আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের পার্থক্য আলোচনা
গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের পার্থক্য আলোচনা
গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের পার্থক্য আলোচনা
যে কোন শিল্পেরই দুটি দিক। ১. বিশিষ্টতা ও ২. বহুর সঙ্গে মিলনের সম্ভাবনা। সাহিত্য, সঙ্গীত, ভাস্কর্য প্রত্যেকটি সুকুমার শিল্পেরই এমন একটি করে স্বতন্ত্র রয়েছে যে, তারা সবাই আলাদা ধারায় অনন্য। প্রত্যেকটি আশ্রয় রয়েছে এক একটি উপায় উপকরণকে। প্রত্যেকের একটাই উদ্দেশ্য- রূপায়ন। অর্থাৎ কোন একটি রূপকে প্রকাশ করা।
এই রূপ ও প্রকাশের পথে চলেছে গান, নৃত্য, নাটক, সাহিত্য। প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট ধারা নির্দিষ্ট গতিতে নির্দিষ্ট পথে চলতে চলতে এক সময় সবাই একটি প্রাপ্ত ভূমিতে এসে উপস্থিত হয়। আর সেই প্রান্তভূমির আদিতে আছে গীতিনাট্য ও শেষ প্রান্তে নৃত্যনাট্য। বাইরে থেকে এই সন্নিবেশ অর্থহীন ও তাৎপর্যহীন বলে মনে হলেও একথা স্পষ্ট যে, প্রথমে যদি গীতিনাট্যকে না পাওয়া যেত তাহলে হয়তো পরবর্তীতে নৃত্যনাট্যের বর্তমান রূপটি পাওয়া যেতো না।
গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য এক অবিভাজ্য ছন্দময়োতার প্রকাশ। দুই-ই আদ্যন্ত গানে রচিত। তবুও তাদের মধ্যে কতকতগুলি মূলগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন :
রচনার উদ্দেশ্য
গীতিনাট্যের গানগুলি যেমন বিশেষ ভাবে অভিনয়ের জন্য রচিত নৃত্যনাট্যের গানগুলি তেমন নৃত্যাভিনয়ের জন্য। এখানেই নৃত্যনাট্যের গানের বৈশিষ্ট্য ।
গায়কী
গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের মধ্যে গায়কীর পার্থক্য আছে। গীতিনাট্যের গান অভিনয় যোগ ও ভাবানুযায়ী গাইতে হয় বলে আগাগোড়া তালে গাওয়া চলে না। আর নৃত্যনাট্য ঠিক তার বিপরীত অর্থাৎ আগাগোড়া তালে গাইতে হয়। নৃত্যের জন্যই এই তাল বজায় রাখতে হয়। এই লয় ও ছন্দের মধ্যেই রয়েছে নাট্য স্বকীয়তা।
রচনার সময়
গীতিনাট্য শিক্ষানুবিশীর যুগে রচিত এবং নৃত্যনাট্য শিক্ষানুবিশীর যুগে রচিত এবং নৃত্যনাট্য রসানুভূতির যুগে রচিত তাই তাদের ভাব সম্পূর্ণ আলাদা ।
পাশ্চাত্যের সাথে তুলনা
গীতিনাট্য অপেরা ধর্মী ও নৃত্যনাট্য ব্যালেধর্মী ।
উপাদান
গীতিনাট্যের প্রধান উপাদান সংগীত ও অভিনয় এতে নৃত্যের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু নৃত্যনাট্যের ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন নাচ। নাচ ছাড়া এর প্রকাশ কোন ভাবেই সম্ভব না।
সুরের নাটিকা
নৃত্যনাট্যগুলি পুরোপুরি গীতিনাট্য হলেও একে ‘সুরের নাটিকা’ বলা যায় না। কারণ সঙ্গীত ও নৃত্য পরস্পর পরিপূরক হলেও নৃত্যনাট্যে নৃত্য অপরিহার্য অঙ্গ। আর গীতিনাট্য সঙ্গীত ও অভিনয়ের নাটক প্রাধান্যতা গীতিনাট্যগুলো পয়ারের কাঠামোতে রচিত হয় আর নৃত্যনাট্যে মাত্রাবৃত্তের প্রাধান্য বেশী।
অন্যগানের প্রভাব
