আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় দুই অঞ্চদের বাদ্যযন্ত্রের মেলবন্ধন সেতার দুই অঞ্চলের বাদ্যযন্ত্র বলতে এখানে উপমহাদেশের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রসমূহ যা প্রাচীনকাল থেকে এদেশে প্রচলিত রয়েছে সেগুলো এবং উপমহাদেশের বাইরে থেকে আগত বাদ্যযন্ত্রসমূহকে বোঝানো হয়েছে।
দুই অঞ্চদের বাদ্যযন্ত্রের মেলবন্ধন সেতার
সেতার যন্ত্রের আবির্ভাবের পূর্বে তম্বুর যন্ত্রটি দীর্ঘকাল এই উপমহাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলো। তম্বুর যন্ত্রের পারসা প্রভাবিত রূপটি ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকে। এরপর ধীরে ধীরে এতে কিছু পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। উপমহাদেশে পূর্ব থেকে প্রচলিত বাদ্যযন্ত্রসমূহের প্রভাবে এই পরিবর্তনগুলো ঘটতে থাকে। মূলত বীণের (রুদ্র বীণা ‘বীণ’ নামে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলো)
বৈশিষ্ট্যগুলো সেতারে যুক্ত হতে থাকে এবং এভাবেই ভারতীয় এবং পারস্য প্রভাব মিলে মিশে একটি নতুন যন্ত্রের রূপায়নকে ত্বরান্বিত করে। পারস্য প্রভাবিত যন্ত্রগুলোর মধ্যে শুধু তম্বুর কিংবা সেতার নয়, বরং পারস্য ‘উদ’ এবং উজবেক দুতারা যন্ত্রের প্রভাবের কথাও উল্লেখযোগ্য।
চিত্র – উজবেক দুতার
এ প্রসঙ্গে সংগীত গবেষক ড. ওয়াহিদ মির্জার মন্তব্য উদ্ধৃত করা হলো। “উপমহাদেশে পূর্ব থেকে প্রচলিত কোন বাদ্যযন্ত্রের বিবর্তনের ফল হচ্ছে সেতার, একথা প্রায় সকল গবেষকই বিশ্বাস করেন। যখন পারস্য এবং উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ শুরু হয় সম্ভবত সে সময়ে এই বিবর্তনের শুরু। সেতার যন্ত্রটি দেখতে পারস্যের তম্বুর কিংবা উদ্ নামক যন্ত্রের মত, বাদন রীতিতে আবার ভারতীয় বীণার মত। নিঃসন্দেহে এটি ভারতীয়-পারস্য মিলিত সংস্কৃতির প্রভাবে সৃষ্ট এক অনন্য সৃষ্টি।
সংগীত গবেষক ম.ন. মুস্তাফা “আমাদের সংগীত ইতিহাসের আলোকে” গ্রন্থে লিখেছেন- “সেভারের আকারে পারস্য ‘উদ’ এবং উপাদানে ‘বীণা’র সাদৃশ্য দেখা যায়। কেবল পার্থক্য এই যে, সেতারের পর্দাগুলোকে ঘুরিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বিন্যস্ত করে নেয়া যায়। সেতারের এই বিন্যস্তকরণ বা ব্যবস্থাপূর্বক সমন্বয় করার সুবিধার জন্য একে যে কোন সুর সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করা চলে।”
প্রাসঙ্গিকভাবে ‘উদ’ যন্ত্রটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
প্রাচীন আরবদেশে প্রচলিত ‘উদ’ নামক যন্ত্রটি পারস্যে পরবর্তীকালে ‘বারবাত’ নামেও পরিচিত। উদ যন্ত্রটির দেহ আধখানা নাশপাতির মত আকারের। এটি খাটো গলাবিশিষ্ট লিউট জাতীয় যন্ত্র। প্রসঙ্গে সংগীত পেকট্রাম দিয়ে বাজাতে হয়। এর দেহ এবং ফিংগারবোর্ড কাঠের তৈরি। শব্দ প্রকোষ্ঠের উপরের অংশে একাধিক সাউন্ড হোল থাকে। প্রাচীন উদ যজ্ঞে মোট নয়টি তার থাকতো।
প্রথম চারটি জোড়ায় জোড়ায় এবং শেষেরটি একক। দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই যন্ত্রে পর্দার প্রচলন ছিলো, এর পর ধীরে ধীরে পর্দার ব্যবহার উঠে যেতে থাকে। চতুর্দশ শতাব্দীর পরে কোন উদ যন্ত্রে পর্দার ব্যবহার দেখা যায় না। উদের ফিংগারবোর্ডের শেষ প্রান্তে খুঁটি আটকানোর জায়গাটি পেছন দিকে বাঁকানো। প্রসঙ্গে সংগীত প্লেকট্রাম হিসেবে পাতলা লম্বা এক খণ্ড কাঠের টুকরা ব্যবহার করা হতো। মধ্যপ্রাচ্যে উদ বাদ্যযন্ত্রের রাজা হিসেবে পরিচিত।
