রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

বাংলা স্বদেশি গানের সুর বৈশিষ্ট্য সামগ্রিক গানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বহন করে চলে। এক একটি গানের আবেদন কবি কিভাবে কি সুরে প্রকাশ করবেন বা তার প্রকাশের উদ্দেশ্যে কি, সর্বদাই সেই গানটির সুর প্রয়োগের প্রাধান্যতার উপর নির্ভর করে। ভারতীয় রাগসংগীত, উচ্চাঙ্গসংগীত ও লোকসংগীত ধারার সংমিশ্রণ করা হয়েছে স্বদেশি গানের সুর রচনাতে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে দেশি সংগীতের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ে। এ আগ্রহের প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই স্বদেশি গানের সুর রচনাতে। বহুমাত্রিক সুরের প্রয়োগ দেখা দিলেও রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি গানে লোক সুরের প্রয়োগ স্বদেশি গান রচনায় এক ভিন্ন মাত্রার মৌলিকত্ব এনে দেয়। প্রাক বঙ্গভঙ্গ অর্থাৎ ১৯০৫ সালের পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ২১টি স্বদেশপর্যায়ের গান রচনা করেন।

এরমধ্যে ‘এবার তোরা মা বলিয়া ডাক’ কীর্তনের সুরে এবং আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ রামপ্রসাদী সুরে রচিত। রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সংগীত রচনার পর্বে স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ লিখেছেন,

“ভাব ও ব্যঞ্জনার প্রাধান্য নিয়ে কথা ও সুরের মধ্যে সৃষ্টি হোল মিলনের আবেদন। বাউল, ভাটিয়ালী, জারি ও সারিগানের মন্দাকিনী ধারা হোল উৎসারিত। সারিগান—’এবার তোর মরা গাঙে’, বাউল-‘যদি তোর ডাক শুনে’ ও ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায়’ প্রভৃতি। পদ্মা নদীর পাগল করা ঢেউয়ের উপর দিয়ে নৌকার দাঁড়ের তালে তালে ছল ছল সুমধুর শব্দছন্দ আজও যেন অনুরণিত হয়ে ওঠে কবির রচিত সারিগানের মধ্যে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মোট গানের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও মোটামুটি ধারণা করা যায় তিনি ২২২৩টি গান রচনা করেছেন। তার মধ্যে মাত্র ৪৬ টি গান স্বদেশপর্যায়ের। এবং এরমধ্যে মাত্র ১২টি গানের প্রতিটিই একেকটি থেকে অন্যটি আলাদা ও বৈচিত্র্যমণ্ডিত । গানের বিশদ সুরগত বিশ্লেষণটিতে এই পর্বের আলোচনায় অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হবে।

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্বের গানের সুর সৃষ্টিতে এর গণপ্রচার ও গণতাৎপর্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা অনুধাবনযোগ্য। যদিও তাঁর প্রায় দুই হাজারের বেশি সংখ্যক গানে এর রস-ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে বাণী, ভাষা ও সুরের সৃষ্টিতে যে বিস্ময়কর শৈলী ও সাংগীতিক বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর রেখেছেন তা তাঁর স্বদেশপর্বের গানে অপ্রতুল। তবে এও সত্য স্বদেশের গানে সুরের এই সংযতবোধ কবির ইচ্ছাকৃত ও বিবেচনালব্ধ প্রয়োগ।

স্বদেশপর্বের গানেও প্রাক যৌবনের অভ্যাসবশত রাগ-রাগিণীর ব্যবহার তিনি করেছেন, তবে সে গান তাঁর অন্যান্য স্বদেশি গানের মতো সমাদর পায়নি বরং এই সকল গান কেবল উচ্চ ও ওস্তাদি মহলের জন্য যথার্থ বলে বিবেচ্য। যেমন-কবির ৪১ বছর বয়সে রচিত হাম্বীর রাগে তাল ফেরতায় রচিত বিখ্যাত গান ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে গুণি মহলে একটি বহুল আলোচিত গান।

