আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় দ্বিজেন্দ্রনাটকের গানে স্বদেশচেতনা
দ্বিজেন্দ্রনাটকের গানে স্বদেশচেতনা
দ্বিজেন্দ্রনাটকের গানে স্বদেশচেতনা
দ্বিজেন্দ্রলাল একজন বড়মাপের নাট্যকার ছিলেন। চিত্তকে দোলায়িত করতে সংগীতের মাধুর্য ভিন্ন মাত্রার; এর শক্তি অপরিসীম। অন্যদিকে মানবমনের অন্তরীণ রহস্যের সন্ধান করে তাতে রূপ আভরণ দেওয়াই অভিনয়ের পারদর্শিতা। অভিনয় নাটকের প্রাণ আর গান সেই প্রাণকে জাগ্রত করে।
নাটকের মাধ্যমে সমকালীন যুগভাবনাকে সহজে ধরতে পারা যায় এবং মানুষের মনে রূপকতার মধ্যদিয়ে বাস্তবিক দৃষ্টির ইঙ্গিত প্রদান করা যায় আর তাতে গান সংযুক্তি হলে কাজটি আরো সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও এই কাজটি করেছিলেন খুবই নিপুণভাবে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সারাদেশে যে স্বদেশ প্রেমবোধ জাগ্রত হয়েছিল তারই গোড়াপত্তনে কাজ করেছিল।
দ্বিজেন্দ্রলাল রচিত স্বদেশিভাবমূলক নাটক ও গান। নূরজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল বিজয়, মেবার পতন ইত্যাদি নাটকের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এই সকল নাটকের সংযুক্ত স্বদেশি সকল গান মানবমনে বলিষ্ঠ দেশপ্রেম ও উদ্দীপনা জাগ্রত করত। শুধু তাই নয় তাৎক্ষণিক গান বা কবিতা রচনাতেও তিনি। সিদ্ধহস্ত ছিলেন-
“ইতিমধ্যে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন সারা দেশে নতুন করে জাগিয়ে দেয় বাঙালির দেশাত্মবোধ। তার প্রতিক্রিয়ায় কলকাতার রঙ্গমঞ্চ উত্তাল হয়ে ওঠে দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক ও জাতীয়তাবাদী নাটকের আবেগে। তিনি পরপর লেখেন প্রতাপ সিংহ (১৯০৫), দূর্গাদাস (১৯০৬), নূরজাহান (১৯০৮), মেবার পতন (১৯০৮), সাজাহান (১৯০৯) ও চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১)।
এসব নাটকে তাঁর অসামন্য স্বদেশী গানগুলি সংযোজিত হয়ে এক নতুন মাত্রা আনে। বিশ্বাসের ঐকান্তিকতা, ভাবের গাঢ়তা এবং সুরের নাটকীয় চলন তাঁর স্বদেশী গানে এক অভিনব চমৎকৃতি সৃষ্টি করল। বাঙালি লাভ করল এক নতুন বর্গের ওজস্বী গানের উত্তরাধিকার।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের সম্ভার পাই মূলত তাঁর নাটকের গানের ভাণ্ডার হতে। এক অভিনব পরিশীলিত ভঙ্গিতে কথা ও সুরের যুগপৎ মিলন ঘটিয়েছেন তাঁর গানে। যে সকল গান পাঠকের হৃদয় হরণ করে সবগুলোই নাটকের উদ্দেশ্যে রচিত গান। কবি ও গীতিকার হিসেবে প্রথম জীবনে তাঁর বিকাশ ঘটলেও পরবর্তীকালে মূলত তিনি নাটক রচনার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েন। নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলালই তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছিলেন অত্যন্ত সফলভাবে।
আর যে গানগুলো হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে, চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছে তার সবটাই প্রায় নাটকের প্রয়োজনে রচিত। তাই গানে সুরে এবং অভিনয়ের সমন্বয়ে তাঁর নাটকগুলো পেয়েছিল এক অন্য মাত্রা। সেই সময়ের উত্তাল ভাবনাকে জাগ্রত করতে তাঁর এই স্বদেশপ্রেমপূর্ণ গানসমেত অভিনয়মালায় যে ভাণ্ডার তিনি দর্শক। শ্রোতাদের দিয়েছিলেন তা কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে চিরকাল।