চিত্র – উপ
পরিশেষে বলা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অহোবল রচিত ‘সংগীতপারিজাত’ গ্রন্থে যখন নিবন্ধ এবং অনিবন্ধ তম্বুরের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তখন থেকেই এই যন্ত্রে পরিবর্তন কিংবা বিবর্তনের সূচনা। পরবর্তী একশত বছরে পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সেতারের চূড়ান্ত রূপ পরিস্ফুট হয়ে আসে। লিখিতভাবে ‘সেতার’ যন্ত্রটির নামের উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যায় দরগাহ কুলি খাঁ রচিত “মুরাক্কা-ই-দিল্লী’ (১৭৩৯) গ্রন্থে।
এর আগে সমগ্র ভারতবর্ষের কোন লিখিত ইতিহাস কিংবা সাহিত্যগ্রন্থ কোন কিছুতেই সেতার নামক কোন যন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় নি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের কিছু পরে একাধিক হিন্দী কবিতায় এই যন্ত্রের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন, কবি শাহ আলম রচিত ‘নাদিরাত-ই-শাহী এবং কবি যশরাজ রচিত ‘হাম্মীর রাসো’ ইত্যাদি।
ইউরোপিয়ানদের লেখায় সেতারের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে, এক ইউরোপিয়ান পর্যটকের লেখা ভ্রমণকাহিনীতে। প্রকৃতপক্ষে এই উপমহাদেশে সেতার যন্ত্রের আবিষ্কার ঠিক কোন সময়ে হয়েছে তা সঠিকভাবে বলা খুব দুরূহ ব্যাপার। প্রসঙ্গে সংগীত তবে প্রথম প্রামাণ্য দলির হিসেবে ‘মুরাক্কা-ই-দিল্লী’ গ্রন্থটি খুব গুরুত্ববহ। সম্রাট মুহাম্মদ শাহ রঙ্গিলের আমলে এটি লেখা হয়। বইটিতে সদারঙ্গ, অদারগ প্রমুখের বর্ণনা আছে।
প্রসিদ্ধ বীণকার নিয়ামত ধার প্রচলিত নাম ছিলো সদারঙ্গ। তাঁর ভ্রাতপুর ফিরোজ বা অদারঙ্গ নামে পরিচিত ছিলেন। ‘মুরাক্কা-ই- দিল্লী’ গ্রন্থে দিল্লীর রাজসভার প্রায় ষাটজন সংগীতজ্ঞ এবং তাদের সংগীত পরিবেশনের প্রাণবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। সে সময়কার প্রধান সংগীতজ্ঞ ছিলেন নিয়ামত খান। তাঁর ভাই এবং ভ্রাতষ্পুত্রকেও বিখ্যাত বাদক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।বলা হয়েছে –
“ ( নিয়ামত খানের) ভাইয়ের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাবার আশ্চর্য দক্ষতা রয়েছে। এক নাগাড়ে চার ঘন্টা ধরে তিনি বিভিন্ন ধরণের সুর (ধুন) বাজাতে পারেন, কিন্তু তাঁর এমন শৈলী যে কোন সুরের পুনরাবৃত্তি ঘটে না। তাঁর এই শৈল্পিক গুণ দেখে বড় বড় সংগীতজ্ঞরা হতভম্ব।
আল্লাহ এই দক্ষতা ও পরিপক্কতা সবাইকে দেন নি। তিনি একজন দক্ষ গায়কও। নিয়ামত খানের ভ্রাতষ্পুত্র সেতার বাদনে খুব দক্ষ। তিনি অনেকগুলো নতুন কৌশল আবিস্কার করেছেন। প্রসঙ্গে সংগীত অন্যান্য পরিচিত সব যন্ত্রে যতগুলো সুর বাজানো যায়, এই লোক সেতারে তার সবগুলোই বাজাতে পারেন।”
প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই ভাইটি হলেন খসরু খান, যিনি পরে আমীর খসরু নামে পরিচিতি লাভ করেন এবং ভ্রাতষ্পুত্রটি হচ্ছেন ফিরোজ খান। চিত্রকর্ম থেকে যদি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী সেতারের বিবর্তন সম্পর্কে আমরা ধারণা লাভ করতে আই তাহলে বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকে প্রাপ্ত চিত্রকর্মে সেতারের যে ছবি পাওয়া যায় সেগুলোকেই প্রাথমিক যুগের সেতারের নিদর্শন বরে ধরে নিতে হবে।
