জাগরণী গানে স্বদেশচেতনা

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় জাগরণী গানে স্বদেশচেতনা

জাগরণী গানে স্বদেশচেতনা

 

জাগরণী গানে স্বদেশচেতনা

 

জাগরণী গানে স্বদেশচেতনা

জাগরণী বা উদ্দীপনার গান বলতে আমরা যা বুঝি তা প্রথম রচিত হয় মূলত হিন্দুমেলা আন্দোলনকে ঘিরে। সারা বাংলা জুড়ে হীনতা, দৈনতা ও স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় যে একটি চরম সময়ের মধ্যদিয়ে মুক্তিকামী জাতি জীবন অতিবাহিত করছিল সেই সময় এই সকল জাগরণী গান এর বৈভবে উজ্জীবিত করে, উদ্ভাসিত করে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে।

এক কথায় বলতে পারি, সকল স্বদেশচেতনার গানই জাগরণী গান, উদ্দীপনার গান। এখানে একটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো, ‘প্রাচীনকাল থেকে শিল্পের নৈতিকতা ও আদর্শের মধ্যে উদ্দীপনা ও জাগরণের নজির পাওয়া যায়। মধ্যযুগের বিভিন্ন ধর্মীয় ও লীলা পদাবলি, চৈতন্যের কীর্তন, রামপ্রসাদী, শাক্তগীতি, পঞ্চকবির গান এবং স্বদেশি গানেও জাগরণের পরিচর্যা প্রধান আকারে ছিলো। এমনকি আধুনিক গান কিংবা চলচ্চিত্রের গানেও এই নমুনা রয়েছে।

রজনীকান্ত সেনের স্বদেশপ্রেমের সকল গানেই আমরা একটি আত্মজাগানিয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করছি। তাঁর মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটি সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য একটি আত্মবোধ জাগানিয়া গান। জাগরণী গানের অর্থই ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিকে জাগিয়ে তোলা, স্বদেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। এদিক থেকে বিচার করলে রজনীকান্তের স্বদেশবোধের সকল গানই জাগরণীমূলক গান।

তথাপি কবি তাঁর গানের মধ্যদিয়ে ব্যক্তি জীবনের আত্মজাগরণীর বাণী শুধায়েছেন যার কয়েকটিতে মূলত স্বদেশচেতনাই পরিলক্ষিত হয়, ‘জাগাও পথিকে ও সে ঘুমে অচেতন। বেলা যায়, বহু দূরে পান্থ-নিকেতন। অসাধারণ জনশ্রুত এবং জনপ্রিয় এই গানটিতে ঘুমিয়ে থাকা অচেতনকে জেগে উঠবার তাগিদ দিয়েছেন কবি। অবহেলায় সুসময় বয়ে যায়। সময়ের কাজ তৎক্ষণাৎ না সারলে পরে তা আরো কঠিন অনুভূত হয়।

এই সকল সহজ সরল অনুভূতির ভিতর দিয়ে কবি জীবনের কঠিন সত্যকে এই গানটির মধ্যে উন্মোচন করেছেন। জীবনের পথ, স্বদেশ মুক্তির পথ, আলোর পথ মোটেই সহজসাধ্য নয়। এ পথ উন্মোচনে কবি সকলকে জেগে উঠতে আহ্বান করেছেন। আঁকাবাঁকা বিভীষিকাপূর্ণ পথ দিনের আলোতে পাড়ি দেয়া যতোটা কঠিন রাতের অন্ধকারে তা অসম্ভব হয়ে ওঠে।

তাই কবি উপযুক্ত সময়কে কাজে লাগাতে আহ্বান করেছেন ঘুমিয়ে পড়া, ঝিমিয়ে পড়া জাতিকে। যেমন-জাগ রে দাসদাসী। জাগ রে প্রতিবাসী।/দেখ রে কাছে আসি’ ফেটে যে গেল বুক । উমা মায়ের বিদায়বেলার মুহূর্তটিকে কবি অপূর্ব সুন্দর বর্ণনায় রূপায়িত করেছেন। তিনি প্রতি শরতে আমাদের এই বিদায়ের ক্ষত জানান দিয়ে যান। কবি ঘুমিয়ে থাকা সকল শুক-সারি, হংসী, ধেনুসহ প্রকৃতির সকল প্রাণকে জেগে উঠবার তাড়না দিয়েছেন।

কারণ একটি বছর পরে যখন আবার মা আসবেন তখন হয়তো এর অনেক কিছুই থাকবে না। তখন পুরাতনের বিদায়ের পর জন্ম নেবে নতুন প্রাণ। তাই কবি উমা মায়ের বিদায়ের এ ক্ষণকে একটি বছরের পূর্ণগ্রাস বলে বর্ণনা করেছেন। কবি বাস্তবিক জীবনের সামগ্রিক দুঃখ, জড়তা ও হাসি-আনন্দে ঘূর্ণায়মান, চক্রায়মান আবর্তনের পুনারম্ভ বলে চিহ্নিত করেছেন।

 

জাগরণী গানে স্বদেশচেতনা

 

দশমী তিথীকে তাই কবি এই চরমবেলায় সকল দাসদাসী, প্রতিবাসীসহ সকল রাজমহিষীকে এক হতে বলেছেন, জেগে উঠতে বলেছেন। কবির ভাষায়,

“জাগো জাগো, ঘুমায়ো না আর!