তাছাড়াও হাম্বীর রাগে এক তালের গান ‘জননীর দ্বারে আজি ওই’ গানটিও রাগাশ্রিত স্বদেশি গান এবং ওস্তাদী গান-যা যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয়বাহী। ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে’ গানটিতে তেওড়া ও এক তালের (১২ মাত্রা) অপূর্ব সমন্বয় গানটিতে একদিকে গম্ভীর আবহ সৃষ্টি করে আবার তাল ফেরতার আবহে দ্বিগুণ লয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলার একটি ছন্দে মনকে মাতিয়ে তুলে স্বদেশবোধের চঞ্চলতায় ও গভীরতায়-

“আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে।

কে আছ জাগিয়া পুরবে চাহিয়া,

বলো উঠ উঠ’ সঘনে গভীরনিদ্রায়গনে ।”

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

 

এখানে শুরুতেই চতুর্মাত্রিক একতালে ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে’র পরের লাইনেই ‘কে আছ জাগিয়া থেকে তেওড়া’র ৭ মাত্রার ছন্দে বেঁধে আবার চতুর্মাত্রিক একতালে প্রবেশ এক অভূতপূর্ব মুন্সিয়ানার পরিচয় রেখেছেন কবি। শুধু তাই নয় গানের শেষাংশে ‘ফেলো জীর্ণ চীর, পরো নব সাজ’ অংশে হঠাৎ সুরে ছন্দের পরিবর্তন স্বদেশচেতনায় এক অন্যরকম ঝঙ্কার তোলে যা সংগীতের আসরে সহসা বিরল। স্বরলিপির উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্ট হবে-

“…থেকো না অলস শয়নে থেকো না মগন স্বপনে ॥

যায় লাজ ত্রাস, অলস বিলাস কুহক মোহ যায়।

ওই দূর হয় শোক সংশয় দুঃখ স্বপনপ্রায়। ফেলো জীর্ণ চীর,

পরো নব সাজ, আরম্ভ করো জীবনের কাজ-

সরল সবল আনন্দমনে, অমল অটল জীবনে

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

 

সুরের বৈচিত্র্যতা আনার জন্য নিচের অংশে দাদরা তালের দ্রুত ছন্দের ব্যবহার করা হয়েছে।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

 

এখানে থেকো না অলস শয়নে তেওড়া থেকে মুখে ফিরে আনন্দধ্বনি জাগাও চতুর্মাত্রিক একতালে ফেরা আবার তেওড়া হয়ে লাজ ত্রাস, আলস বিলাস’ থেকে ত্রিমাত্রিক একতালের সাথে হাম্বীরের সুরের প্রয়োগ গানটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।
যদিও এ ধারায় স্বদেশপর্বের গান তিনি খুব বেশি রচনা করেননি। তবে রাগ-রাগিণীর প্রয়োগ করেছেন নিপুণ পরিমিতির সাথে প্রাক যৌবনপর্বে

তোমারি তরে মা সঁপিনু এ দেহ – জয়জয়ন্তী-চোতাল – ১৬ বছর বয়সে রচিত

অয়ি বিষাদিনী বীণা কাহার – কাওয়ালি – ১৭ বছর বয়সে রচিত

ঢাকরে মুখ চন্দ্রমা, – গৌড় মল্লার – ১৭ বছর বয়সে রচিত

ভারত রে তোর কলঙ্কিত পরমাণুরাশি – ভৈরবী – ১৭ বছর বয়সে রচিত

এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন – খাম্বাজ এক তালের – ১৮ বছর বয়সে রচিত

দেশে দেশে ভ্রমি তর – বাহার কাওয়ালি – ২০ বছর বয়সে রচিত

এ কী অন্ধকার ভারতভূমি – প্রভাতী-এ -একতাল – ২৩ বছর বয়সে রচিত

শোনো শোনো আমাদের ব্যথা – খাম্বাজ-ঝাঁপতাল – ২৩ বছর বয়সে রচিত

এই সকল রাগাশ্রিত স্বদেশপর্বের গানই রচিত হয়েছে তাঁর ২৫ বছর বয়সের পূর্বে যখন রবীন্দ্রনাথ বাল্যকালে মনে ও মননে গেঁথে যাওয়া রাগ-রাগিণীর অবগাহনে ডুবে ছিলেন। যদিও এই সকল রাগাশ্রিত স্বদেশপর্বের গান তাঁর অন্যপর্যায়ের রাগাশ্রিত গানের মতো সর্বজন প্রসিদ্ধ না হয়ে কেবল ওস্তাদিমহলে স্বীকার্য থাকে। এ প্রসঙ্গে সুধাংশ শেখর শাসমল যথার্থই বলেছেন :