গীতিনাট্যতে পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এতে দেশীয় লৌকিক সুরের পভাব খুব কম। কিন্তু নৃত্য নাট্যে কীর্তন, বাউল ইত্যাদির প্রভাব আছে যথেষ্ট পরিমানে।
মিশ্র রাগ-রাগিনীর ব্যবহার
গীতিনাট্যের যুগেই মিশ্র রাগ-রাগিনীর ব্যবহার দেখা গেছে কিন্তু নৃত্যনাট্যে তা রয়েছে এক স্বতন্ত্র প্রকৃতির রূপায়ণে ও প্রকরণে।
কলা-কুশলীদের ভূমিকা
গীতিনাট্যে কলাকুশলীদের গানের সাথে সাথে অভিনয় (মঞ্চেই) করতে হয়। কিন্তু নৃতা নাট্যে সঙ্গীত শিল্পী ও যন্ত্রীগণ মঞ্চের পিছনে থাকে এবং নৃত্যশিল্পীরা নৃত্যের মাধ্যমে মঞ্চে অভিনয় করেন।
শিথিল বাক্যবন্ধের ব্যবহার
নৃত্যনাট্যে শিথিল বাক্যবন্ধের ব্যবহার আছে। গীতিনাট্যে ছিলো কিন্তু নৃত্যনাট্যে তা এত বেশী যে একে গদ্যছন্দ বা Fee verse বলা হয়। যেমন :
এ নতুন জন্ম, নতুন জন্ম
নতুন জন্ম আমার
সেদিন বাজলো দুপুরের ঘন্টা
ঝা ঝা করে রোদ্দুর। ইত্যাদি
তেহাই রীতি
নৃত্যনাট্যে কোন বিশেষ আবেগ প্রকাশের জন্য একটি শব্দ অনেক সময় তিনবার উচ্চারিত হয়। নৃত্যের তেহাই থেকে সম্ভবত এটি এসেছে। যেমন :
নৃত্য নাট্য ‘শ্যামা’ থেকে
ধিক্ ধিক্ ধিক্
যাও যাও ফিরে যাও ফিরে যাও বীর
কিন্তু গীতিনাট্যে এই রকম তিনবার উচ্চারণের কোন ব্যাপার নেই।
সুর সমাবেশ
সুর সমাবেশের দিক থেকে পার্থক্য নিরূপণ করতে গেলে দেখা যাবে- নৃত্যনাট্যের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবগুলি গানের মধ্যে একটা সুর প্রবাহই যেনো বিভিন্নভাবে উচ্ছলিত হয়েছে। একটি গানের রেশ ধরেই যেন আরেকটি বা পরের গানটি রচিত। অর্থাৎ গানের সুরে একটা অখন্ড ঐক্য আছে এর সংলাপের ক্ষেত্রেও তাই।
আবেগের উচ্চতা ও নিবতার মধ্যে দিয়ে কিভাবে নাটকীয়ভাব সৃষ্টি করতে হয় নৃত্যনাট্যের গানগুলি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গীতিনাট্যের সুর সমাবেশের মূল বিশেষত্ব গানগুলি রাগ-রাগীনির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও নাটকের প্রয়োজনে নতুনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
এখানে অনেক মিশ্র ও অপ্রচলিত রাগ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন কুকুড় লুম, গারা, ললিত যোগিয়া, গৌড় সারং ইত্যাদি। গীতিনাট্যে বস্তুত গানের ভাবের দিকে লক্ষ্য রেখেই সুরারোপ করা হয়েছে এবং তাল তার সাহায্য করেছে।
নৃত্যের সূত্রে নাট্যের মালা
নৃত্যনাট্য গুলোকে নৃত্যসূত্রে নাট্যের মালা বলা যায়। নৃত্য ছাড়া এর রূপায়ণ কোনভাবেই সম্ভব নয়। গীতিনাট্য একমাত্র গানেরই প্রাধান্য।
মঞ্চ সজ্জা ও অভিনয়
নৃত্য নাট্যের মঞ্চকে মূলত দুইভাবে ভাগ করা হয়। সামনের অংশে নৃত্যশিল্পীরা। আর রঙ্গীন কাপড়ে ঘেরা পেছনের অংশে শিল্পী ও যন্ত্রীরা বসেন। কিন্তু গীতিনাট্যের মঞ্চের কোন বিভাগ নেই । তবে পশ্চাত্যের বাস্তবধর্মীতার দিকে দৃষ্টিপাত থাকে ।
রূপসজ্জা
গীতিনাট্যের রূপসজ্জার পাশ্চাত্যের প্রভাব যেমন, পোশাকে বনেদিপনা ও জৌলসের ছাপ। অন্যদিকে নৃত্যনাট্যের বিশেষ করে মণিপুরী ধরণ গৃহীত।
আরও দেখুন :