আকারে ছোট হলেও এর প্রায় সব কিছুই এখনকার সেতারের মত। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে পাটনায় এক শিল্পীর আঁকা একটি জলরঙের চিত্রকর্মে এবং ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীতে আঁকা দু’টি পোর্ট্রেটে এ ধরণের সেতারের চিত্র পাওয়া যায়। ছবিগুলো বর্তমানে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত আছে। দিল্লীতে প্রাপ্ত অপূর্ব চিত্র দু’টিতে দেখা যায়, কর্নেল জেমস স্কিনারের দু’জন কর্মচারী সুকির খান এবং জঙ্গী খান বসে সেতার বাজাচ্ছেন।
সেতারের প্রতিটি ডিটেইল এই চিত্রে বোঝা যায়। যেমন, চেপ্টা আকৃতির পর্দা, যা সোনালী রঙে আঁকা হয়েছে, যন্ত্রে তারের অবস্থান প্রসঙ্গে সংগীত ( দণ্ডের মাঝামাঝি জায়গায় যাতে তার টেনে মীড় বাজানো সম্ভব হয়) এবং বাঁ হাতের আঙুলের সাহায্যে মীড় টানলে যে ভঙ্গি হয় সে ধরণের ভঙ্গি ইত্যাদি ।ক্রমান্বয়ে সেতার যন্ত্রের নানা বিবর্তন ঘটে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে সুকির খানের হাতে যেমন ছোট আকারের সরু দণ্ডবিশিষ্ট সেতারের পরিচয় পাওয়া যায়, অপরদিকে কোন কোন চিত্রে চওড়া দণ্ডবিশিষ্ট সেতারের পরিচয়ও পাওয়া যায়।
বেলজিয়ান লেখক এবং শিল্পী এফ. বালথাজার্ড সলভিস-এর লেখা বই A Collection of two hundred and fifty coloured echings descriptive of the manners. customs and dress of the Hindus, যা প্রথমে কোলকাতায় প্রকাশিত হয় ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে, পরে লন্ডন এবং প্যারিস থেকেও প্রকাশিত হয়, তাতে যে সেতারের ছবি আঁকা হয়েছে তার দণ্ড চওড়া এবং যন্ত্রটি ছয় তার বিশিষ্ট।
ব্রিজ কিছুটা পাতলা হলেও উপরিভাগ সমতল, অর্থাৎ জওয়ারি বিশিষ্ট। আগের সেতারগুলোর চেয়ে এর আকার বড়। শুধু আকারের পার্থক্য নয়, মূল লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো, আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী এখানে দণ্ডের উপরিভাগ অর্থাৎ পটরীর উপরে এক প্রান্ত থেকে আপর প্রান্ত পর্যন্ত সবটা অংশ জুড়ে তার ছড়ানো রয়েছে। এই ধরণের সেতারে বাঁ হাতের সাহায্যে তার টেনে মীড় বাজানোর সুযোগ নাই।
তবে মজার ব্যাপার এই যে, বর্তমান যুগেও অঞ্চলভেদে ভারতের কোন কোন অংশে এ ধরণের সেতারের অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়। যেমন, গুজরাটে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ‘দেশী সেতার’ নামে যা প্রচলিত সেটির দণ্ড এই রকম চওড়া এবং এর বাজ তার হচ্ছে একজোড়া তার, একত্রে দু’টি তার বাজানো হয়। এই তার দু’টির অবস্থান পটরীর একেবারে শেষ প্রান্তে। অর্থাৎ এই তার টেনে মীড় বাজানো সম্ভব নয়।
খরজ ইত্যাদি মিলিয়ে আরো ছয় থেকে আটটি তার এতে আছে, যেগুলো বাঁ হাতে বাজাতে হয় না, ড্রোন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক সেতারে এতগুলো তার থাকে না এবং পটরীর মধ্যভাগেই তারগুলো শেষ হয়ে যায়। বাকী অংশ খালি রাখতে হয় বাজ তার বা মূল তার বা হাতে টেনে মীড় বাজানোর জন্য ।