নব রবি জাগে.

নব অনুরাগে,

লয়ে নব সমাচার।

কবি গানের ভিতর দিয়ে বাস্তবিক জীবনের অলসতাকে ত্যাগ করে জেগে উঠতে বলেছেন। কবি একজন অত্যন্ত পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। চরম অসুখে যখন বিছানা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, কণ্ঠের সুরও বিধাতা কেড়ে নিয়েছিলেন তখনও কবির লেখনি থেমে থাকেনি। অসুস্থ রজনীকান্তকে দেখতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তাঁর নিজের জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি সংগীত রচনা করলেন তিনি জীবনের করুণ সুরধারায়, ‘আমায়, সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে গর্ব্ব করিতে চুর,/ যশঃ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য সকলি করেছে দূর। অক্লান্ত পরিশ্রমী এই কবি জাতিকে জাগিয়ে তুলবার আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর কাছে সময়ের মূল্য ছিলো অমূল্য।

ক্ষণজন্মা এই কবি যতদিন বেঁচেছিলেন প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছেন। অন্যকে উদ্বুদ্ধ করবার প্রয়াস দেখতে পাই তাঁর রচনার প্রায় সমগ্রটা জুড়ে ‘মোহ-রজনী ভোর হইলে, জাগ নগরবাসী/পূর্ব্ব গগনে সূর্য কিরণ, দুঃখ-তিমির-নাশী।

শুধু সময়কে নয় নারীকেও তিনি অমূল্যধন বিবেচনায় সম্মান করেছেন। তিনি নারী জাগরণীমূলক গান রচনা করেছেন। প্রতারণা, বঞ্চনা, কলঙ্ক আর অপবাদে নারী জাতি চিরকাল নিগৃহীত। কবি মাতৃস্নেহাকুল সেই নারীকে এই সকল অন্যায় অপবাদের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে বলেছেন।

কারণ যে কোনো সক্রিয় আন্দোলনে নারীকে সমউদ্যমে পুরুষের পাশে দাঁড়াবার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন কবি। যে সময়ের কথা বলছি তখন ঠাকুর বাড়ির কতিপয় উদাহরণ ছাড়া নারী ছিলো কেবল গৃহকার্য পটিয়সীর ভূমিকায় স্বীকৃত। রজনীকান্ত এই ক্ষুদ্র গণ্ডি ছেদ করে নারীকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিছেন। কবির ভাষায়,

“জেগে ওঠ দেখি মা সকল !

হের নব প্রভাতের নব তপন উজ্জল,

শুন জন কোলাহল ভরা আজি ধরাতন।

সীতা, সতী সাবিত্রী, দ্রৌপদী, খনা সকল মহিয়সী নারী গর্বের পথ দেখিয়েছেন। নারী বৈভবে সকল মানবের মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়। কবি বলেছেন, সেখানে কোনো একটি নারীকেও ঘুমে কাতর হলে চলবে না। শক্তিরূপিনীর আত্মবিস্মৃতা হলে চলবে না। দেশের মানুষের মুক্তির লক্ষে নব্রতে আত্মশক্তিকে অবলম্বন করে এগিয়ে চলতে হবে। কবি নারী জাতিকে বিদ্যা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হতে উৎসাহ দিয়েছেন। প্রতিটি নারীকে উপার্জনক্ষম হতে বলেছেন।

তবেই নিজের যথার্থ সম্মান প্রাপ্য হবে বলে কবি বিশ্বাস করেন। পরের স্কন্ধে চাপিয়া কেবল ঘরকন্যার দাসীপনাকে কবি ঘৃণা করতেন। কারণ কেবল পুত্র-কন্যা জন্ম দেওয়া আর ঘরের কোণে অশ্রুপাত করাই নারীর কর্ম হতে পারে না বলে কবি বিশ্বাস করতেন। তাঁর ভাষায়,

“জেগে রাখ, ভায়া নারী এল ভবে কি কাজ সাধিতে:

ওরা জমা বেঁধে নেয় সংসার জমি,

চষে নাক’ কভু আধিতে। ”

 

জাগরণী গানে স্বদেশচেতনা

 

কবি এই গানটিতে নারীকে জাগিয়ে তুলবার লক্ষ্যে কটাক্ষের তীর্যক বাণী ছুড়েছেন। সকল কর্মে পিছিয়ে পড়া নারী জাতিকে সম্মুখে এগোবার এ কবির প্রাণপণ চেষ্টা। দামী শাড়ি আর গহনায় মোড়া কোমল শরীরে বিদ্যা শিক্ষার প্রলেপ নেই বলে কবি চিন্তিত। তাই হাস্যরসযুক্ত কটাক্ষের ইঙ্গিতে কবি নারী জাতিকে তাদের ক্রিয়াকর্ম ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করার প্রয়াস পেয়েছেন গানটিতে ।

আরও দেখুন :

Leave a Comment