আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় নজরুলের সাম্যবাদী চেতনায় স্বদেশ
নজরুলের সাম্যবাদী চেতনায় স্বদেশ
নজরুলের সাম্যবাদী চেতনায় স্বদেশ
করাচিতে সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়েই নজরুলের আরেকটি গুণ ফুটে ওঠে, তা হলো সাম্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর গান এবং লেখনির মধ্যদিয়েও বঞ্চিত-অসহায় মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের ধ্বনি ব্যক্ত করেছেন। শোষণহীন সমাজব্যবস্থার দাবি ধ্বনিত হয়েছে তাঁর সংগীত ও সাহিত্য রচনার মধ্যদিয়ে।
একটি শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা কি আমূল পরিবর্তন আনে একটি দেশের সেই অবস্থার বাণী কবি তুলে ধরেছেন তাঁর রচনার মধ্যদিয়ে। রুশ বিপ্লবের সংবাদ কবিকে আন্দোলিত করতো। করাচি ব্যারাকে থেকেও তিনি গোপনে রুশ বিপ্লবের সংবাদ সংগ্রহ করতেন। বিপ্লবের মধ্যদিয়ে আনা শোষণহীন সমাজব্যবস্থা ও ভারতবর্ষকে ইংরেজদের শোষণমুক্তির স্বপ্নে বিভোর করতো নজরুলকে।
ব্যারাকে বসেই নজরুল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতেন, তেমনি সংগ্রহ করতেন রুশ বিপ্লবের সংবাদও এবং এ-সকল কাজই করতে হতো অত্যন্ত গোপনে। কারণ ব্রিটিশের সেনাবাহিনীতে থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ মোটেই সহজসাধ্য ছিলো না। কিন্তু নজরুল এ-সকল সংবাদ পড়বার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতেন। এ প্রসঙ্গে প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের উক্তি প্রণিধানযোগ্য :
“কাজী নজরুল করাচিতে গিয়ে প্যারেড-এর হাত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে কোয়ার্টার মাস্টার হয়ে লেখাপড়ায় ডুবে রইলেন। তখনকার দিনে যত রকম মাসিকপত্র প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী ও মর্মবাণী, সবুজপত্র ইত্যাদি সবই তিনি রাখতেন। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের গ্রন্থ সবসময়েই তাঁর সঙ্গে থাকত। সিডিসাস কমিটির রিপোর্ট তাও একখানি তিনি রেখেছিলেন।
এই রিপোর্টে বাংলার বিপ্লবীদের বিষয়ে নানাভাবে ইংরেজ সরকার লিখেছিলেন। কাজীর এই গ্রন্থটি বিশেষ প্রিয় ছিলো। আর ছিলো রুশ বিপ্লবের পত্রিকা। সেসব নজরুল নানা কৌশলে হাত সাফাই করে আমদানি করতেন । এ প্রসঙ্গে করুণাময় গোস্বামী লিখিত নজরুল গীতি প্রসঙ্গ গ্রন্থ থেকে অন্য আরেকটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যায়, যেখানে জমাদার শম্ভু রায় এই প্রসঙ্গে প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়কে চিঠিতে জানান :
“একদিন সন্ধ্যায় ১৯১৭ সালের শেষের দিকেই হবে, এখন ঠিক স্মরণে আনতে পারছি না, হয়তো সেটা শীতের শেষের দিক। নজরুল তাঁর বন্ধুদের মধ্যে যাঁদের বিশ্বাস করত, এক সন্ধ্যায় খাবার নিমন্ত্রণ করে। তাঁদের অবশ্য এরকম নিমন্ত্রণ প্রায়ই সে তার বন্ধুদের করত।
কিন্তু ঐদিন যখন সন্ধ্যার পর তার ঘরে আমি ও নজরুলের অন্যতম বন্ধু, তার অর্গান মাস্টার হাবিলদার নিত্যানন্দ দে প্রবেশ করলাম, তখন দেখলাম, অন্যান্য দিনের চেয়ে নজরুলের চোখেমুখে একটা অন্যরকম জ্যোতি খেলে বেড়াচ্ছিল। উক্ত নিত্যানন্দ দে মহাশয়ের বাড়ি ছিলো হুগলি শহরের ঘুটিয়াবাজার নামক পল্লীতে।
তিনি অর্গানে একটি মার্চিং গৎ বাজানোর পর নজরুল সেই দিন যে সব গান গাইল ও প্রবন্ধ পড়ল তা থেকেই আমরা জানতে পারলাম যে রাশিয়ার জনগণ জারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। গান-বাজনা প্রবন্ধ পাঠের পর রুশ বিপ্লব সম্বন্ধে আলোচনা হয় এবং লালফৌজের দেশপ্রেম নিয়ে নজরুল খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এবং ঠিক মনে নেই, সে গোপনে আমাদের একটি পত্রিকা দেখায়। ঐ পত্রিকাতে আমরাও বিশদভাবে সংবাদটি দেখে।
