Site icon Arts and Culture Gurukul [ শিল্প ও সংস্কৃতি গুরুকুল ] GOLN

ধরুপদ রবাব

ধরুপদ রবাব

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় ধরুপদ রবাব। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে উপমহাদেশীয় সংগীতের জগতে রবার অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিগণিত ছিলো। মুগল আমলের শেষ দিকের চিত্রকর্মে এবং প্রাদেশিক এবং পাহাড়ী চিত্রকর্মে রবাবের যে চিত্র পাওয়া যায় তা থেকে বোঝা যায় এর দেহ বেশ বড় আকৃতির, গোলাকার এবং চামড়ার ছাউনি দেওয়া। দেহ এবং গলার মত অংশের মাঝখানে বিশেষ ধরণের কলারের উপস্থিতি আছে।

ধরুপদ রবাব

কলারটি বাঁকানো। গলার শেষ অংশটি ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে খুঁটি আটকানোর জায়গা বা পেগ বক্সে পরিণত হয়েছে এবং এ অংশটি খুব সুন্দর নকশা করা। শেষ অংশটি গোলাকার অথবা চাকার মত ঘোরানো। এটি সরু গলার পেছন দিকে চলে গেছে। এই ধরণের রবাবকে ভারতীয় বা ধ্রুপদ রবাব বলে অভিহিত করা হয়।

 

চিত্র – ধ্রুপদ রবাব

ইতিহাসে এই ধ্রুপদ রবাবের সাথে প্রখ্যাত সংগীত গুণী সম্রাট আকবরের সভা সংগীতজ্ঞ মিঞা তানসেনের নাম জড়িত। মিঞা তানসেনের বংশে এই রবাবের বিশেষ অবস্থানের কারণে এই রবাব সেনিয়া রবাব নামেও পরিচিত। সপ্তদশ শতাব্দীর অনেক চিত্রকর্মে মিঞা তানসেন এবং অন্যান্যদের হাতে সেনিয়া রবাবের বহু ছবি দেখা যায়।

অবশ্য মিঞা তানসেন এবং তাঁর বংশধরধের হতে প্রাচীন রবার অনেকখানি পরিশীলিত রূপ লাভ করেছিলো। তানসেনের পুত্র বিলাস খানের বংশধরেরা ‘রবাবিয়া’ হিসেবে বংশ পরম্পরায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পারসা প্রভাবিত রবাব যন্ত্র এদেশে প্রচলিত হওয়ার পর এদেশীয় ধ্রুপদী সংগীত পরিবেশনের উপযোগী করার তাগিদে এর আকার অবয়ব ইত্যাদিতে পরিবর্তন আসতে থাকে।

ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নানারূপ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই রবাবের জনপ্রিয়তা অব্যাহত থাকে। ইতিহাসখ্যাত বিভিন্ন সংগীতজ্ঞ এবং লেখকদের রচনায় বিভিন্ন যুগে রবার যন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে হজরত আমীর খসরু তাঁর রচনায় এই যন্ত্রের উল্লেখ করেছেন। তাঁর গ্রন্থে একাধিকবার রবাবের কথা বলা হয়েছে। তৎকালীন রবাবে দু’টি তার থাকতো বলে তিনি উল্লেখ করেছেন, একটির নাম ‘বাম’ অন্যটির নাম ‘জির’।

 

 

ষোড়শ শতাব্দীর ঐতিহাসিক আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে রবাব যন্ত্রের উল্লেখ আছে এবং বলা হয়েছে এতে বারো থেকে আঠারোটি তার থাকে। ৬৭ সপ্তদশ শতাব্দীতে ফকিরুল্লাহ তাঁর রাগ-দর্পণ’ গ্রন্থে রাবব নামক যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “রবাবের ছয়টি তাঁতের তার থাকে, তবে কেউ কেউ সাত থেকে বারোটি তার ব্যবহার করে। যে সকল যন্ত্রে বেশি তার থাকে সেগুলোতে তামার তার ব্যবহার করা হয়।

এর দু’টি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, বর্ষাকালের আর্দ্র বাতাসে তাঁতের তার ঢিলা হয়ে যায় এবং ফলে সুরে বৈকল্য ঘটে। এ অসুবিধা দূর করার জন্য তামার তারের প্রয়োজনীয়তা আছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এর ব্যবহারে চুটকলা এবং খেয়ালের সঙ্গে সংগত যথাযথভাবে হতে পারে এবং বাদ্যের কোমলতা বজায় থাকে। ”একইভাবে ‘সরমাইয়া-ই-ইসরাত’ গ্রন্থে রবাবে ধাতব তার ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

এই বৈশিষ্ট্যটি সুরশৃঙ্গার যজ্ঞের অনুরূপ। ধারণা করা যায় এক পর্যায়ে এসে সুরশৃঙ্গার যন্ত্রটি রবাবকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। এখানে বলা হয়েছে প্রথম এবং পঞ্চম তারটি স্টিলের এবং দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং ষষ্ঠ তারটি পিতল অথবা ব্রোঞ্জের তৈরি। মিঞা তানসেনের আমলের পরবর্তী আরো দু’শো বছর রবাব যন্ত্র আধিপত্যের সাথে প্রচলিত ছিলো। মিঞা তানসেনের কন্যাবংশীয়রা বীণ বাজাতের এবং পুত্রবংশীয়রা রবার বাজাতেন।

 

 

এই দুই যন্ত্র একত্রে সুরশৃঙ্গার, সেতার এবং সরোদ যন্ত্রের বাদন কৌশলকে প্রভাবিত করেছিলো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রবারের প্রচলন ধীরে ধীরে কমে আসে। শেষ পর্যন্ত যাঁরা রবাবের চর্চা করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হচ্ছেন গয়ার বাসত খানের পুত্র মুহম্মদ আলী খান। অপর একজন হচ্ছেন ওয়াজির তার শিষ্য সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান।

আরও দেখুন :

Exit mobile version