আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় দেশাত্মবোধক ব্যঙ্গগীতি
দেশাত্মবোধক ব্যঙ্গগীতি
দেশাত্মবোধক ব্যঙ্গগীতি
গানের কথায় ব্যঙ্গ প্রকাশ করে দেশপ্রেমমূলক কিছু গান রচনা করেছেন তিনি যা মূলত দেশাত্মবোধক ব্যঙ্গগীতি বলে পরিচিত। অন্তরে বিদ্রূপের ব্যঙ্গ আঘাত করে মনকে দেশহিতে জাগ্রত করাই মূলত এ ধরনের গানের মূল উদ্দেশ্য। কবি ঈশ্বরগুপ্ত মূলত এ ধারার গানের প্রবর্তক। অতিপাশ্চাত্যগীতি, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি অবহেলা, কুসংস্কার, ভণ্ডামিসহ যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি এবং ইংরেজ পোষণের ও তোষণের উপর তির্যক আঘাত করাই দেশাত্মবোধক ব্যঙ্গ গানের মূল কাজ।
“সুপার (জেলের)
বন্দনা তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে, তুমি ধন্য ধন্য হে।
আমার এ গান তোমারই ধ্যান, তুমি ধন্য ধন্য হে ॥
হুগলী জেলে বসে মূর্তিমান জুলুমবাজ কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে এ ব্যঙ্গ গানটি রচনা করেন কবি। এ গানটির সুর রবীন্দ্রনাথের গান ‘তোমারই গেহে পালিছ স্নেহে’-এর অনুকরণে রচিত। আ-কাঁড়া চাউলের ভাত, বুড়ো ডাঁটার সজনী খেয়ে কারাবন্দীদের কষ্টর জীবনের গল্প এ গান। ‘ভারতে যাহা দেখিলাম শিরোনামে নজরুল দীর্ঘ দুটি অংশে বিভক্ত একটি ব্যঙ্গ গান রচনা করেন। এ গান প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে যে নজরুলের এ গানটির শিরোনামও ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস।
“একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ব্যঙ্গ গান। সাইমন কমিশন বর্জন করার পর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ভারতের নতুন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ১৯২৮ সালের মে মাসে দিল্লিতে এক সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করে। সম্মেলনে পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুকে প্রধান করে শাসনতন্ত্র রচনা কমিটি গঠিত হয়। নেহেরু কমিটি নামে পরিচিত এই কমিটি ব্রিটিশ রাজমুকুটের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে ডোমিনিয়ন স্টেটাস পাবার মতো করে শাসনতন্ত্র রচনা করেন।
এছাড়াও নজরুলের আরো কিছু ব্যঙ্গাত্মবোধক দেশপ্রেমের গান রয়েছে—
ক. “ঐ তেত্রিশ কোটি দেবতাকে তোর তেত্রিশ কোটি ভূতে
আজ নাচ রুটটি নাচায় বাবা উঠতে বসতে শুতে!….
খ. “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছ জুয়া ।
ছুঁলেই তোর জাত যাবে ? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া ॥
গ. দোহাই তোদের। এবার তোরা সত্যি করে সত্য বল।
ঢের দেখালি ঢাক ঢাক গুড় গুড় ঢের মিথ্যা হল ।
পেটে এক আর মুখে আরেক-এই যে তোদের ভণ্ডামি,
এতেই তোরা লোক হাসালি, বিশ্বে হলি কম-দামি।
এই সকল গানের ভিতর দিয়ে কবি স্বজাতিকেই ব্যঙ্গ করেছেন, আঘাত করার অভিপ্রায়ে। কারণ আঘাত করলে টনক নড়বে বিশ্বাসে কবি ভারতের তেত্রিশ কোটি জনগণকে তেত্রিশ কোটি ভূত বলে ব্যঙ্গ করেছেন। জাতের নামে বজ্জাতি চলছে সর্বত্র। ‘জাত গেল জাত গেল!’-ভাবনায় ছোঁয়াছুয়ির ছোট্ট ঢিলে সম্প্রীতিবোধ যাবে রসাতলে। তাই কবি এই বজ্জাতিকে জাহান্নামে পাঠাবার বাসনা ব্যক্ত করেন। গানে।
আবার ইংরেজ শোষকশ্রেণিকে কবি কচুরিপানার সাথে তুলনা করেছেন। এক জীবনের দুশমনে গলার সাথে। তাই কবি এই ভেসে আসা অপ্রত্যাশিত কচুরিপানাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে জঙ্গল সাফ করতে বলেছেন।

কবি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধের ব্যঙ্গগীত রচনা করেন। যেমন আমরা দেখতে পাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশপর্যায়ের কিছু গানেও। নজরুল আরো একটি বিখ্যাত গান রচনা করেন ১৯৩১ সালে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনের উদ্দেশ্যে ইংরেজ কর্তৃক আহুত গোল টেবিল বৈঠকের বিরুদ্ধে।
বদনা গাড়ুতে গলাগলি করে, নব-প্যাক্টের আশনাই।
মুসলমানের হাতে নাই ছুরি, হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই
এ গানটিও একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যঙ্গগীতি।
১৯২৩ সালের দিকে সিরাজগঞ্জের প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। মৌলানা আকরাম খাঁ এতে সভাপতিত্ব করেন। এই অধিবেশনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কংগ্রেসের ভেতরে গঠিত স্বরাজ পার্টির পক্ষ থেকে হিন্দু-মুসলমান প্যাক্ট বিষয়ে একটি প্রস্তাব পাস করেন। এই প্যাক্টে সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অধিক সংখ্যক চাকরিদানের প্রস্তাব রাখা হয়।
এছাড়া মুসলমানদের আরো কিছু সুযোগ দানের প্রস্তাব এতে থাকে। এই প্যাক্ট অবলম্বনে নজরুল উল্লেখিত গানটি রচনা করেন। ১৯৯ সমুদয় আলোচনার মধ্যদিয়ে নজরুলের দেশাত্মবোধক গানের এক অসামান্য অবদানের দ্বার উন্মোচিত হলো যা তাঁর সৃষ্টি জীবনের একটি অপরিসীম গুরুত্ববাহী অধ্যায়। নজরুল ইসলামের দেশাত্মবোধক গান আজ বাংলার যে কোনো সংকট উত্তরণের শিল্পীমনের প্রধান হাতিয়ার হয়ে প্রতিরোধ করে মানুষের বিনাশী ভাবনাকে।
আরও দেখুন :