আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় ত্রিতন্ত্রী বীনা এবং সেতার। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শার্সদের রচিত ‘সংগীতরত্নাকর’ গ্রন্থটিতে ত্রিতন্ত্রী বীণার উল্লেখ অনেক গবেষককে ত্রিতন্ত্রী বীণার সাথে সেতারকে সম্পর্কযুক্ত করতে উৎসাহিত করে। বৈদিক যুগের এই বাদ্যযন্ত্রের সাথে সেতারকে সম্পর্কযুক্ত করতে গিয়ে শৌরিন্দ্র মোহন ঠাকুর ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘যন্ত্র ক্ষেত্র দিপীকা’ গ্রন্থে দাবী করেছেন যে আমীর খসরু ত্রিতন্ত্রী বীণাকেই সেতার নামকরণ করেছেন।
ত্রিতন্ত্রী বীনা এবং সেতার
বিষয়টি সমগ্র ইতিহাসকে আরো ঘোলাটে করে তুলেছে বলে মত প্রকাশ করেছেন সংগীত গবেষক ড. পিটার কুটচি। কারণ প্রাচীণ মন্দিরের চিত্রকলা অথবা যুগল চিত্রকলায় অনুসন্ধান করলে কেবল অষ্টাদশ শতাব্দীর চিত্রকর্মে আধুনিক সেতার জাতীয় কোন বাদ্যযন্ত্রের অবয়ব পরিলক্ষিত হয়।
শৌরিন্দ্র মোহন ঠাকুরের মত অধ্যাপক লালমণি মিশ্র তাঁর ভারতীয় সংগীত বাদ্য’ গ্রন্থে ‘ত্রিতন্ত্রী বীণা থেকে সেতারের উৎস খোঁজার চেষ্টা করেছেন মাঝখানে ‘যন্তর’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্রকে মাধ্যম হিসেবে রেখে। ‘সংগীতরত্নাকরা এবং ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থ দু’টির উপর ভিত্তি করে তাঁর যুক্তি হলো ‘ত্রিতন্ত্রী বীনা পরবর্তীকালে ‘যন্ত্রর’ নামে পরিচিত হয় এবং ‘যন্ত্রর’ হলো সেতারের আদি নাম।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শাঙ্গদের রচিত গ্রন্থে ত্রিতন্ত্রী বীণার নাম উল্লেখ আছে কিন্তু কোন বর্ণনা নাই। পঞ্চদশ শতাব্দীতে টীকাকার কল্লিনাথ বলেন যে, ‘ত্রিতন্ত্রী বীণার জনপ্রিয় নাম হচ্ছে ‘যন্তর’। সে সময়ে ত্রিতন্ত্রী বীণা সম্ভবত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিলো, অন্তত নামের দিক থেকে, কারণ কল্পিনাথের পরবর্তী সময়ে এই নামে কোন যন্ত্রের নাম পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে ষোড়শ শতাব্দীতে আবুল ফজল রচিত ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে ‘যন্তর’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
সে সময়ে এটি সম্রাট আকবরের রাজদরবারে একটি প্রধাণ বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিগণিত হতো। আবুল ফজলের রচনা থেকে ‘যন্ত্রর’ এবং ‘বীণ’এর বর্ণনা উদ্ধৃত করা হলো –
“যন্তর এক গজ দীর্ঘ ফাঁপা কাঠের গলা দিয়ে তৈরি। দু’প্রান্তে আধখানা লাউ সংযুক্ত। গলার উপরে ষোলটি পর্দা। এর উপর দিয়ে পাঁচটা তার গেছে। তারগুলি দু’দিকেই বাঁধা। পর্দার বিন্যাসের দ্বারা তীব্র ও কোমল স্বর এবং তাদের বৈচিত্র সৃষ্টি করা হয়।”
“বীণা প্রায় যস্তরের অনুরূপ, কিন্তু তিনটি তারযুক্ত সম্রাট আকবরের আমলের ‘যন্ত্রর’ আর কল্লিনাথ উল্লিখিত ‘যন্ত্রর’ হয়তো একই ছিলো, এমনকি শাঙ্গদেবের ‘ত্রিতন্ত্রী’র সাথেও এর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ‘আইন-ই- আকবরী’তে উল্লিখিত ‘যন্তর’ ছিলো একটি দণ্ডাকৃতি জিথার, যা উত্তর ভারতে অত্যন্ত প্রচলিত ছিলো। ‘বীণা’ নামে।
অথচ সেতার একটি লিউট গোত্রের বাদ্যযন্ত্র। সেতারের সাথে জিহ্বার গোত্রভুক্ত যন্তর এর আকৃতিগত কোন মিল নাই। উপরন্তু যন্তর বীণার থেকেও পৃথক এ কারণে যে, এতে সংযুক্ত লাউ দু’টি অর্ধেক করে কাটা, বীণা বা জনপ্রিয় ‘বীণ’-এর মত সম্পূর্ণ লাউ এই যন্ত্রের তুম্বা হিসেবে সংযুক্ত নয়। পরবর্তীকালে বীণের জনপ্রিয়তা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায় এবং সমগ্র উত্তর ভারতে এর বহুল ব্যবহার দেখা যায়, পক্ষান্তরে ‘যন্তর এর ব্যবহার কমে আসে।
শুধু রাজস্থানের লোক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ‘যন্তর’ এখনও টিকে আছে, সেটি আকারে একটি ছোট বীণের মত। ড.এলাইন মাইনার বিভিন্ন গবেষকদের গবেষণা পর্যালোচনা করে মন্তব্য করেছেন যে, কোথাও যন্ত্রর’ এর সাথে সেতার কিংবা ‘ত্রিতন্ত্রী বীণার কোন সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় নি। ত্রিতন্ত্রী অর্থ তিন তার বিশিষ্ট যন্ত্র। অপরদিকে ফারসী ভাষায় সেতার অর্থও তাই (সেহ = তিন, তার = তন্ত্রী)।
নামের অর্থগত মিল সম্ভবত গবেষকদের এই দু’টি যন্ত্রের সাথে সম্পর্ক আবিস্কারে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। এছাড়া আকার আকৃতির দিক থেকে এবং শ্রেণীবিন্যাসের ভিত্তিতে দু’টি যন্ত্রের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং ত্রিতন্ত্রী বীণা থেকে সেতার উদ্ভাবনের অনুকূলেও কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
আরও দেখুন :