দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশভাবনা

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশভাবনা

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশভাবনা

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশভাবনা

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশভাবনা

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নিজের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেন, ইতিহাসে নাম লেখান পঞ্চগীতিকবির একজন হিসেবে। স্বরচিত রচনাশৈলী ও স্বদেশপ্রেমের গান রচনার এক ব্যতিক্রমী ও উজ্জ্বল নক্ষত্র দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। একজন সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে অন্যান্য অফিসারের মতো কেবল দায়িত্বের পুনরাবৃত্তির পক্ষে তিনি ছিলেন না।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, স্বদেশের মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে বহু ধিক্কার ও ভর্ৎসনার শিকার হয়েছেন তিনি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে দেশপ্রেমী এই বাঙালিকে তাঁর ২০ বছরের চাকুরি জীবনে ১৫ বার স্থানান্তর হতে হয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নিজেই তাঁর স্বদেশভাবনা সম্পর্কে নিচের বক্তব্য তুলে ধরেছেন-

“আমার পূর্ববর্তী সেটেলমেন্ট অফিসারেরা জরীপে জমি বেশী পাইলেই খাজনা বেশী ধাৰ্য্য করিয়া দিতেন। আমি সুজামুটা সেটেলমেন্টে এই অভিপ্রায় প্রকাশ করি যে, এরূপ খাজনা বৃদ্ধি করা অন্যায় ও আইন-বিরুদ্ধ। প্রজার সহিত যখন পূৰ্ব্ব জমি বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া হয়, তখন মাপিয়া দেওয়া হয় না, আন্দাজ করিয়া সেই জমির পরিমাণ হস্তবুতে লেখা হয়।

এমন কি এরূপ হওয়া সম্ভব যে, সেই জমি এখন জরীপে তাহা অপেক্ষা অধিক বলিয়া প্রতীত হইতেছে মাত্র। তাহার জন্য তাহার নিকট বেশী খাজনা চাওয়া অন্যায়। অতএব রাজ্য যদি বেশী জমির জন্য বেশী খাজনা দাবি করেন, ত তাঁহার দেখাইতে হবে যে, প্রজা কোন বেশী জমিটুকু অধিকার করিয়াছে। আরও ড্রেনেজ খাল বন্ধ হওয়ায় জমির বাৎসরিক ফসল কম হইয়া যাওয়ার জন্য আমি প্রজাদিগের খাজনা কমাইয়া দিই।

ঐ রায় হইতে জজের নিকট আপিন হয় এবং তাহাতে জর্জ সাহেব উক্ত রায় উল্টাইয়া প্রজাদিগের খাজনা বৃদ্ধি করিয়া দেন। এই সময়ে স্যার চার্লস এলিয়ট বঙ্গদেশের লেফটেন্যান্ট গবর্ণর ছিলেন। তিনি উত্তরূপ বিভ্রাট দেখিয়া উক্ত বিষয় তদন্ত করিতে স্বয়ং মেদেনীপুর আসেন ও কাগজপত্র দেখিয়া আমাকে যথোচিত ভর্ৎসনা করেন। আমি আমার মত সমর্থন করিয়া বঙ্গদেশীয় সেটেলমেন্ট আইন বিষয়ে তাহার অনভিজ্ঞতা বুঝাইয়া দিই।

ছোট লাট ক্রুদ্ধ হইয়া আমার পূর্ব্ব ইতিহাস জানিতে চাহেন ও তাহা অবগত হইয়া কলিকাতায় গিয়া ভবিষ্যতে সেটেলমেন্ট অফিসারদের কর্তব্য বিষয়ে এক দীর্ঘ মন্তব্য প্রকাশ করেন, তখনই তাহাই আইনে ঢুকাইয়া দেন; এবং কিছুদিন পরে আমার প্রমোশন বন্ধ করেন। ইত্যবসরে জজের রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল হয়।

