আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় নজরুলের গানে স্বদেশচেতনা
নজরুলের গানে স্বদেশচেতনা
নজরুলের গানে স্বদেশচেতনা
২১ বছরের স্বপ্নদ্রষ্টা যুবক নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ৪৯নং বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে গেলে করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে। এই স্বপ্নই তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে দেশপ্রেমের এক মূর্ত সৈনিকের বিপ্লবীচেতনায়। রুশ বিপ্লব দেশপ্রেমের এই ভাবনায় আরো পালক জুড়তে থাকে।
ইংরেজদের শোষণমুক্তির সাথে অর্থনৈতিক মুক্তির অপরিহার্যতার উপলব্ধিও এর সাথে যুক্ত হয়। কলকাতায় ফিরে নজরুল ইসলাম তাঁর করাচি ব্যারাক থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে সাহিত্য, সংগীত ও সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে এগুতে থাকেন দুর্বার গতিতে। হৃদয়ের কাছের মানুষ মুজফ্ফর আহমেদ নজরুলের সাম্যবাদী ভাবনাকে মানুষের কাছে তুলে ধরবার প্রয়াসে পরিচালনা করেন ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণীর মতো পত্রিকা ।
যেখানে নজরুল প্রকাশ করেন কৃষক, শ্রমিক, জেলে এবং সর্বহারা প্রভৃতি মানব হিতৈষীমূলক গান ও কবিতা। নজরুলের দেশাত্মবোধের গান-কবিতার মূল আকাঙ্ক্ষা মূলত রাজনৈতিক স্বাধীনতা। ইংরেজ শাসন-শোষণ থেকে প্রাথমিকভাবে বাঙালি মনে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অনুপ্রেরণার এবং ক্রমে এর সাথে যুক্ত হয় সামাজিক মুক্তির নানা উপকরণ।
এই সকল আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করবার অবলম্বন হিসেবে দেশাত্মবোধের কবিতা-গান এবং বহুবিধ চিন্তাশীল রচনা মানব-মনে দেশাত্মবোধ জাগ্রতকরণে বিপুল অনুপ্রেরণা দেয় যা মূলত পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সংগীত স্রষ্টাদের কর্মকে অনুকরণ করে ধাবিত। যার বহিঃপ্রকাশ আমরা পাই হিন্দুমেলা থেকে ব্যক্ত করে বঙ্গভঙ্গ বিরোধ আন্দোলনের বহুবিধ অনুবাদের মধ্য দিয়ে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত হয় বহু গান ও কবিতা। যে বিপুল সংখ্যক গান বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত হয় তা বাংলা গানের ইতিহাসে একটি বিশেষ ঘটনা। তাই স্বদেশপর্বের গানের কথা এলেই আসে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্বের কথা। যদিও নজরুল ছিলেন সেই সময় নিতান্তই শিশু। নজরুলকে মূলত পাই বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী সময়ে দেশ যখন রাজনৈতিক মুক্তির
আকাঙ্ক্ষায় উত্তাল।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সংগীত রচনার প্রাণপুরুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বদেশপর্বের প্রায় সকল গান তাঁর সেই সময়টাকে কেন্দ্র করে রচিত। খ্যাত-অখ্যাত একটি বিশাল তালিকা রয়েছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সময়কালীন সংগীত রচয়িতাদের।
যাঁদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, মুকুন্দ দাস, অমৃতলাল বসু, প্রমথনাথ রায় চৌধুরী, অশ্বিনীকুমার দত্ত, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, সরলাদেবী চৌধুরানী, কামিনীকুমার ভট্টাচার্য, মনমোহন চক্রবর্তী প্রমুখের নাম না উল্লেখ করলেই নয়। নজরুল ইসলাম স্বদেশি গানের এ যাত্রার সঙ্গে যুক্ত হন মূলত ১৯১৭ সালের পর করাচিতে অবস্থানকালীন সময় থেকে।