উল্লসিত হয়ে উঠি। সেদিন সারা রাতই প্রায় হৈ হুল্লোড়ে আমাদের কেটে গিয়েছিল। রুশ বিপ্লবের প্রেরণাই তাঁকে সাম্যবাদী ভাবনায় অনুপ্রাণিত করে। তাঁর গান ও সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে এই সাম্যবাদী রূপটির বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই আমরা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি এর অনেক আগে থেকেই অনেক বিপ্লবী ঝুঁকতে থাকে।
বিশেষ করে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ভগবৎসিংহসহ অন্যান্য বিপ্লবীদের বিচারের জন্য আদালতে নেয়ার সময় সকলে সমন্বরে বজ্রকণ্ঠে ব্রিটিশসাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জিন্দাবাদ শ্লোগান উচ্চারণ করতে থাকেন।
তখন থেকেই সকল বন্দী, গারদবাসী ও বিপ্লবীদের মধ্যে রুশ বিপ্লবের ছায়া প্রচণ্ডভাবে পড়তে থাকে। এবং লেলিনের দেখানো পথে বৈপ্লবিক কৃষক আন্দোলনের মধ্যদিয়ে কৃষকসভার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
এ এক অভূতপূর্ব সময়। এতকাল ধরে চলে আসা অত্যাচারী জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবিসহ রুশ বিপ্লবের প্রভাবে জাতীয় বিপ্লবের ধারায় শ্রমিক, কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। লেলিনের অনুপ্রেরণায় ভারতের কমিউনিস্ট শ্রমিক, কৃষক ও নিম্নমধ্যবিত্তদের দাবিগুলো নিয়ে বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করে। তারমধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি অন্যতম।
পরিবেশ পরিস্থিতি অনুধাবনের সুবিধার্থে ১৯২২ সালের কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনের কর্মসূচির একটি অংশ তুলে ধরা হলো :
কংগ্রেসকে সুনিশ্চিতভাবে তার লক্ষ্য ঘোষণা করতে হবে। এই লক্ষ্য হবে পূর্ণ স্বাধীনতার ভিত্তিতে গঠিত জাতীয় সরকার, ভিত্তি হবে বয়স্কমাত্রেরই ভোট দেওয়ার গণতান্ত্রিক নীতি। যার নজরুল বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যারাকে থাকতেই এই সকল বিষয়গুলোতে আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। পরবর্তীকালে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত হন।
করাচি ব্যারাকে থাকাকালীন সময়ে নজরুলের মানসপটে যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয়, • সাম্যবাদী চেতনায় মন যেভাবে উদ্ভাসিত হয় তাই পরবর্তীকালে আরো বিকশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর ১৯২০ সালের মার্চ মাসে ৪৯নং বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। নজরুল তখন করাচির পাঠ চুকিয়ে কলকাতা চলে আসেন। মনের গভীরে সঞ্চিত দেশপ্রেমের ডানায় এবার সত্যিকারের পালক জড়াতে শুরু করে তাঁর।
সাম্যবাদী চেতনার যে অঙ্কুর তিনি ব্যারাক থেকে বয়ে নিয়ে আসেন তার কুড়ি মেলবার সময় হয় এবার। একটি প্রাসঙ্গিক উক্তি যুক্ত করা হলো-
“একটি চরম অস্থির আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিক্ষিপ্ত সময়ে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আগমন। গান, কবিতা, প্রবন্ধ সর্বক্ষেত্রে নজরুলের এই বিশুদ্ধ ও সাম্যবাদী মানসিকতার প্রকাশ দেখতে পাই। তাঁর প্রতিভা বিকাশে বাংলা সাময়িকপত্রেরও বিশাল অবদান রয়েছে। এই সকল ক্ষেত্রে কবি সাম্যবাদী ভাবনার পরিচয় দিয়েছেন বারংবার। মানুষের চেতনাকে জাগাতে আপ্রাণ সংগ্রাম করে চলেছেন।