চিত্র – ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত সলভিস অঙ্কিত চওড়া দণ্ডবিশিষ্ট সেতারের ছবি।
সলভিস তাঁর দেখা সেতার সম্পর্কে ভাল মন্তব্য করেন নি। বাদকদের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন- “এরা মাঝে মাঝে এক পর্দা থেকে অন্য পর্দায় হাত সরিয়ে সুর বাজায়, এর চেয়ে একজন ইউরোপীয় লোকের হাতে দিলে যন্ত্রটি আরো ভাল বাজাতে পারতো। ”
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, দিল্লীর রাজদরবারে যে ধরণের সেতারের পরিচয় পাওয়া যায় এটি সে ধরণের সেতার নয়।
চিত্র দেখেও বোঝা যায় যে এই সেতার মীড় বাজানোর উপযোগী নয়। সম্ভবত এই যন্ত্র গৎ- তোড়া বাজিয়ে একক বাদন পরিবেশনের উপযোগী ছিলো না। উন্নতমানের নিজস্ব ঘরানার স্টাইলে সংগীত পরিবেশন বলতে আমরা যা বুঝি তার পরিচয় পাওয়া যায় মসিত বার বাজে। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত শরমাইয়া-ই-ইশরাত’ গ্রন্থে দিল্লী বাজের কথা বলা হয়েছে। মসিত বা এই স্টাইলে বীণকারদের মত বাজনা বাজাতেন মীড়, ঠোক এবং ঝালা সহকারে।
‘সংগীত সুদর্শন’ গ্রন্থে সুদর্শন শাস্ত্রী লিখেছেন, মসিত বা তাঁর পিতার কাছ থেকে সেতার বাদন শিক্ষা লাভের পর সেতার যন্ত্রকে অনেক পরিশীলিত করেছেন। পরিশীলিত করার ফলেই তাতে ধ্রুপদ অঙ্গ তথা বীণের কারুকাজ উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। সুকির খাঁ এবং জঙ্গী খাঁর হাতে যে ধরণের সেতার দেখা গেছে তা সম্ভবত এই ধরণের সেতার। কারণ চিত্র দেখেই বোঝা যায় যে, এতে মীড়, গমক ইত্যাদি বাজানোর সুযোগ রয়েছে।
অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দী সেতারের ইতিহাসের জন্য খুব গঠনমূলক একটি সময়। এ সময়ে সেতার বাদকের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অগণিত পেশাদারী এবং সৌখিন বাদকের হাতে এসে সেতারের দ্রুত বিবর্তন ঘটতে থাকে ।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে সেতার দেখার পর ফ্রাংকয়েস জোসেফ ফেটিস তাঁর “Histoire generale de la musique: depuis les temps les plus anciens jusqu’a nos jours” গ্রন্থে সেতারের তারের বিবরণ দিয়ে বলেছেন এর পাঁচটি মূল তার আছে যেগুলো গলা বরাবর অতিক্রান্ত হয়ে হরিণের হাড়ের তৈরি ব্রিজের উপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে খুঁটিতে আটকানো হয়।
আরো দু’টি তার গলার বাম পাশে বেশ নিচে লাগানো দু’টি খুঁটিতে আটকানো হয়। এই দু’টি তার কিভাবে বাঁধা হয়। তা ফেটিসের ভাষায় শুনলে যথার্থ হবে। “These two harmonize in unison with the notesproduced by the progression of the fingers on the principal strings” স্পষ্টত এখানে চিকারীর তারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসে এটিই সেতারে চিকারীর তারের সর্বপ্রথম বিবরণ।
১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ করম ইমাম রচিত “মাদান- আল-মসিকী’ গ্রন্থে বিখ্যাত সব সেতার বাদকদের সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এ সকল বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, এ সময়ের মধ্যে সেতার অত্যন্ত উন্নতমানের যন্ত্রে পরিণত হয়েছিলো। বিশেষ করে জয়পুরের সেনিয়াদের হাতে এর প্রভূত উৎকর্ষ সাধিত হয়। এরপরও ধ্রুপদ অঙ্গের বিস্তারিত আলাপচারী, যা সাধারণত বীপে বাজানো হতো, তা তখনকার সেতারে বাজানো সম্ভব ছিলো না।
