আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় কাজী নজরুল ইসলামের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ
কাজী নজরুল ইসলামের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ
কাজী নজরুল ইসলামের স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ
সংগীতের শক্তি অপরিসীম। সংগীত সুর, তাল-লয়মিশ্রিত কতগুলো কথার মালা-যা মনের ক্লান্তি দূর করে, একলা পথের সাথী হয়ে শ্রোতার হাত ধরে পথ চলে। নির্জনতার একান্ত সাথী সংগীত। সংগীত নির্মাণে অসংখ্য গীতকৰি বহুধারার গান রচনায় বাংলা গানের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেছেন।
তাঁদের মধ্যে পঞ্চগীতিকবি অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন ও কাজী নজরুল ইসলাম গানের রচিত সুর ও বাণীর অপূর্ব সম্মিলনের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের গান যুগের পর যুগ শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে এবং আজও মুগ্ধ করে চলেছে নতুন প্রজন্মকে। এই পঞ্চকবির প্রতি জনেই তাঁদের গানের সুর ও বাণী দুই-ই নিজে রচনা করেছেন বলেই তাঁদের গীতিকবি আখ্যা দেওয়া হয়।
যদিও সুর বিশ্লেষণই এই পর্যায়ের আলোচ্য। সেক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, নজরুল ব্যতীত বাকি অন্য সকল গীতিকবিদের যে সুরের আবর্তে ঘূর্ণায়মান তা মূলত একটি সময়ের এবং প্রায় একই ধারার সুরের প্রকাশ। একটি নির্দিষ্ট সময়কাল জুড়ে প্রচলিত সুর ব্যঞ্জনাতেই তাঁরা আবদ্ধ ছিলেন। বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে বললে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের সময়কালে রচিত বাণী সকল কবিদের গানের বাণী ও সুরের ধারা প্রায় একই রকম।
অর্থাৎ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদের সুর রচনাতে অল্পবিস্তর স্বকীয়তা প্রকাশ পেলেও মূলত সুরের একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে প্রতিজনেই আবর্তিত। প্রায় একশ বছর অর্থাৎ ১৮৬০ থেকে ১৯৪০ সময়কালটিতে প্রায় একই ধারার সুর গানের বাণীকে প্রকাশ করেছে। সময়ের চাওয়াটি মূলত রবীন্দ্রনাথে আবর্তিত ছিলো এবং রবীন্দ্রনাথের গানের প্রভাব এতটা শক্তিশালী ছিলো যে, তাঁর দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হতো গীতিকবিগণ।
কেবল অতুলপ্রসাদ সেনের ব্যতিক্রমধারা অর্থাৎ ঠুমরির সমন্বয়ে বাংলা গানের সুরের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা দান করে, যদিও স্বদেশপর্যায়ের গানের ক্ষেত্রে তা বিশেষ পরিলক্ষিত নয়।
এক্ষেত্রে নজরুলের গানে সম্পূর্ণ নতুন ধারার প্রচলন লক্ষ্য করা যায় যা পূর্বেকার সকল গীতিকবি বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদ সেনের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র। নজরুলের ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ গানটির মধ্যদিয়ে একেবারে নতুন ধারার একটি সংগীত জগতে প্রবেশ করে জাতি।
“নজরুল যুক্ত হলেন সংগীতে ১৯২৬ সালে। প্রথম রেকর্ড জাতির নামে বজ্জাতি’ গানটি প্রকাশ পেলে মনে হল সুরের শরীরে, বাণীর শরীরে নতুন পরিধেয় জড়ানো হল। এ ধরনের শব্দ সমাহার সে সময় নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। একটি অর্থে নয়, একাধিক অর্থে। যেমন সুরকার, বাণীকারের নাম। সুর-বাণী মিলে সঙস্কৃতি পরিবেশকে চঞ্চল করে তুলেছিল।
এই সেই ‘তুলেছিল’র রেশ অদ্যাবধি বয়ে চলেছে। আর তাই ১৯২৬ সালটিও বাংলা সংগীত জগতের সর্বক্ষেত্রে টার্নিং পয়েন্ট’ হয়ে শির উঁচু করে আজো অগ্রসরমান। তাই একমাত্র নজরুলের নিকটে বাংলা সুর রাজা, বাংলা বাণী রাজ্য এককভাবে ঋণী |বাংলা স্বদেশি গানের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতেই নজরুলের দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন।
