আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় দ্বিজেন্দ্র কাব্যপ্রবাহে স্বদেশচেতনা
দ্বিজেন্দ্র কাব্যপ্রবাহে স্বদেশচেতনা
দ্বিজেন্দ্র কাব্যপ্রবাহে স্বদেশচেতনা
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতাসমূহে স্বদেশি আন্দোলনের উত্তেজনার পটভূমিতে কবি মানসের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই। যদিও কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপ্তি বিশাল না হলেও বাংলা কাব্যজগতে দ্বিজেন্দ্রলাল একটি বিশেষ নাম। রবীন্দ্র সমযুগের হওয়া সত্ত্বেও কবি মানসের এক স্বতন্ত্র রূপ ও অনন্য ভঙ্গি দেখা দেয় দ্বিজেন্দ্রলালের কবিতায়।
রবীন্দ্রনাথ যে বছর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান সেই বছর অর্থাৎ ১৯১৩ সালে ডি.এল. রায় মৃত্যুবরণ করেন। রবীন্দ্রনাথের থেকে বয়সে দুই বছরের ছোট হওয়া সত্ত্বেও এত ক্ষণজন্মা ছিলেন তিনি যে তাঁর কাব্যপ্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ আমরা দেখতে পাইনি। বিলেত থেকে ফিরে প্রথম জীবনে তিনি রচনা করেছিলেন ‘দি লিরিক্স অব দি ইন্ড’ নামের একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ।
এছাড়াও তিনি বাংলায় আরো সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই স্বল্প পরিসরের রচনার মধ্যদিয়েই তিনি তাঁর কবি প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথ রায়ের দ্বিজেন্দ্রলাল কবি ও নাট্যকার গ্রন্থে বিশ্লেষণ করে বলতে পারি। দ্বিজেন্দ্রলালের সমগ্র কবি জীবনকে মোটামুটি তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যেমন-
ক) আর্যগাঁথা (প্রথম ভাগ) ও ইংরেজি কাব্য নিয়ে কবি জীবনের উন্মেষপর্ব’। খ) আর্যগাথা (দ্বিতীয় ভাগ) ও কবি জীবনের বিকাশপর্ব’ যা কবি জীবনের দ্বিতীয় স্তর। গ) পরিণতি পর্ব বা কবি জীবনের তৃতীয় স্তর।
দ্বিজেন্দ্রলাল কবি জীবনের প্রথমপর্বের রচনাকালে জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮২) প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মূলত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই স্বদেশি আন্দোলনের প্রকৃত বীজ রোপিত হয়। তাই এর পূর্ববর্তী সময়ে অর্থাৎ ‘আর্যগাথা’র প্রথমপর্বের রচনাতে জাতীয়তাবোধ প্রকৃত অর্থে পাখা মেলেনি। তাঁর স্বদেশপ্রেমের কবিতাগুলোও ভুল-ত্রুটিতে পূর্ণ ছিলো। কারণ অধিকাংশ কবিতাই তখন ইংরেজদের মহিমা কীর্তনের উপগানে পূর্ণ।
উনিশ শতকে তাঁর রচিত কবিতায় পরিলক্ষিত হয় স্ববিরোধিতা। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই স্বদেশি আন্দোলনে সকলে উদ্বুদ্ধ হয় এবং রচিত হয় স্বদেশি কবিতা-গান। এই আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে। এই সময়ে মূলত প্রেমের গানে কারোরই আগ্রহ ছিলো না। দ্বিজেন্দ্রলালও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাই তিনি রচনা করলেন :

“রেখে দেও রেখে দেও প্রেমগীতি স্বরে রে।
কেন ও কুহক আর ভারত ভিতরে রে।
এটি দেশপ্রেমমূলক কবিতা ‘আর্যবীণা’। এই কবিতার মধ্যদিয়ে কবির স্বদেশি উন্মাদনা প্রথম পরিলক্ষিত হয় এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে স্বদেশি কবিতা-গান মাত্রায় ও ভঙ্গিতে স্বতন্ত্র রূপে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে বিপিনচন্দ্র পালের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা হলো :
“Patriotism is assuming a new shape and meaning among us today. There was the patriotism of a kind among the educated classes thirty or forty years back. It was, however, spitepite of its sincerity and exuberance, such as have left a permanent impression upon the mind and character of the older generations of our political and social leaders,
something positively more outlandish than indigenous, and decidedly more sentimental than real… Our old admiration for Europe has thus been largely supplanted now by an ardent love for our own country. This new love is not, as of old, a vague sentiment and a fairy fancy, such as possesses our hearts when we are under the spell of a great poem or novel,
but something real and true, not merely a subjective attitude but something that yearns for an objective expression and realization, through acts and symbols, as always happens with all real and true love.””
দ্বিজেন্দ্রলালের কবি জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে রচিত স্বদেশপ্রেমের কবিতাগুলোর মধ্যে বীণা বাজিরে কি আর’, ‘জানিনা জননী কেন’, ‘জন্মভূমি’, ‘কেন মা তোমারি’, ‘ভারত মাতা’, ‘জগমন ভারত’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই সকল কবিতার নামকরণের মধ্যেও স্বদেশানুরাগ পরিলক্ষিত হয়। তাঁর একটি দেশপ্রেমমূলক কবিতার অংশ দেওয়া হলো ।
“কি দুঃখ কহ গো মাতৃ লহ এত অপমান
দেখিতে তোমার দুখ, কাঁদে যে আমার প্রাণ।
এই কবিতাগুলোর মধ্যদিয়ে কবির স্বদেশচেতনা উদ্ভাসিত। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অন্যান্য কবিদের মতো দ্বিজেন্দ্রলালের স্বদেশি কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট মূলত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকাল পর্ব। নিজে সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও স্বদেশের পরাধীনতায় অন্তরের শোক এই সকল কবিতার মধ্যদিয়ে প্রকাশ করেছেন। সত্যকে সত্য বলতে কখনও পিছপা হননি তিনি। তাই সে সময়ের স্বদেশমাতৃকার ওপরে তাঁর কবিতা-গান মানুষকে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করছে।
আরও দেখুন :