“রবীন্দ্ররচিত দেশাত্মবোধক সঙ্গীত তাঁর দ্বিসহস্রাধিক রস-ব্যঞ্জনাদ্ধ কাব্যসঙ্গীতের মতো বাণী, ভাষা ও সুরের বিস্ময়কর শৈলী ও সাংগীতিক বৈশিষ্ট্যের নির্মিত পায়নি ঠিকই, কিন্তু গণপ্রচার ও গণতাৎপর্যের প্রেক্ষিতে সে-সব গানের ভাষা ও সুরের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা অনুধাবনযোগ্য।

প্রাযৌবন পর্বে উচ্চাঙ্গ রাগ-রাগিণীর সুরে সমৃদ্ধ বাণীতে ব্রহ্মসঙ্গীত, রাগাঙ্গ ও কাব্যসঙ্গীত সৃষ্টি করার অভ্যাসে স্বদেশি সঙ্গীতেও প্রচলিত রাগ-রাগিণী বসিয়েছেন। জয়জয়ন্তী, বাহার, ভৈরবী, গৌড়মল্লার, দেশ, খাম্বাজ, বেহাগ, সিন্ধু, হাম্বীর, কাফি প্রভৃতি রাগ-রাগিণীর সুনিপুণ প্রযোজনা আছে স্বদেশি গানে। শুধু তাই নয় রাগ-রাগিণীর ব্যবহার ছাড়াও অন্য গানের সুরে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি সংগীত রচনা করেছেন।

তাঁর অন্যান্য পর্যায়ের গানের মতো গান বা ভজনের সুর নিয়েও তিনি স্বদেশি গানে সুর প্রয়োগ করেছেন। ‘য়ে বাঁতিয়া মেরে চিত মেরে চায় নিশিদিন সুরট রাগে চৌতাল নিবন্ধিত গানটি মহারাজা নওলকিশোর রচিত। এই গানটি ভেঙে কবি রচনা করেন একই সুরে- এ ভারত রাখো নিত্য প্রভু’। এছাড়াও ভজনের সুরে রচনা করেন-‘এ কী অন্ধকার ভারতভূমি।’

তবে রবীন্দ্রনাথ লোকায়ত সুর অর্থাৎ বাংলার নিজস্ব সুর কীর্তন, বাউল, রামপ্রসাদী সুরে তাঁর অধিকাংশ স্বদেশপর্বের গান রচনা করেন। এই সকল সুর যেভাবে সকল শ্রেণির মানুষের মনে গেঁথে যায় রাগ- রাগিণী ভিতর স্বদেশি গান ততটা নয় কখনো।

একবার তোরা মা বলিয়া ডাক’, ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ গান দুটি তেমনি বাউল-কীর্তন-রামপ্রসাদী লোকসুরের সরলতার কারণে এবং সহজ ভাষায় উপস্থাপনের কারণে স্বদেশি যুগে কণ্ঠে কণ্ঠে গীত হতো- যা মূলত সাধারণের গান হয়ে উঠেছিল অবলীলায়। প্রতিটি অন্তরাতে একই সুর হওয়াতে এবং কথার অতি সরল উপস্থাপন রামপ্রসাদী সুরের দুলনিতে এই গানটি অনন্য মাত্রা পায় এবং খুব সহজেই এই গান কণ্ঠে ধারণ করা সম্ভব হয়।

“আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।

ঘরের হয়ে পরের মতন ভাই ছেড়ে ভাই ক’দিন থাকে ?

প্রাণের মাঝে থেকে থেকে ‘আয়’ ব’লে ওই ডেকেছে কে

সেই গভীর স্বরে উদাস করে আর কে কারে ধরে রাখে ?”

