মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় জীবনে স্বদেশচেতনা

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় জীবনে স্বদেশচেতনা

মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় জীবনে স্বদেশচেতনা

 

মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় জীবনে স্বদেশচেতনা

 

মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় জীবনে স্বদেশচেতনা

বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও বাঙালির জাতীয় জীবনে পঞ্চগীতিকবির অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ এবং কবি নজরুলের গানে অনির্বচনীয় প্রভাব বিদ্যামান। বাঙালির নিম্নবর্গ থেকে উচ্চবর্গের নানান শ্রেণির মানুষের হৃদস্পন্দনে রয়েছে পঞ্চগীতিকবির গান। গোটা ভারতবর্ষে সাহিত্য ও রাজনীতির পরিসরে ব্যবহৃত এঁদের গান ও আদর্শ একইসঙ্গে টগবগ করে ফুটে চলেছে বাঙালির প্রতিবাদী শিল্পসত্তার কন্ঠস্বর হয়ে।

ঊনবিংশ শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটময় মুহূর্তে তাঁদের কবিতা ও গান যুগপৎ বিস্ফোরণের আকার ধারণ করে পরিবর্তনের জয় গান গেয়ে চলছে। এদের শিল্পশব্দ হাতবোমা হয়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ পরবর্তী বাংলাদেশের ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে পাকিস্তানিদের বিপক্ষে।

গানগুলোতে বাঙালি খুঁজে পেয়েছিলো তাদের আশার বাণী ও পরিত্রাণের পথ। উপমহাদেশীয় তাবৎ শোষক শ্রেণির প্রতি ক্ষোভ, ধিক্কার, যন্ত্রণা, আর্তনাদ, হতাশা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সৃষ্টি-সুখের উল্লাস খুঁজে পেয়েছিলো এ-গানের ভিতর দিয়ে আবিষ্কার ও স্বাধীনতার আনন্দ। তাই আজও বাঙালি জাতীয় জীবনে চলচ্চিত্র, থিয়েটার ও নব্যআন্দোলনে এদের গান বেজে উঠে শ্লোগানের প্রতিধ্বনি হয়ে।

ইতিহাস বলে, বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিলো আত্মজাগরণ ও আন্দোলন। মূলত সংকটটি ছিলো নিজস্ব সংস্কৃতির অস্তিত্ব রক্ষার। এ-সংগ্রাম থেকেই শুরু হয় বাংলা ও বাঙালির মুক্তির লড়াই। ভাষা-আন্দোলন বাংলা সংস্কৃতির একটি বড় অধ্যায়ের সূচনা এবং মুক্তির স্লোগান বিনির্মাণে প্রথম স্বর।

ষাটের দশকে পাকিস্তানি মৌলবাদী শাসকচক্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালায়। শুধু তাই নয় রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণার সাথে অসাম্প্রদায়িক নজরুলকে সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে আবদ্ধ করার জন্য চলে নানা কৌশল। তারা নজরুলের গানে ব্যবহৃত বাংলা শব্দকে হিন্দুয়ানি জ্ঞানে পরিবর্তন করে ইসলামিক শব্দ সংযোজন করেন।

বাঙালির মনকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত ও তাঁর জনপ্রিয়তাকে খাটো করবার স্বার্থে নজরুলের ইসলামি গান-কবিতা প্রচারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। কারণ তারা জানতো বাঙালির দুর্বলতা ধর্ম । এ ধর্মকে হাতিয়ার করে রবীন্দ্র-নজরুলের মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকে বাঙালিকে দূরে রেখে তাদের মেধা শূন্য করতে পারলেই সকল প্রকারের আন্দোলনের পথ বন্ধ করা সম্ভব বলে তারা মনে করতো।

বাংলার সবুজ সন্তানদের পক্ষে এ চক্রান্ত মেনে নেয়া সম্ভব ছিলো না। শক্তিশালী পাকিস্তানি শাসকের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে আনা কত কঠিন ছিলো আজ তা কোনো বাঙালির অজানা নয়। এক শ্রেণির বাঙালি লড়েছে বন্দুক হাতে রক্ত ঝরার ময়দানে। অন্য এক শ্রেণি লড়েছে অন্তরের বাংলা গানে তাদের উদ্বুদ্ধ করবার প্রয়াসে।

