা আমার সাথে
চতুর্থ দৃশ্য
১. কোথায় জুড়াতে আছে ঠাঁই
২. কেন রাজা ডাকিস কেন
৩. চল্ চল্ ‘ভাই জ্বরা করে যাই
৪. প্রাণ নিয়ে তো সটকেছি রে
৫. বলব কী আর বলব খুড়ো
৬. সর্দার মগায় দেরি না সয়
৭. রাখ রাখ ফেল ধনু
৮. তোর দশা রাজা ভালো তো নয়
পঞ্চম দৃশ্য
১. জীবনের কিছু হলো না হায়
২. দেখ দেখ, দুটো পাখি
৩. কী বলিনু আমি
৪. এ কি এ, এ কি এ, , স্থিরচপলা
৫. নমি নমি ভারতী
৬. শ্যামা, এবার ছেড়ে চলেছি মা
ষষ্ঠ দৃশ্য
১. কোথা লুকাইলে
২. কেন গো আপন মনে
৩. কোথায় সে ঊষাময়ী প্রতিমা
৪. বাণী বাণী পাণি
৫. এই যে হেরি গো দেবী
মায়ার খেলা
কালমৃগয়ার আলোচনার প্রারম্ভে পূর্বের উল্লেখ করা হয়েছে, মায়ার খেলা গীতিনাট্যের গানগুলির তাল-নির্দেশ দেওয়া আছে। গায়কীর দিক থেকে বলা যায়, এই গীতিনাট্যের অভিনয়ের সময় তালের শাসন মেনে চলা দরকার। তালের দিকে লক্ষ্য রেখে কতিপয় গান উল্লেখ করা হচ্ছে :
১. মোরা জলে স্থলে- একতালা
২. পথহারা তুমি- একতালা
৩. জীবনে আজ কি- কাওয়ালি
৪. কাছে কাছে খেমটা
৫. যেমন দক্ষিণে বায়ু- কাওয়ালি
৬. মনের মতো করে- খেমটা
৭. সখী, সে গেল- খেমটা
৮. প্রেমের ফাঁদ পাতা- ঝাঁপতাল
৯. যেয়ো না, যেয়ো না- ঝাঁপতাল
১০. কে ডাকে- কাওয়ালি
১১. এসেছি গো এসেছি খেমটা
১২. ওকে বলো সখী খেমটা
১৩. মিছে ঘুরি— ঢিমেতেতালা
১৪. তারে দেখাতে পারি নে ঝাঁপতাল
১৫. সখা, আপন মন- রূপক
১৬. আমি জেনে শুনে- রূপক
১৭. ভালোবেসে যদি সুখ- কাওয়ালি
১৮. দেখো চেয়ে ঝাঁপতাল
১৯. সুখে আছি, সুখে আছি- খেমটা
২০. ভালোবেসে দুখ সেও একতালা
২১. ওই কে গো হেসে- কাওয়ালি
২২. দূরে দাঁড়ায়ে- তালফেরতা
২৩. প্রেমপাশে ধরা খেমটা
২৪. ওগো, দেখি আঁখি- একতালা
২৫. ওকে বোঝা গেল না- কাওয়ালি
গীতিনাট্যে সমবেত গানগুলির (মায়াকুমারীগণের ও সখীগণের) গায়নপদ্ধতিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাল্মীকি-প্রতিভার সমবেত গানগুলি কোরাস পদ্ধতিতে গাওয়া। কাল- মৃগয়াতে ঝিম্ ঝম্ ঘন ঘন রে’ গানটির আলোচনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। এই গীতিনাট্যে ‘মোরা জলে স্থলে কত ছলে’ গানটির নির্দেশ মূল গ্রন্থে দেওয়া আছে।
‘সুখে আছি সুখে আছি’ কিভাবে প্রমদা ও সখীগণ পালা করে গেয়েছে, তাও লক্ষ্য করার মতো। এই গানটির ‘মধুর জীবন মধুর রজনী’ থেকে শেষের অংশটুকু বিলম্বিত লয়ে গাইতে হয়। প্রথমে প্রমদা একা গাইবার পর, সকলে পালা করে গেয়ে থাকে।
১. সুখে আছি সুখে আছি সখা, আপন-মনে – প্রমদা
২. সুখে আছি সুখে আছি সখা আপন মনে এবং কিছু চেয়োনা – সখীগণ
৩. দুরে যেয়ো না – প্রমদা
৪. শুধু চেয়ে দেখো – সখীগণ
৫. শুধু চেয়ে দেখো – প্রমদা
৬. শুধু ঘিরে থাকো – সখীগণ
৭. শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি – প্রমদা
৮. আপনমনে – সখীগণ
এরই পাশাপাশি ‘এস’ ‘এস’ বসন্ত ধরাতলে সমবেত গানটি স্মরণযোগ্য। এ গানটিও পালাক্রমে স্ত্রীগণ, পুরুষগণ এবং স্ত্রীগণ ও পুরুগণ গেয়ে থাকে। সবশেষে উল্লেখযোগ্য নিবলিখিত গানগুলি বিনা তালে গাইলে ভালো হয়।
১. আজি আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে
২. কেন এলি রে, ভালোবাসিলি
৩. আর কেন, আর কেন
এই আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তেই আসতে পারি যে, গীতিনাট্যের এই গায়ন-পদ্ধতি বা গায়কী অভিনয়কেন্দ্রিক এবং তা যে বাংলা গীতিনাট্যের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে অভিনব, তাও স্বীকার্য। এই গায়কীর মধ্যে সঙ্গীতের একটি নতুন রূপ দেখতে পাচ্ছি।
গীতিনাট্যের এই সাফল্য পরবর্তীকালে নৃত্যনাট্যের আঙ্গিককে প্রভাবিত করছে। গান যে নাটকীয়তাসূত্রে বিভিন্ন ভাব প্রকাশে এবং চরিত্রের রূপায়ণে সক্ষম, গীতিনাট্যের এই অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ নৃত্যনাট্যের মধ্যে আর একভাবে ব্যবহার করেছেন।
আরও দেখুন :