আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় জাতীয় সংকটে পঞ্চগীতিকবির স্বদেশি গান
জাতীয় সংকটে পঞ্চগীতিকবির স্বদেশি গান
জাতীয় সংকটে পঞ্চগীতিকবির স্বদেশি গান
যে কোনো রাষ্ট্রকে সংকটের সম্মুখীন হতে হয়। যে দেশের জনগণ যত বেশি সংঘবদ্ধ সংকট মোকাবেলা তাদের পক্ষে তত সহজ। বাংলাদেশ সংকটে যেকোনো অস্থিরতায় বিচিত্র চিত্রে রবীন্দ্র নজরুল বিশেষ করে পঞ্চগীতিকবির গান প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদ- বিরোধী আন্দোলনের সোপানেও কাজ করেছে সাংস্কৃতিক ঐক্য।
১৯৯২ সালে স্বাধীনতা বিরোধীশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে গণ-আদালত প্রতিষ্ঠা পায়। সেই আন্দোলনের মূল স্লোগান, সোচ্চারিত কন্ঠস্বর হয়ে কাজ করে সংগীত । স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে মূলত বেশকয়েকটি ঘটনা স্বাধীনতাবিরোধী সংস্কৃতিকে আঘাত করা হয়েছে। সে সময় বাংলা গান অবদান রেখেছে সুউচ্চারিত স্লোগান হিসেবে যেখানে পঞ্চগীতিকবির স্বদেশিগানের ভূমিকা ছিলো বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য।
১৯৯১-এ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠা ও আন্দোলন। একই বছর গণ-আদালত প্রতিষ্ঠা। ১৯৯৬-এ মৌলবাদের উত্থান ও যশোরে উদিচির সম্মেলনে বোমা হামলা। ২০০১-এ রমনা বটমূলে বোমা হামলা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, নিপীড়ন আর সিনেমা হলসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাশকতার বিরুদ্ধে সংগীতই ছিলো মূল অনুষঙ্গ।
চলচ্চিত্র, থিয়েটার, জাতীয় আন্দোলন, কথা সংস্কৃতির নানা শাখায় এ সকল সংগীতের প্রয়োগ থাকা সত্ত্বেও বর্তমান প্রজনোর একটি শ্রেণির কাছে পঞ্চগীতিকবির স্বদেশপ্রেমের গান এবং এর চেতনার প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ জাতীয় শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রণীত সিলেবাসে এর সকল সংগীতচর্চার ক্ষেত্রের অপ্রতুলতা ও বিকাশ সাধনের পরিকল্পনার অভাব দৃশ্যমান।
এসব সংগীতের সাথে প্রাণের সংযোগ স্থাপনে প্রয়োজন পঞ্চগীতিকবির অপ্রচলিত স্বদেশি গান, বিশেষত তিন কবির স্বদেশচেতনাবাহী গানের চর্চা বৃদ্ধি করা। রবীন্দ্রনাথের সংগীতের মুক্তি প্রবন্ধের নিম্নোক্ত উক্তিটি গবেষণার দিক-নির্দেশনা দেবে-
“আমাদের সংগীতও রাজসভার সম্রাটসভায় পোষ্যপুত্রের মতো আদরে বাড়িতেছিল। সে-সব সভা গেছে, সেই প্রচুর অবকাশও নাই, তাই সংগীতের সেই যত্ন আদর সেই হৃষ্টপুষ্টতা গেছে। কিন্তু গ্রাম্যসংগীত, বাউলের গান, এ-সবের মার নাই। কেননা, ইহারা যে রসে লালিত সেই জীবনের ধারা চিরদিনই চলিতেছে। আসল কথা, প্রাণের সঙ্গে যোগ না থাকিলে বড়ো শিল্পও টিকেতে পারে না।
অর্থাৎ একবিংশ শতকে প্রাণের যোগ, বাঙালি অস্তিত্বরক্ষার ও দর্শনগত সমঝোতায় পঞ্চগীতিকবির স্বদেশচেতনার গান ধারণ করার মধ্যদিয়েই জাতীয় মুক্তির বীজ বপন হবে বলে বিশ্বাস করি। স্বদেশের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল বাণীটি আজও রবীন্দ্র-নজরুল শিল্পীদের অনেকে প্রাণে, সাধনাতে জাগ্রত রেখেছেন।
বাংলা সংগীতের গড়ে ওঠা ঐতিহ্যে পঞ্চগীতিকবির স্বদেশসংগীত আজও শুদ্ধ রাজনীতির মঞ্চ, উৎসব প্রাঙ্গণে ও জাতীয় দিবসে গৌরবের স্থানটি দখল করে আছে, চেতনায় স্বদেশপ্রেম জাগ্রত রাখার মানসে। স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে মানুষকে স্বাধীনতার পক্ষে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য বহু অনুষ্ঠান করেছে এবং সেই সকল অনুষ্ঠানেই রবীন্দ্রসংগীত, ডি.এল রায়, নজরুলের গান শোনাতেন সংস্কৃতিকর্মী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীবৃন্দ।
এক্ষেত্রে কণ্ঠযোদ্ধা সমর দাস, অরুন গোস্বামী, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, তিমির নন্দী, রথীন্দ্রনাথ রায়, সুজয় শ্যাম, শাহিন সামাদ, রফিকুল আলম, প্রবাল চৌধুরী, কল্যাণী ঘোষ, নমিতা ঘোষ, অনুপ ভট্টাচার্য, স্বপ্না রায়, জয়ন্তী লালা, ফকির আলমগীর, কাদেরী কিবরিয়া, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, অজিত রায়, সুবল দাশ, বুলবুল মহলানবীশ, মলয় গাঙ্গুলী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শ্রদ্ধেয় সনজীদা খাতুনের স্বাধীনতার অভিযাত্রা গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের অনুষ্ঠানগুলোতে অনুষ্ঠান শেষে সকলের হাতে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির অনুলিপি দেওয়া হতো সমবেতভাবে গানটি গাইবার জন্য এবং স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সিদ্ধান্তে এই রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম ১০ লাইন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সম্মান পায়।
ডি. এল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটি বাঙালির জাতীয়গীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তাই এত বছর পরে এই গানটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রাণরূপ হয়ে; দূরআলাপনির শুভেচ্ছা সংগীতের (welcome tune) মধ্যদিয়ে ভেসে আসে শ্রদ্ধেয় শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদির কণ্ঠ। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় স্বদেশচেতনাবাহী এ গানটি সৃষ্টির এত বছর পরেও সমানভাবে সমাদৃত।
এ সকল গান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতীয় শোক দিবস, পহেলা বৈশাখ প্রভৃতি উৎসব অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে পরিবেশন করা হয়। দেশের আভ্যন্তরীণ যেকোনো সংকটে সমন্বরে এই গান গেয়ে ওঠে সহস্রপ্রাণ দেশমাতাকে প্রণতি জানায় শ্রদ্ধাভরে।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতির চেতনা জাগ্রত রাখতেই প্রয়োজন হয় পঞ্চগীতিকবির স্বদেশচেতনার গান। যতদিন বাঙালি তাদের নিজ সংস্কৃতিকে ভালোবাসবে, ভালোবাসবে দেশকে ততদিন বাংলার গৌরবগাঁথা এই সকল গানের আশ্রয়ে ফিরতেই হবে বারবার।
আরও দেখুন :