স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত সমকালের বাংলাগান ও রবীন্দ্রসংগীত গ্রন্থের সহায়তায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রচিত নাটক ও গানের একটি কালানুক্রমিক ছক নিচে দেওয়া হলো। এতে নাটকের সাথে স্বদেশ প্রেমানুভূতি জাগানিয়া গানসহ নাটকের প্রয়োজনে রচিত অন্যান্য পর্বের উল্লেখযোগ্য কিছু গানের উদাহরণ তুলে ধরা হলো-
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক ও গানের কালানুক্রমিক তালিকা
পারিবারিকভাবেই সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তাঁর সংগীত ও সাহিত্যজীবনের বিকাশ লাভ ঘটে পিতা, অগ্রজ ও অনুজদের অনুপ্রেরণায়। তাছাড়া বাল্যকাল থেকে সংগীতে তাঁর বিশেষ আসক্তি ছিলো। কার্তিকেয়চন্দ্র রায় সুবিখ্যাত গায়ক ছিলেন। শাস্ত্রীয় সংগীতের উপর তাঁর প্রগাঢ় দখল ছিলো। সেই দিক থেকে দ্বিজেন্দ্রলালের শৈশব কাল থেকে বড় বড় ওস্তাদদের গান শোনার সুযোগ হয়েছিল।
তাঁর পিতাও হিন্দুস্থানী সংগীতের গায়ক ছিলেন, যে কারণে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতি সকাল শুরু হতো ভৈরো, আশাবরী ইত্যাদি সুরের মূর্ছনার মধ্যদিয়ে। এই অর্জিত ও সঞ্চিত সুরের মায়াজালেই তিনি বেঁধেছিলেন তাঁর জীবনের সংগীত রচনার ভাণ্ডারকে। পরবর্তী সময়ে বিলেতে বসবাসকালে পান বিদেশি সুরের উন্মাদনার অনুসন্ধান।
তাই তাঁর গানের সুরে পাই দেশি-বিদেশি সুর সম্মিলনে এক অভিনব ও ব্যতিক্রমী সুর মূর্ছনা। সে সুর শুনলেই খুঁজে পাওয়া যায় এক বিশেষ স্বকীয়তার আভাস। স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন-
“আমাদের বাড়ি ছিলো হিন্দুস্থানী গানের একটি প্রধান মজলিশ, আম দরবার। আশৈশব, বড় বড় ওস্তাদ কবিকে গান শোনাতে আসতো। গান শোনাতে পেলে ধন্য হয়ে যেত, তাঁর মুখের একটি বাহবা পেলে তারা সেলাম ঠুকে ঠুকে অস্থির । কবি হিন্দুস্থানী গানের মর্মে প্রবেশ করেন কৈশোরেই তাঁর পিতৃদেবের খেয়াল শুনে শুনে। কিন্তু তারপর তিনি খুব বেশী ভক্ত হয়েছিলেন বিলিতি গানের।
সুরেন্দ্রনাথই তাঁকে ঘরের ছেলে করে ঘরে ফিরিয়ে আনেন অর্থাৎ ভারতীয় গানের নিজস্ব ক্ষেত্রে। দ্বিজেন্দ্রলালের রচিত সংগীত ভাণ্ডারে যে সকল অঙ্গের গান পাওয়া যায় তা মূলত সুরের বা ছন্দের দিক থেকে খেয়ালাঙ্গের গান, টপ্পা অঙ্গের গান, হালকা ছন্দের মিশ্রণ রীতির গান এবং কীর্তন ও বাউল অঙ্গের গান। পারিবারিক বলয়সহ তৎকালীন বিখ্যাত খেয়াল গায়ক অন্ধশরৎ ও সুরেন মজুমদারের কাছে পান প্রাচ্য সংগীতের তালিম ও আত্মপ্রস্তুতির পন্থা।
অন্যদিকে বিলেতি সুর অর্থাৎ স্কচ, আইরিশ এবং ইংরেজি গানের অভিনব সুর প্রক্ষেপণের ভাবনাতে তিনি ছিলেন মুগ্ধ। তাঁর সামগ্রিক সংগীত রচনার সুরে এ সকল পন্থার মিল থাকলেও স্বদেশি গানের সুরে তিনি নিয়েছেন মূলত রবীন্দ্রনাথেরই মতো সহজ ছন্দের দেশীয় সুর অর্থাৎ কীর্তন-বাউলের সুর এবং মার্চ বা প্যারেডের ভাবনাটি। বাংলা স্বদেশি গানের সুরে যে এক অভিনবত্বের প্রকাশ মেলে তিনি তা গ্রহণ করেন বিদেশি গানের সুরের ভঙ্গি থেকে। স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন-

“দ্বিজেন্দ্রলালের গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য, তাঁহার সুরের গতিশীলতা (Dynamic force) ও জঙ্গমতা (Elasticity)। তাঁহার গানকে বাধা সুরের দৃঢ়বদ্ধ বাঁধনের মধ্যে রাখা যায় নাই, তাঁহার সুর মুক্ত পক্ষীর মতো সুদূর আকাশে বিহার করিয়া আবার নীড়ে ফিরিয়া আসিয়াছে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান রাগসংগীতের আধারে রচিত হলেও কোনো একটি বিশুদ্ধ রাগ সেই গানের পরিচয় নয়।তাঁর প্রতিটি গানই স্বাধীন। তাই রাগ-রাগিণীর গাম্ভীর্যের ভারে তাঁর কোনো একটি গানও ম্রিয়মান নয়।
আরও দেখুন :