হাই কোর্ট জজের রায় উল্টাইয়া আমার মতের সহিত ঐক্য প্রদর্শন করেন এবং সেই হাই কোর্ট রুলিং অনুসারে এখন সমস্ত বঙ্গদেশে সেটেলমেন্ট কাৰ্য্য চলিতেছে। এখন জরীপে জমি বেশী পাইলেই প্রজার অমতে আর খাজনা বৃদ্ধি হয় না। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বব্যক্ত এই উক্তির মধ্যদিয়ে মূলত এক অন্যায় আপসহীন দেশপ্রেমী যুবকের সন্ধান পাই।

অত্যন্ত বিচক্ষণ, আবেগী, একগুঁয়ে ও মেধাবী দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দেশবাসীর নির্বুদ্ধিতার প্রতিবাদস্বরূপ প্রহসন রচনা ‘একঘরে’ প্রকাশ করে তীব্র আক্রোশের শিকার হন। বিলেত ফেরত দ্বিজেন্দ্রলালকে কালাপানী পার হওয়ার অপরাধে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেন তাঁর স্বজন ও তথাকথিত সমাজরক্ষকেরা। তিনি তা করতে রাজি না হলে তাঁকে সমাজচ্যুত করা হয়।

এর কঠোর প্রতিবাদস্বরূপ সমাজপতিদের ব্যঙ্গ করে তিনি রচনা করেন ‘একঘরে’ নামক প্রহসন রচনাটি। অত্যন্ত নিপুণ ও প্রাসঙ্গিক এই প্রহসন রচনা সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেন, ‘ইহার ভাষা ঠাট্টার ভাষা নহে। ইহার ভাষা পদদলিত ভূজঙ্গমের ক্রুদ্ধ দংশন, ইহার ভাষা অগ্নিদাহের জ্বালা।” সহজ সাদাসিদে জীবনের অধিকারী ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলার রায়।

ধর্মীয় ভণ্ডামি ও গোড়ামীকে তিনি তীব্র কষাঘাত করেছেন তাঁর এই ‘একঘরে’ প্রহসনের মাধ্যমে। এটির অংশবিশেষ নিচে দেয়া হলো –

“নদীতীরে কাঁচা পাকা বাড়ী কয়খানা-

অধিকাংশ চালাঘর। ময়লার খনি

জীর্ণ গলি। ওই সব মিষ্টান্ন বিপনি!”

তিনি অবিরামভাবে কবিতা, গান, নাটক, প্রহসন রচনা করেছেন। প্রতিটি রচনাই তাঁর স্বকীয়তা ও নতুন ধারার স্বাক্ষর বহন করে।
ব্যক্তি জীবনেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ। নিজের ভাবনার কাছে কখনো আপস করেননি তিনি। ছোটবেলা থেকেই সমাজ যা কিছু চাপিয়ে দিতে চেয়েছে তাই তিনি বর্জন করেছেন। বিবেককে তিনি সবচেয়ে বড় বন্ধু মনে করতেন।

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশভাবনা

 

বিবেকের সাড়া পেলে তিনি সমাজের অনুমতির তোয়াক্কা করতেন না। লেখনি সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তাঁর এই বলিষ্ঠ রূপটি পরিলক্ষিত হয়। সে কারণেই হয়তো বলিষ্ঠ ও বিদ্রোহী কবি শেলী ছিলেন তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ঐশ্বরিক ক্ষমতার বিরুদ্ধেও মানব বিদ্রোহের জয়গান গেয়েছেন শেলী। শেলীর মতো পার্থিব কবিদের অনুপ্রেরণা মূলত তাঁর কবিতার স্বদেশপ্রেমবোধ অর্থাৎ কবিমানস গঠনে সহায়তা করে। তাই রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠির উত্তরে পাই তাঁর বলিষ্ঠ উচ্চারণ :

“আমি ক্ষুদ্র মানুষ, সামান্য জীব যত দূর সাধ্য সংসারের দূষিত বায়ুতে স্বীয় চরিত্র অকলঙ্কিত রাখিব, তাহাতেই সন্তুষ্ট হইয়া চলিয়া যাইব, এই বাসনা। … আমি শৈশব হইতেই সমাজের আজ্ঞাকে তুচ্ছ করিতে শিক্ষিত হইয়াছি। এখনও বিবেকের নিকট সমাজের আজ্ঞাকে তুচ্ছ করি, ও আশা করি চিরকাল করিতে পারিব, আমি যাহা বিবেকানুমোদিত মনে করি, তাহাতে সমাজের সম্মতির জন্য অপেক্ষা করি না ও বোধ হয় কখন করিব না।