১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ কালো রাত্রির পূর্ব পর্যন্ত সত্যি বলতে কেউই জানতো না যে, প্রত্যক্ষ সৈনিকের ভূমিকায় বন্দুক হাতে শত্রুকে মোকাবেলা করতে হবে সাধারণ খেটে খাওয়া বাঙালিকেও। একান্ত নিজের গান হয়ে উঠবে সহস্র মুক্তিবাহিনীর প্রাণের খোরাক। একদিকে রক্তাক্ত স্লোগান, অন্যদিকে গানের সুরের আগুন। বাঙালির সংস্কৃতি এবং রাজনীতি সেদিন একসূত্রে বাঁধা পড়েছিলো দেশমাতার মুক্তির প্রতিষ্ঠায়। এ প্রসঙ্গে তিতাশ চৌধুরীর উক্তটি প্রাসঙ্গিক-

“বাষট্টির আইয়ুব শিক্ষা-নীতি বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আগুনের ফুলকির মতো মুহূর্তেই পরিণত হলো বাঙালির জাতীয়তাবাদী গণআন্দোলন ও চেতনায়। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির ঐতিহাসিক সংখ্যা-গরিষ্ঠ বিজয় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নিষ্ঠুরতার কারণ ঘটালো। ফলে শুরু হলো নির্বিচারে গণহত্যা।

এই অনিবার্যতার ফসলই মুক্তিযুদ্ধ। বস্তুত সংস্কৃতির এক একটি সংগ্রামের ভেতর থেকেই বাঙালির আত্মজাগরণ ঘটেছে। অস্তিত্ব রক্ষার অগ্নি-পরীক্ষায় বাঙালি আত্মপ্রত্যয়ী ও দুঃসাহসী হয়েছে। তাই লক্ষ করি এক সময় বাঙালি সংস্কৃতি আর রাজনীতি একাকার হয়ে একদিকে যেমন রক্তাক্ত স্লোগানের জন্ম দিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে সবখানে সুরের আগুন।

বিশ্লেষণের সুবিধার্থে মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চগীতিকবির গান ব্যবহারের প্রেক্ষাপট দুটি ধারায় ভাগ করে আলোচনায় অগ্রসর হতে পারি। যেমন-

১. মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপট ও

২. মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রেক্ষাপট

রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ ও নজরুলের স্বদেশপর্বের গানসহ অন্যান্য দেশজ, দেশাত্মবোধক, উদ্দীপনামূলক এবং গণসংগীতই বাঙালির প্রতিবাদী ছিলো তৎকালীন শিল্পীদের মুক্তি মুক্তিযুদ্ধের সুফলে মুক্তিযুদ্ধের সুফলে সংগ্রামের হাতিয়ার। সংস্কৃতির মানস সরোবরে এই সকল গান সকলকে আবেগাপ্লুত, অনুপ্রাণিত ও আন্দোলিত করতো স্বদেশমাতার জন্য প্রাণ বিসর্জনে।

রূঢ় সত্য হলো জীবনপণ করে বাংলার যে সন্তান স্বদেশমাতার দুঃখ নিবারণ ও মায়ের চোখের জল মুছাতে নিজে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, নির্মম অত্যাচারের পরেও হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যু প্রত্যাশা করেছে শুধু স্বদেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে; সেই স্বদেশ তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বদেশমাতৃকার রূপ অর্জনে কতটুকু সফল হয়েছে।

ধর্মীয় অজুহাতে জাতিগত ভেদাভেদে দুর্বলের উপর সবলের, সংখ্যালঘিষ্ঠের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের অত্যাচার এক অজানা কারণে বেড়ে চলেছে। তাই স্বাধীনতার সুদীর্ঘ অর্ধশত বছর বাঙালির প্রতিবাদী অতিক্রান্ত হওয়ার পরে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের উপযুক্ত মর্যাদা দিতে প্রয়োজন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।

বাংলা সংস্কৃতির বিকাশে আধুনিক সময় অর্থাৎ ঊনবিংশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্য পর্যন্ত দেশপ্রেমিক গীতিকবিদের অকৃপণ সৃষ্টি একবিংশ শতাব্দীর সমকালীন বিচিত্র প্রেক্ষাপটেও প্রাসঙ্গিক। স্বদেশি আন্দোলনে সম্পৃক্ত গীতিকবিদের স্বদেশভাবনা বা ভাব-ব্যঞ্জনার বিমূর্ত প্রকাশশৈলী নতুন প্রজন্মের চিন্তাধারা বিনির্মাণে ভীষণভাবে সহায়ক বলে অনুভূত।

আজ শত বছর পরেও সেইকালের উন্মাদনা, স্বদেশের প্রতি ভক্তিবোধ একালের গীতিকবিদের অনুপ্রেরণা জোগায়। দেশে সংকটের প্রেক্ষাপট বদলে গেলেও দেশের বাঙালির প্রতিবাদী প্রতি মমত্বের ধরন এতটুকুও বদলায়নি। জয় বাংলা আজও দেশ তথা দেশের রাজনীতি, এর মানুষ কোনো জটিলতার মুখোমুখি হলে মানুষ একত্রিত হয়ে সমস্বরে গেয়ে ওঠে নজরুলের ‘চল্ চল্ চল্’ কিংবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গান।