সেজন্য দেখা যায়, ‘সুরবীণ’ নামে একটি যন্ত্র এবং ‘বীণ-সিতার’ নামে অপর একটি যন্ত্র সে সময় আবির্ভূত হয় আলাপচারীর প্রয়োজন মেটাতে। ‘সুরবীণ’ ছিলো রুদ্র বীণা এবং সেতারের সমন্বয়। বীণ-সিতার’ যন্ত্রে তিনটি তুম্বা এবং তরফের তার ব্যবহৃত হতো। তবে এ যন্ত্রগুলোর কোনটি স্থায়ীত্ব লাভ করে নি।
বরং আরেকটি যন্ত্র এ সময়ে আবিষ্কৃত হয়, যার নাম ‘সুরবাহার’, এ যন্ত্রটি পরবর্তী সময়ে বেশ দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সুরবাহারে তরফের তার ছিলো, প্রাচীন সেতারে ছিলো না। এটি ছিলো সেই সময়ে সেতারের সাথে উল্লেখযোগ্য একটি পার্থক্য।
চিত্র – সুরবাহার
বীণ-সিতার, সুরবাহার ইত্যাদি যন্ত্র নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি সেতার যন্ত্রে পরিমার্জনা অব্যাহত থাকে। একে আলাপচারীর উপযুক্ত করে তোলার জন্য গবেষণা হতে থাকে। সুনিরা কাশলিওয়ালের রচনা থেকে জানা যায়, ঊনবিংশ শতকের শেষ অর্ধাংশের কোন সময়ে সেতারে তরফের তার সংযোজিত হয়। এ সময়ে সেতারের আকারও আগের চেয়ে বড় হয়। জয়পুরের সেতারীরা তিন তুম্বা বিশিষ্ট সেতার বাজাতেন।
তবে পরিবর্তন ও পরিশোধনের শেষ পর্যায়ে এসে একটি তুম্বা কমে গিয়ে শেষ পর্যন্ত দু’টি তুম্বা অবশিষ্ট রইলো। একটি হলো দেহের মূল অংশ এবং অপরটি হলো একটি ছোট লাউ যা দণ্ডের প্রায় শেষ প্রান্তে সংযুক্ত থাকে। এটি স্ক্রুর সাহায্যে সংযুক্ত থাকে, প্রয়োজনে খুলে ফেলা যায়। এ সমস্ত পরিবর্তন এবং পরিশোধনের একটি মূল উদ্দেশ্য ছিলো বীণ অঙ্গের প্রায় সমস্ত বৈশিষ্ট্য সেতারে বাদনের উপযোগী করে তোলা।
বর্তমানে এই উদ্দেশ্য সফল বলা চলে। এক সময়ে রেওয়াজ ছিলো এ রকম যে, শিল্পী প্রথমে সুরবাহার যন্ত্রে আলাপ বাজতেন, পরে সেতার নিয়ে বসে গং, তান ইত্যাদি বাজিয়ে পরিবেশনা শেষ করতেন। বর্তমানে আর তেমন করা হয় না। সেতার যন্ত্রটি এখন আলাপ বাজানোর জন্য খুব উপযুক্ত। একই যন্ত্রে প্রথমে আলাপ, জোড় আলাপ ইত্যাদি বাজিয়ে পরে গৎ, তান, ঝালা ইত্যাদি বাজানো হয়।
বিশেষ করে আধুনিক যুগের শিল্পীদের মধ্যে পণ্ডিত রবি শঙ্করের বাদন শৈলীর কথা উল্লেখ না করলে এতদসংক্রান্ত আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সেরা শিষ্যদের অন্যতম পণ্ডিত রবি শঙ্কর। সেনীয়া ঘরানার মূল বৈশিষ্ট্য আলাপচারীর কাজ। বিস্তারিত আলাপচারীর কাজ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ঘরানারও মূল বৈশিষ্ট্য। আলাপচারীর সমস্ত শিক্ষা ওস্তাদ আলাউদ্দিন বা দিয়ে গেছেন। শিষ্য রবি শঙ্করকে।
রবি শঙ্কর মূল তারে বাদনের পরে খরজের তারে অর্থাৎ খাদে মীড় পরিবেশনের মাধ্যমে যেভাবে সুরবাহারের বৈশিষ্ট্যে আলাপ পরিবেশন করে থাকেন তা নিঃসন্দেহে অসাধারণ। আলাপে সুরবাহারের যে বৈশিষ্ট্য, শ্রোতারা সেটি যেমন পেয়ে থাকেন, তেমনি সেতারে বাজানো গ তানের কাজও শ্রোতারা উপভোগ করে থাকেন। অর্থাৎ একটি যন্ত্রের পরিবেশনা থেকে পূর্ণতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন শ্রোতারা। ইতিহাসের আলোকে বলা চলে বর্তমানে প্রচলিত সেতার হচ্ছে এই যন্ত্রের সবচেয়ে সমৃদ্ধ রূপ ।
আরও দেখুন :