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

 

আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের সুরে ও বাণীর মহিমায় ব্যাকুল ছিলেন এবং তিনি জানতেন এই সুরের মধ্যদিয়ে সাধারণের অন্তরে প্রবেশ সহজ বিধায় স্বদেশি গানের সুরারোপে রবীন্দ্রনাথ বাউলের সহজ-সরল সুরকে বেছে নিলেন। এমন কি কিছু গানে তিনি অবিকল বাউলের সুরটি গ্রহণ করেছেন অর্থাৎ বাউল ঢঙ্গে গান রচনা করেছেন। আমরা সকলেই বাউল গগন হরকরার কথা শুনেছি।

তাঁর গান আমি কোথায় পাবো তারে’ এর হুবহু সুরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন সকলের প্রাণের স্বদেশি গান ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি যা পরবর্তীকালে আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে সম্মানিত হয়। এই গানের পাঁচটি স্তবকই হুবহু বাউল সুরে রচিত এবং তিনি সুনিপুণভাবে এর একটি লাইন বাউলের আখর ভঙ্গিতে মরি হায় হায়রে ও মা’ অংশটি ফিকির চাঁদের ‘নদীর কোলে…মরি হায় হায়রে ও নদী’র আখরের অপরূপ সুর গ্রহণ করেছেন।

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।

একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে

যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ও অভাগা,

যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়-

তবে পরান খুলে

ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে ॥”

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ

 

এছাড়াও গগন হরকরার ‘ও মন অসার মায়ায় ভুলে রবি কতকাল এমনিভাবে এই বাউল সুরে রচিত ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ক’ এবং ‘মন মাঝি সামাল সামান’ এই বহুল প্রচলিত বাউল সুরের অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন স্বদেশপর্বের বিখ্যাত গান এবার তোর মরা গাঙে বাণ এসেছে।

রবীন্দ্রনাথ বাউল, লোক, কীর্তন, সারি, ভাটিয়ালি প্রভৃতি সুরে কতোটা মজেছিলেন এই সকল গানের আলোচনাতেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। স্বদেশি গানের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটে এবং সময়ে রচিত অধিকাংশ গান তাঁর বাংলার লোকজ সুরে রচিত।

আবার বিখ্যাত এই সকল স্বদেশপর্বের বাউল-কীর্তন গানের সাথে রাগের মিশ্রণ করেছেন অপূর্ব স্বকীয়তায়। বাউল-কীর্তনের সাথে রাগ মিশ্রণ কবির সুর রচনার প্রগাঢ় দক্ষতার আরো একটি উল্লেখিত। দিক। সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ গানটিতে বাউল-কীর্তনের সাথে ভৈরবের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন কবি। এমনি বহু রাগের মিশ্রণের লক্ষ্য করা যায় তাঁর স্বদেশপর্বের গানে।

১. বিধির বাঁধন কাটবে তুমি-খাম্বাজ মিশ্রণ

২. আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে-বিভাস মিশ্রণ

৩. বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি-বেহাগ মিশ্রণ

৪. আমি ভয় করবো না ভয়-ভূপালি মিশ্রণ

৫. এবার তোর মরা গাঙ্গে সারি সুরের মিশ্রণ।

স্বদেশি গানে সুরের বৈচিত্র্যতা আনয়নে এই সকল গানের লোকসুরের সাথে রাগের মিশ্রণ এক অপূর্ব সমন্বয়। যদিও রবীন্দ্রনাথের রাগমিশ্রণ ব্যতিরেকে শুধু বাউল বা কীর্তন সুরে রচিত স্বদেশপর্বের গানে যে আবেদন সৃষ্টি হয় এবং গানকে যেভাবে মর্মস্পর্শী করে তুলে সুরের মিশ্রণ ততটা নয়। সুরগত এই সার্থকতা তাঁর স্বদেশ পর্বের গানে খুব সহজেই পরিলক্ষিত হয়।

স্বদেশপর্বের মাত্র ৪৬টি গানের মধ্যে কবি বৈচিত্র্যতার ভাণ্ডার ঢেলে দিয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গের পূর্ব হতে পরবর্তী সময়কাল পর্যন্ত যে কয়টি গান তিনি উপহার দিয়েছেন সেই কয়টি গানকে আশ্রয় করেই আজকের গীতিকবিগণ স্বদেশচেতনার নতুন সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করে চলেছেন।