সেদিন বাঙালির মূল্যবোধ রক্ষার লড়াইয়ে যে গান অনুপ্রাণিত করেছিলো হিন্দু-মুসলমানসহ সকল স্বদেশানুভূতি সিক্ত হৃদয়কে, আজও তার ব্যতিক্রম নয়। বদলেছে শুধু পন্থা আর প্রেক্ষাপট। এ- ক্ষেত্রে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র একটি বাণী বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক-
“আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি, এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। যা প্রকৃতি নিজে হাতে আমাদের চেহারায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছে যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাইরের শত্রুকে পরাস্ত করে দেশের মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি আর জাতিসত্তার পতাকা উড়িয়ে জয়ের হাসিতে আত্মহারা ছিলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। জয় বাংলা কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পরেও বাঙালি উপলব্ধি করতে পারেনি নিজেদের মাঝেই নিভৃতে মিশে আছে বিরুদ্ধশক্তি। তবে এ কথা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

যার প্রমাণ মেলে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন তাঁর দেওয়া ভাষণে। জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের সুফলের কিছুদিনের মধ্যেই নানা আভ্যন্তরীণ জটিল সমস্যায় দেশ ছেয়ে যায়। জয় বাংলা এক কুটিলচক্র বাঙালির কষ্টার্জিত বাঙালির প্রতিবাদী স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। ঘরের ভিতরের শত্রুকে চেনা দায়। ধীরে ধীরে সকল শুভ অর্জনকে নষ্ট করবার পায়তারা করে এই অশুভশক্তি।

বাঙালির সম্প্রীতির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চলে নানা চক্রান্ত। এই অদেখা শক্তিকে পরাহত করা কঠিন হলেও অপশক্তিকে অবদমনের পন্থা বাঙালির অজানা ছিলো না। বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করবার প্রয়াসে এর সম্প্রীতির যে চরিত্র তা অক্ষুণ্ণ রাখা জরুরি। সাংস্কৃতিক চেতনায় বলীয়ান রাখতে হবে অতীত গাঁথা, উজ্জ্বল রাখতে হবে বাংলা সংস্কৃতির সত্য পরিচয়কে।
এখানে শ্রদ্ধেয় সনজিদা খাতুনের প্রাসঙ্গিক স্মৃতিকথা তুলে ধরতে চাই—

“২৩শে মার্চেই শুনতে পেলাম, বঙ্গবন্ধু তাঁর অনুগতদের বলেছেন ঢাকা থেকে সরে যেতে। মতিয়া চৌধুরীরা চলে গেছে বা যাচ্ছে শুনলাম। টেলিভিশনে ‘আগুন’ নিয়ে গান হচ্ছে সব। বাঙালির প্রতিবাদী আমাদের শান্তশিষ্ট সেলিনা মালেক চৌধুরী একদিন এসে বলে, “আপা, ‘ওরে আগুন আমার ভাই’ গানটা তুলতে হবে, টেলিভিশনে গাইব”।

ইফফাত গাইছে যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা না’ ইকবাল আহমেদ তখন সংস্কৃতি সংসদ আর ডাকসুর নেতা। সে গাইছে ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে/ ঐ যে তিনি ঐ যে বাহির পথে’। ২৩ মার্চ রাতে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখে তো অবাক। অনুষ্ঠান আর শেষ হয় না। কি একটা কোরাস গানের শিল্পীদেরকে ক্যামেরার কায়দায় সংখ্যায় অগণ্য করে তোলা হচ্ছিল, সে গানটি খানিক পর পরই হচ্ছে।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

আর হচ্ছে ফাহমিদার গাওয়া গান ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী। ফিরে ফিরে একই গান কেন, কিছুই বুঝি না। বুঝেছিলাম পরে। যখন ১২টা বেজে পার হয়ে গেল। অধিবেশনের শেষে পাকিস্তানের পতাকা দেখাবার নিয়ম। জয় বাংলা ২৩ মার্চ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসকে মানা হবে না বলেই অধিবেশন দীর্ঘায়িত করে রাত ১২টার পর ২৪ মার্চে সেই পতাকা দেখানো হলো।

পরে আরো শুনেছি, পাক আর্মি সে রাতে টেলিভিশন কেন্দ্রের বাইরে ট্যাংক নিয়ে অপেক্ষা করছিল। পতাকা দেখানো না হলে চুরমার করে দেবার কথা সব। তাই পতাকা দেখানো হয়েছিল ঠিকই, ২৩ তারিখে না দেখাবার জিদ বজায় রেখে।