লেখক-কবি পরিচয় ছাড়াও সাময়িকপত্রের সম্পাদক হিসেবেও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় রাখেন। নজরুলের অত্যন্ত কাছের মানুষ মুজফ্ফর আহমদের সাথে যুগ্ম- সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ নামে সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯২০-এর জুলাই মাসে। নবযুগ প্রকাশের পর কবির সাম্যবাদী আদর্শের বাণী, ঐ শোনো শৃঙ্খলিত নিপীড়িত বন্দীদের শৃঙ্খলের বাংকার।
তাহারা শৃঙ্খলমুক্ত হইবে, তাহারা কারাগৃহ ভাঙ্গিবে। রুশিয়া বলিল, মারো অত্যাচারীকে। গুড়াও স্বাধীনতা বিরোধীর শির। ভাঙ্গো দাসত্বের নিগড়। এ বিশ্বে সবাই স্বাধীন। ”
এছাড়াও নবযুগ পত্রিকাতে তাঁর লেখা ধর্মঘট প্রবন্ধটিতেও সাম্যবাদী আদর্শের ইঙ্গিত স্পষ্ট। এই প্রবন্ধে কৰি কৃষক-শ্রমিকসহ দিন-মজুরদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন এবং সমবেদনা প্রকাশ করেন। অবশ্য এই সকল কারণেই হয়তো নবযুগ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরবর্তীকালে ধূমকেতু পত্রিকাতে সরাসরি কবি সাম্যবাদের কথা ব্যক্ত না করলেও অবচেতন মনে এই পত্রিকায় অন্যদের লেখা প্রবন্ধে সেই সাম্যবাদী রূপটিই ফুটে উঠেছে বারবার। যেমন ‘শ্রীদুর্গামোহন মুখোপাধ্যায়ের রচিত ‘দাসত্ব’, হুমায়ুন জহীরুদ্দিন আমির-ই-কবরীর রচিত ‘পল্লীব্যথা’, ভবানীপ্রসাদ রায় এর ‘পল্লী শিশুর অশ্রু’ প্রভৃতি সাম্যবাদী চেতনামূলক প্রবন্ধ উল্লেখ্য।
প্রায় সবকটাই সাম্যবাদী প্রবন্ধ। এ সকল সাম্যবাদী ভাবধারা এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের বিদ্রোহ-বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের উল্লেখ মূলত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটির জন্যও কাল হলো। নজরুলের সম্পাদনায় লাঙল (১৬ ডিসেম্বর ১৯২৫) পত্রিকারও একই বৈশিষ্ট্য।
‘শ্রমিক-প্রজা স্বরাজ সম্প্রদায়ের মুখপাত্র কবি সাম্যবাদী চেতনা থেকে নিজেকে কখনো বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। বরং লেলিনের জীবনাদর্শ, রুশ বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদের বাণী। এ নিয়ে লেখা প্রবন্ধ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে থাকে।
“গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা-ব্যবধান।
যেখানে মিশিছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান
এই ‘সাম্যবাদী’ নামে বিখ্যাত কবিতাটিও কবি প্রকাশ করেন তাঁর লাঙলের ১ম সংখ্যায়। যেখানে রয়েছে মানবতা আর সাম্যবাদের এক অভূতপূর্ব সমন্বয়। কবি ভালোবাসতেন মানুষকে। মানুষের দুঃখ- কষ্টকে একান্ত নিজের করে তা ব্যক্ত করতেন লেখনিতে। ‘লাঙলে’র প্রতিটি সংখ্যায় কোনো না কোনো উপমায় সাম্যবাদী দর্শনের ভাবাবেগ প্রকাশ করাই ছিলো কবির লক্ষ্য।
‘লাঙলে’র অষ্টম সংখ্যা থেকে ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের ‘মুখপত্র’ রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। শ্রমজীবি গণমানুষের দুঃখ-কষ্ট বিমোচনের এবং মুক্তির কৌশল বর্ণিত হতে থাকে লাঙল পত্রিকাতে। লাঙলে প্রকাশিত হয় ‘কৃষাণের গান’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘জেলেদের গান’ এবং সর্বহারা গণমানুষের কথা।
মানুষের অন্তরকে জাগিয়ে তুলবার জন্য ‘লাঙল’ ছিলো একটি সুপ্ত হাতিয়ার স্বরূপ। মনোজগতের পরিবর্তন করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে গণমানুষকে জাগিয়ে তোলাই ছিলো কবির অভিপ্রায়। তাই কুলি-মজুরকে নিয়ে ব্যথিত কবি হৃদয়ের আকুতি :
“দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে।
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল ?
আরও দেখুন :