আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় জননী কল্পনায় স্বদেশরূপ
জননী কল্পনায় স্বদেশরূপ
জননী কল্পনায় স্বদেশরূপ
“আমি তোমারি মাটিরও কন্যা, জননী বসুন্ধরা
তবে আমার মানবজন্ম কেন বঞ্চিত করা ।
এমনি বহুবিধ রূপ কল্পনার মধ্যদিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশকে অবগাহন করেছেন। এক অখণ্ড প্রেম চেতনায় রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেম তথা স্বদেশচেতনা আবৃত। অনুভূতির আলোকে তিনি দেশজননীর যে হিরণ্ময়ী রূপ অবলোকন করেছেন সেখানে দেশমাতাকে বিশ্বমাতার অঙ্গীভূত রূপে কল্পনা করেছেন।
“হে বিশ্বদেব মোর কাছে তুমি
দেখা দিলে আজি কী বেশে
মিলে গেছ ওগো বিশ্বদেবতা
মোর সনাতন স্বদেশে।
স্বদেশকে মাতৃরূপে কল্পনা রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেমের গানে এক অনন্য উদাহরণ। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনপর্বে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ২৫টি গান। গীতা চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ এই ২৫টি গানে ৪৮ বার ‘মা’ শব্দটির ব্যবহার করেছেন। বহুবিধ উপমায় তিনি দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেন।
এই ‘মা’ কখনো সম্মিলনের ডাক দিয়েছে। দেশের সকল জনগণ তখন ‘মা’-এর সন্তান। ‘মা’-এর কাছে সকল সন্তান সমান। ‘মা’-এর উদ্দেশ্যে সদা ভাইয়ের পাশে ভাইয়ের অবস্থান। তাই কবি স্বদেশ “মাতাকে বাংলার চিরায়ত শাশ্বত মাতৃরূপে বর্ণনা করেছেন। কারণ এই মাটির মায়ের সন্তান ‘মা’কে ছেড়ে দূরে থাকতে পারে না। ‘মা’-এর অসম্মান মেনে নিতে পারে না।
‘মা’-এর জন্য সকল বাধা অতিক্রম করে এক হবার বাসনাকে পণ করে এগিয়ে যাবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বাংলা মায়ের সন্তানেরা। কবি স্বদেশকে ‘মা’ বলতে আরামবোধ করেন। কারণ এর থেকে সুন্দর শব্দ আর হয় না। এ শব্দের উচ্চারণে যে প্রশান্তি তা অন্য কোনো শব্দে নেই। এই শব্দে যে স্নেহ-মমতা আর ভালোবাসা মাখামাখি করে আছে তা অন্য কোনো শব্দে এমন করে নেই।
তাই কবি বলেছেন: প্রাণের মাঝে থেকে থেকে আয় বলে ওই ডেকেছে কে যেন গভীর স্বরে উদাস করে আর কে কারে ধরে রাখে? একদিকে কবি মায়ের মুখের বাণীর সুধায় আত্মহারা বিগলিত। তার স্নেহ-মায়ামাখা আঁচলে ছায়াসিক্ত করে গ্রামবাংলার বৃক্ষলতা আবার সেই আঁচলেই বিশ্বলোক অবলোকন করেন কবি, বিশ্বমায়ের আঁচল তলে মাথা ঠেকান পরম শ্রদ্ধায়।
কবি স্বদেশমাতাকে কখনো স্থান দিয়েছেন অতি সাধারণ শাশ্বত মাতৃরূপে। আবার সেই মা-কেই তিনি সোনার মন্দিরে ঠাঁই দিয়েছেন। কবি মনে এ যেন এক চিরন্তন খেলা। কখনো তিনি দুঃখিনী ‘মা’-এর ভাঙা ঘরে একলা পড়ে থাকার কষ্টে কাতর, আবার সেই মায়ের ভুবন মনোমোহিনীরূপে মুগ্ধ। জীবনের স্বার্থকতা উপলব্ধি সেই মাতৃক্রোড়ে জন্ম লাভে। কবি সব ছাড়তে পারেন কেবল মায়ের চরণ ছাড়া।
তাই কবি বলেছেন : ‘মা গো আমি তোমার চরণ করব শরণ: / আর কারো ধার ধরব না মা-ছেলের অতি সাধারণ কথোপকথনেও কবি বেঁধেছেন মা’কে। অনন্য কথা-বার্তায় দৃশ্য হয়ে ধরা দিয়েছে দীন দরিদ্র সন্তানের আহাজারি। প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ‘মা’-কে : ‘মা কি তুই পরের দ্বারে পাঠাবি তোর ঘরের ছেলে?/ তারা যে করে হেলা, মারে ঢেলা, ভিক্ষাঝুলি দেখতে পেলে।
এমনি বহুবিধ কথোপকথনে মা-সন্তানের যে নিবিড় সম্পর্ক রবীন্দ্রনাথ সেই সম্পর্কের আবেগকে ধরতে চেয়েছিলেন তাঁর গানের স্বদেশচেতনাকে ত্বরান্বিত করতে। পৃথিবীর যেকোনো জাতি এমন কি পশু- পাখির কাছেও সবচেয়ে আপন ও আদরের সম্পর্ক মা-সন্তানের। স্বজাতিকে দেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে তাই কবি বারবার এই সম্পর্কের প্রতি, ‘মা’ ডাকটির প্রতি গভির আবেগে আশ্রয় নিয়েছেন।
হিন্দুমেলা, সঞ্জীবনী সভায় রচিত স্বদেশিগানের সময়কাল থেকে শুর করে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্যন্ত বিশেষত রবীন্দ্রনাথের স্বদেশের গানের ভিতর সমগ্র জাতির এক প্রকার নির্ভরতা, বিশ্বাস জন্মেছিল। রবীন্দ্রনাথ যে সুর বা যে গানই বাঁধতেন তাই যেন সকলের বুকে স্বদেশ, স্বজাতির মুক্তির জন্য বহুবিধ অত্যাচারের প্রতিকার বা সমাধানের পথ হয়ে দেখা দিত।
তাঁর রচনায় শক্তি বা বিদ্রোহ প্রকাশ না করে সংযত করুণা ও মমতা দিয়ে গানের ভিতরের মর্মবাণী তিনি মানুষের অন্তরে পৌঁছতে চেয়েছিলেন। সর্বত্রভাবে তিনি কতটা সফল তা আমরা এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনায় স্পষ্টই দৃষ্টান্ত পাই। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্যায়ের প্রতিটি গানে বাংলার রূপকে যে মহিমায় তুলে ধরা হয়েছে তাতে স্বদেশের প্রতি নতজানু হতে বাধ্য আমরা প্রতিজন।
দেশপ্রেমকে জাগ্রতকরণে আমরা পাই তাঁর সমসাময়িক আরো কয়েকজন বিশিষ্ট গীতিকবির নাম। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন ও কাজী নজরুল ইসলাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা সকলেই স্বদেশপর্যায়ের গান রচনায় স্বদেশের প্রতি অনুরাগ বা চেতনা জাগ্রতকরণে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গেছেন।
আরও দেখুন :