প্রভৃতি স্বদেশপর্বের গান ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে রচিত হলেও মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে এমনকি একালের যেকোনো সংকটে বা জাতীয় দিবসে উচ্চারিত হয় স্বদেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে।

নজরুলের ‘ও ভাই খাঁটি সোনা’, ‘ঐ শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ইত্যাদি গান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশপ্রীতিতে অনুপ্রাণিত করতো, মুক্তিকামী, স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতো তেমনি আজ দেশের যেকোনো জাতীয় উৎসবে, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা পীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে বা ত্রাণ সংগ্রহে এই সকল গান প্রাণে শক্তির সঞ্চার করে।

এ সকল স্বদেশিগানের চর্চা ও বহুল ব্যবহারে স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম অবশ্য স্মরণীয়। যেমন- ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, উদিচি রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ প্রভৃতি। তবে ছায়ানটের অবদান এক্ষেত্রে অনিবার্য।

মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে ওয়াহিদুল হক, সনজিদা খাতুন, ফিরোজা বেগম, ফাহমিদা খাতুন, বারীণ মজুমদার, জাহিদুর রহিম, মালেকা আজিম খান প্রমুখ গুণিজনের অবদানের কথা বিশেষভাবে অবিস্মরণীর। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা ছিলো মূলত বাঙালির সংস্কৃতির বিজয়। এই সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে সমুন্নত ও বলবৎ রাখা মোটেও সহজসাধ্য ছিলো না।

স্বাধীনতার পরে দেশে হিন্দু-মুসলমান জাতিভেদ প্রকট হয়ে দাঁড়াতে থাকে। বাঙালি সংস্কৃতি’ মানে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি-এই ধারণা যখন দেশের অনেকাংশ মানুষ পোষণ করে তখন নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য রক্ত ঝরিয়ে যে স্বাধীনতার অর্জন সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কোনো ধর্মের বিজয়ের জন্য সেদিন লড়াই হয়নি। তবে তো পাকিস্তান হয়েই ভালো থাকবার কথা ছিলো।

সংগ্রাম করে নিজের পরিচয়ের জন্য যে লড়াই তা ছিলো বাঙালিসত্তার লড়াই। দেশ যখন ধার করা সংস্কৃতির আধারে নিজেকে মেলে ধরতে গর্ববোধ করতে শেখে তখন এর থেকে অপমানের আর কিছু থাকে না। এক্ষেত্রে সনজিদা খাতুনের একটি উদ্ধৃতি স্মরণযোগ্য,

“স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায়। এ মাটিতে সংস্কৃতি স্বাভাবিক তা ভুলিয়ে নিয়ে সাগর পার থেকে ‘স্মার্ট’ সংস্কৃতি আমদানি করে আবার সেই ‘ন্যাশনাল রি- কনস্ট্রাকশন’ করতে চায়। এই চাওয়া যে নিঃস্বার্থ চাওয়া নয়, বুঝতে না পারলে আবার দাসত্বশৃঙ্খল পরতে হবে আমাদের। সে দাসত্ব আরো গূঢ়। সে পরাধীনতা চিত্তকে দলে শেষ করে ফেলবে। সাংস্কৃতিক পরিচয় পর্যদুস্ত হলে জাতির পরিচয় থাকে কিসে?

বিশ্লেষণের এ পর্যায়ে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের উদাহরণ টেনে বলতে চাই, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান, কবিতা বিশেষ করে তাঁদের চেতনা তিনি ধারণ করতেন হৃদয় থেকে। তিনি সেমিনার, জাতীয় আন্দোলনে নজরুলকে সহযাত্রী হিসেবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রত্যাশা করতেন।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে পাই-

 

মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় জীবনে স্বদেশচেতনা

 

“একটা ঘটনার দিন তারিখ আমার মনে নেই ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুরে ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তারা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব, সে সভা আমাদের করতে দিল না। ১১৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন।”

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি যে জয় বাংলা স্লোগানের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামের শক্তি জুগিয়েছেন সেই উচ্চারণের সৃষ্টিমূলে নজরুলের সরাসরি প্রভাব বিদ্যমান। উক্তিটি মূলত নজরুলের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতা থেকে প্রাপ্ত। এ কবিতায় প্রথম জয় বাংলা শব্দটি উচ্চারিত হয়। যাতে অনুপ্রাণিত হয় সমগ্র বাঙালিসত্তা। কবিতাটির অংশবিশেষ প্রসঙ্গক্রমে তুলে ধরা হলো-

“জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীন

জয় যুগে যুগে আসা সেনাপতি

জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন।

আরও দেখুন :

Leave a Comment