ইহার জন্য হয়ত আমাকে অনেক অন্যায় অত্যাচার সহিতে হইবে। তাহা ধীরতার সহিত সহিব মনে করিয়াছি। শেলীর ঐ কয়েক ছত্র আমার জীবনে অন্ততঃ কিছুও পরিবর্তন করিবে আশা করি। এই বলিষ্ঠতা ও আত্মমর্যাদাবোধ তাঁর জীবনের কাল হয়ে উঠেছিলো। বিলেত থেকে ফিরে ছোট লাটের সাথে সাক্ষাৎকালে তাঁর প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ মূলত ছোট লাটের বিশেষ পছন্দ হয়নি। কারণ

‘নেটিভসুলভ বিনয়’ দ্বিজেন্দ্রলালের মধ্যে কখনই ছিলো না। তাই প্রবল মর্যাদাবোধ ও স্পষ্টবাদিতার কারণে দ্বিজেন্দ্রলাল কখনই তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি করতে পারেননি। বরং তিনি জীবনভর ভোগ করেছেন এক স্থান হতে অন্যত্র ক্রমাগত বদলির বিড়ম্বনা। ফলে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় তিনি স্থিত হতে পারেননি। তাঁর সংস্কৃতিমনা-সাহিত্যপিপাসু মন বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।

যে কারণে গর্ভনমেন্টর কালেক্টর হওয়া সত্ত্বেও চাকরির প্রতি তাঁর কোনো মায়া ছিলো না। দেশভক্তির নাটক রচনা ও গানের কারণে গর্ভনমেন্টের কাছে তিনি বড্ড অপ্রিয় ছিলেন। সমগ্র চাকরিজীবন তাঁর অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক ছিলো বলেই এই অস্থিরতায় তাঁর সাহিত্য রচনাতেও তিনি মনোযোগী হতে পারেননি, বরং উদাসীন ছিলেন অনেকাংশেই। কর্মজীবনের সব জটিলতা তাঁকে তাঁর রচনায় স্থির হতে দেয়নি।

চাকরির এক বছর অর্ধবেতনে ছুটির দরখাস্ত তাঁর ক্ষেত্রে হয় বরখাস্ত । অনেকবার তিনি উদ্ধৃত করেছেন, ‘যৎসামান্য বেতন ও একটু ভদ্র ব্যবহার পাইলেই আমার এ বাকি দিন কয়টা কোন মতে কাটিয়া যাইবে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কবি এই মর্যাদাহানির চাকরিকে জীবন বৃথা হয়ে যাবার কারণ বলে ব্যক্ত করেছেন। কর্মজীবনে হয়রানি তাঁর শিল্পীসত্তাকে বারংবার আঘাত করেছে।

ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে তাঁর দেশভক্তিমূলক নাটক ও গানসমূহ জনপ্রিয়তা পায় এবং জনমনে দেশপ্রেমের উদ্রেক করে- এসবই মূলত তাঁর প্রতি ব্রিটিশ সরকারের মানসিক অত্যাচারের কারণ। এই বিষয়টি অনুভব করে তিনি লিখেছেন :

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

“ক্রমাগত এই ট্রান্সফার আমাকে যথার্থই যেন অস্থির করে তুলেছে। এত বদলী কচ্ছে কেন জান? আমার বিশ্বাস স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান আর ঐ ‘প্রতাপসিংহ’ নাটকই তার মূল। কিন্তু, কি বুদ্ধি! এমনি একটু হয়রান কলেই বুঝি আমি অমনি আমার সব মত ও বিশ্বাসকে বৰ্জন কৰ্ব্ব?”

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন নিজেস্ব ভাবনায় অটল এক চিরসবুজ দেশপ্রেমিক। এতো অত্যাচারেও তিনি নিজস্ব মতের বাইরে দাঁড়াননি। বরং শেষ জীবনে এই চাকুরি ছাড়তে বাধ্য হন।

আরও দেখুন :

Leave a Comment