বাউল, কীর্তন, রামপ্রসাদী, সারি, ভাটিয়ালিসহ শাস্ত্রীয় সংগীতের মিশ্রণে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশচেতনার গানে সুর প্রয়োগের যে দক্ষতা ও স্বকীয়তা দেখিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে বিরল। এখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্বের গানের সুরের মধ্যদিয়ে বাংলার প্রকৃতিকে যেভাবে হৃদয় দিয়ে অবলোকন করা যায়, দেশের প্রতি অন্তরের টান ও মমতা অনুভূত হয়, তা বিরল।

ভারতীয় রাগ-রাগিণীসহ বাংলার লোকসুরের যে অমৃত ঐশ্বর্য ও বিস্ময়কর ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বদেশপর্বের গানে তাতে দেশের প্রতি গভীর প্রেম উদ্রেক হয়। এ সুর অবগাহনে দেশের জন্য মমতায় হৃদয় ছেয়ে যায় বলেই বলা বাহুল্য গীতিকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি তাঁর দেশাত্মবোধক গানসমূহ ।

বঙ্গভঙ্গকালে রবীন্দ্রনাথ মোট ২৪টি স্বদেশপর্যায়ের গান রচনা করেন। এই সকল রচিত গানে মূলত দুইটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। প্রথমটা লৌকিক যেখানে বাউল সুরের প্রাধান্য বেশি। ২৪টি গানের অর্ধেকের বেশি গান মূলত রবীন্দ্রনাথের এই আঙ্গিকে রচিত। আর বাকি গানগুলোতে যে বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা হলো সুরের সহজ সরল গমন ও তালের সহজ ছন্দের প্রয়োগ।

এরমধ্যে কয়েকটি গান আছে যেখানে লৌকিক সুরের বাইরেও রাগ-রাগিণীর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কবি। যদিও সেই সকল রাগ- রাগিণী বাংলাদেশে প্রচলিত সহজ সুরের রাগ। বাউল সুরে রচিত অন্যতম কিছু গানরে উদাহরণ দেওয়া
হল। যেমন-

১. যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা।

২. রইল বলে রাখলে কারে।

এখানে রাগভিত্তিক লোকসুরের স্বদেশি গানের কতিপয় উদাহরণ তুলে ধরা হল। যেমন-

১. আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি। (বিভাস, একতালা)

২. আমি ভয় করব না, ভয় করব না। (ইমন ভূপালি )

৩. বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই। (বেহালা)

রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি গানের সুর রচনায় যে বিশেষ একটি স্তরের মধ্যদিয়ে গেছেন তা হলো রাগরাগিণীর ঢংটিকে প্রাধান্য দিয়ে রচিত গানের ক্ষেত্র। তাঁর রাগনির্ভর স্বদেশ গানের তালিকার মধ্যে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ এবং ‘দেশে দেশে নন্দিত করি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে এক্ষেত্রে অনন্য স্বদেশপর্বের গান।

একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, লোকসংগীতে সাধারণ সহজ কথার প্রাধান্য বেশি পরিলক্ষিত হয় এবং একই সুর ঘুরেফিরে সেই কথাকে বার বার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উপস্থাপন করে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্বদেশের গানে তিনি যে লোকসুরের প্রয়োগ করেছেন তাতে চিরাচরিত লোকসুরের কোনো ত্রুটি চোখে পড়ে না।

বাউল ভাষার সরলতা, মনের গভীরতা, আত্মার পরম আত্মাকে খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টাসহ জাতীয় সংগীতে সুগভীর সহজ সরল সুরের সাথে মিশ্রণ করে এই গানকে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে চেয়েছেন কবি। ‘বাংলার লোকমনকে জয় করবার ক্ষেত্রে তাঁর এই ধারার গানের সুরের ভূমিকা অদ্বিতীয়। অর্থাৎ আমরা বলেতে পারি এ গানের কথায় যেমন কাব্যসংগীত আছে, তেমনি আছে সুরের মাধুর্য্য ও লালিত্য।

আরও দেখুন :

Leave a Comment