১৯২১ সালে কবি রচনা করেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি এবং এর প্রায় সমসাময়িক কালের রচনা ‘ভাঙ্গার গান। এ থেকেই স্পষ্ট যে নজরুলকে দেশাত্মবোধক বা স্বদেশি গান রচনার ক্ষেত্রে পাই মূলত বঙ্গভঙ্গোত্তর কালে। প্রাক-বঙ্গভঙ্গ যুগ এবং বঙ্গভঙ্গোত্তর যুগের রচিত স্বদেশপর্বের গানে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো থেকেই স্বদেশি গান রচয়িতাদের স্বদেশভাবনার স্বরূপটির সন্ধান মেলে।
লেখক গীতা চট্টোপাধ্যায় সেই সময়ের মোটামুটি একশটি গান এবং তার একুশজন রচয়িতা সম্বলিত একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন। এখানে তার উল্লেখের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। কারণ এই একশটি গানের রচয়িতাদের ভাবনা থেকে ভারতের জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় আন্দোলনের সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। গীতা চট্টোপাধ্যায় রচিত বাংলা স্বদেশি গান গ্রন্থের ভূমিকা অংশ থেকে নিম্নোক্ত ছকটি উপস্থাপন করা হলো।
বাংলা স্বদেশি গান ও রচয়িতাগণ
উৎস : গীতা চট্টোপাধ্যায়, বাংলা স্বদেশি গান, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, জানুয়ারি-১৯৮৩, (ভূমিকা, পৃ. ২৩)।
একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এই সকল গানের মধ্যদিয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবোধ মূলত হিন্দু জাতীয়তাবোধের প্রাধান্য প্রতিফলিত হয় এবং যে কারণে অহিন্দুদের কাছে এই আন্দোলন অপ্রিয় হতে থাকে।
সেই সময়ের সকল স্বদেশপর্বের গানে যেভাবে হিন্দুদের দেবী, হিন্দু ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের নামের উল্লেখ আছে সেই তুলনায় কোরান, মুহাম্মদ, রহিম-এই সবের নামমাত্র উল্লেখ রয়েছে দু’একটি গানে। গীতা চট্টোপাধ্যায়ের একশটি গানের উদাহরণে মাত্র দুটি স্বদেশি গানে মুসলিম সংস্কৃতি বা ইসলাম ধর্মীয় শব্দের উল্লেখ রয়েছে।
প্রাক-বঙ্গভঙ্গ যুগ, বঙ্গভঙ্গোত্তর যুগে রচিত একশটি গানের তালিকায় দেশমাতা অথবা শাসকবর্গকে নিয়ে রচিত গানের সম্মোধনমূলক শব্দমালা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে কবি মুকুন্দ দাস ও নজরুলের গানে যেভাবে উত্তেজনা ও প্রতিবাদের বিদ্বেষবাণী ব্যক্ত হয়েছে তা অন্যদের গানে তেমন পাওয়া যায় না। মূলত নজরুল ইসলামের গানে ও সাহিত্যে যেভাবে বিপ্লবীচেতনা প্রকাশিত তা অন্যদের সাহিত্যে বিরল।
“কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট রক্ত-জমাট
শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান।
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ। ধ্বংস-নিশান
উঠুক প্রাচী-র প্রাচীর ভেদি ॥

বাংলা সাহিত্যে অত্যাচারের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদের সুর কোনো লেখনিতে প্রকাশ পায়নি। যেন এক দলা আগুন করে ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনি স্বদেশপ্রেমী অগণিত মানুষের অন্তর গঠনে। নজরুলের গান মানুষের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা সত্তাকে জাগানিয়া সুর। এক একটি প্রতিবাদী অগ্নিশিখা। এমনই এক ব্যতিক্রমী সংগীতের ধারা নিয়ে এলেন নজরুল। গানে যেখানে শক্তি ঝংকৃত হয়, হয়। এমন করে কোনো বাঙালি কবি আগে গান রচনা করেননি।
আরও দেখুন :