শুধু তাই নয় পরাধীনতার যন্ত্রণায় বৈপ্লবিক চেতনা জাগাতে জনমনে স্বদেশের প্রতি উন্মাদনা জাগ্রতকরণও নজরুলের দেশাত্মবোধক গান রচনার কারণ এবং এক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সফল তা প্রমাণিত। নজরুল তাঁর গানে মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত প্রভৃতি ছন্দ যেমন নিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন, তেমনি তাঁর গানের সুরের বৈচিত্র্যতা কখনো শ্রোতাদের মনে দেয় চমক লাগানো তীক্ষ্ণতা, আবার কখনো ভাসিয়ে দেয় হৃদয় নিংড়ানো গভীরতায়।
নজরুলের দেশাত্মবোধক গানের সুরে বিশেষত মার্চের সংগীতের দ্রুত লয়, আবার লোকসুরের সাদামাটা ঢং বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রামের সমরে রচিত মার্চ সুরের গান জনমনে উন্মাদনার দোলা জাগায়। তাঁর রচিত কোরাস গান সম্মেলন সংগীতের এক নতুন ধারা। জনমনে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টিতে এই সকল কোরাস গানের ভূমিকা অপরিসীম।
নজরুল ইসলাম রচিত কোরাস গান অত্যন্ত শক্তিশালী। কোরাস গানেরই একটি অনবদ্য ধারা মার্চ সংগীত, যার ব্যবহারে নজরুল তাঁর স্বদেশপর্যায়ের গান এক নতুন মাত্রা যোগ করে। নজরুল রচিত মার্চ সংগীতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সুতীব্র স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগায়।
১. আমরা শক্তি আমরা বল…..
২. চল চল চল…
৩. অগ্রপথিক হে সেনা দল…
৪. জননী আমার ফিরিয়া দাও …
৫. টলমল পদভারে…
৬. দুরন্ত দুর্মদ প্রাণ অফুরান….
৭. চলরে চপল তরুণ দল….
৮. এই শিকল পরা ছল…..
৯. আজি শৃঙ্খলে বাজিছে…
১০. শঙ্কা শূন্য…
১১. ধর্মের পথে শহীদ…
১২. কলকল্লোলে ত্রিংশ কোটি….
১৩. তোরা সব জয়ধ্বনি কর…..
১৪. আমার সোনার হিন্দুস্তান…
প্রভৃতি নজরুলের উল্লেখযোগ্য মার্চ সংগীত। মার্চ সংগীতের মধ্যে স্বরের একপ্রকার চঞ্চলতা ও লাফিয়ে চলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় যা সৈন্য মনে রক্তকণিকা প্রবাহের গতি বৃদ্ধির মতো অনুভূত হয়। একটি মার্চ সংগীতের উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্ট হবে,
“চল্ চল্ চল্ চল্ চল্ চল
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণী-ত
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল ।”
এইচ.এম.ভি.এন ৭১৫৫ শিল্পী ধীরেন্দ্রনাথ দাস মার্চ-সংগীত ছায়াছবি: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তাল দারা | ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মুসলিম সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করতে এসে কবি এ গানটি রচনা করেন।
কবি নিজে সৈনিক ছিলেন বলেই মার্চ সংগীতের সুর বা রিদম ছিলো তাঁর বিশেষ ভালো লাগার বিষয়। মূলত তাঁর রক্তে প্রবাহিত মার্শাল রক্ত কণিকার উদাহরণ এই গানটি। লেফট রাইটের ছন্দ মতন উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত এই গানটির স্বরলিপিতে সব একাকার হয়ে সম্মিলিতরূপে প্রকাশিত।
ত্রিমাত্রিক ছন্দে মার্চের সুর ও তাল নির্দেশিত এই গানটি যেকোনো জাতীয় অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে সৈনিকদের কুচকাওয়াজ অথবা বিশেষ দিবসের গার্ড অব অনারের জন্য এই গানটি অত্যন্ত উপযোগী। নজরুলের অসংখ্য এই ধারার গানের মধ্যে আরেকটি কোরাস সংগীতের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দুর্গমগীরি কান্তার মরু গানটি।
মূলত এই গানটি তাঁর সর্বাধিক পরিচিত কোরাসগীতি যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত পরিবেশন করতেন। বাংলা সংগীত ভাণ্ডারের শ্রেষ্ঠ জাতীয় সংগীত দুর্গমগীরি কান্তার মরু’ গানটি।
কেদারা রাগের এই গানটি নজরুলের এক অনবদ্য সৃষ্টি। মূলত এই ধারার গান নজরুল পূর্বে আর রচিত হয়নি। জাতীয় সংগীতের ধারাটিই মূলত নজরুলের অবিস্মরণীয় অবদান। দেশাত্মবোধক গান, স্বদেশী গানের রচনা শুরু হয় সেই হিন্দুমেলার আমল থেকে, কিছু জাতীয় সংগীতের উদ্দামতা তুলে ধরেন একমাত্র কাজী নজরুল ইসলাম । জাতিকে জাগিয়ে তোলাই এই সংগীতের মূল উদ্দেশ্য।
“দুর্গম গিরি কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!
দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।’
স্বরলিপিতে পরিলক্ষিত কি করে কথার গোলা ছুঁড়ে মারা হচ্ছে গানের সুরের মধ্য দিয়ে। লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুশিয়ার হুঁশিয়ার-এর র্র র্র র্র র্স-এর স্বর প্রক্ষেপণ যথার্থ সতর্ক বাণী জানান দিচ্ছে কবি। নজরুলপূর্ব জাতীয় সংগীতের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধিই কারো মধ্যে আসেনি কখনো। আর্মি ব্যান্ডের সুর তাঁর শ্রুতিতে গেঁথে ছিলো।
জাতীয় সংগীত রচনার যে স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ শব্দ চয়ন প্রয়োজন তেমনি সেখানে বিদ্যমান থাকতে হয় সুর ও ছন্দের মার্শাল গতিময়তা যা নজরুলের কবিমনে গেঁথে গিয়েছিল তিনি সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়ে। এ ক্ষেত্রে শফি চাকদারের উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি,
“জাতীয় সংগীতের মধ্যে যে উদ্দীপনা, সাহস, শব্দচয়ন, সুর, ছন্দ প্রয়োজন নজরুলের তা বিদ্যমান আর প্লাস পয়েন্ট, নজরুলের মধ্যে মার্শাল রেস-এর শক্তি তো ছিলোই, সেই সাথে তিনি ছিলেন সৈনিক। আর্মি ব্যান্ড তাঁর শ্রুতি দখল করেছিল। তাই অসংখ্য জাতীয় সংগীতের রচয়িতা তিনি হতে পেরেছিলেন।… আমি ব্যান্ডের রিদম ছন্দে লেফট রাইট শৌর্য প্রকাশ পায়।
কারণ অভিবাদন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদি এবার তো ‘কুচকাওয়াজ’র মাধ্যম হয়ে এই রিদম লক্ষ্য করেই ‘জাতীয় সংগীতের সৃষ্টি।
দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী মানুষকে কারাগারে বন্দী করা হলে নজরুল ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে রচনা করেন আরো একটি কালজয়ী গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পত্রিকা ‘বাঙলার কথা’র জন্য কবি জাগরণী এই গানটি রচনা করেন।
দ্রুত দাদরা তালে রচিত নজরুলের স্বদেশপর্বের এই গানের সুরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্বাধীনতা স্পৃহা প্রকাশ পায় সুতীব্র বেগে। এই ধারার আরো একটি দেশাত্মবোধক গান ‘এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল। স্বরের কাট কাট লাফিয়ে চলার গতিতে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ভাঙার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়।
ঝড়-ঝঞ্ঝার ওড়ে নিশান, ঘন-বস্ত্রে বিষাণ বাজে।
জাগো জাগো তন্দ্রা অনস রে সাজো সাজো রণ-সাজে
দিকে দিকে ওঠে গান, অভিযান অভিযান!
আওয়ান আওয়ান হও ওরে আওয়ान
ফুটায়ে মরুতে ফুল-ফল।”
তাল: ফেরতা
বাংলা স্বাদেশিক গানের যে বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে নজরুলের স্বদেশপর্বের গান মূলত তারই ধারাবাহিতার ফসল। সময়ের বিবর্তনে নজরুলের গানে আসে একেবারে আলাদা সত্তা যা পূর্বেকার কোনো গীতিকবির গানে সন্নিবেশিত হয়নি। একদিকে দেশপ্রেমের উন্মাদনা আর বৈপ্লবিক চেতনায় তাঁর গান পরিপূর্ণ আবার অন্যত্র স্বদেশ মায়ের অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনায় মুখরিত তাঁর দেশাত্মবোধক গান।
নজরুল ইসলাম বাংলার রূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন অপার মায়ার আন্তরিকতায়। যেখানে স্বদেশকে তিনিও মাতৃরূপে কল্পনা করেছেন পূর্বেকার গীতিকবিদের মতো। এই সকল গানও নজরুলের স্বকীয়তায় হয়ে উঠেছে তাৎপর্যমণ্ডিত ও বিশেষ।
১. নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম…..
২. একি অপরূপ রূপে মা….
৩. শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের….
৪. জননী মোর জন্মভূমি….
৫. ও ভাই খাটি সোনার চেয়ে খাঁটি …
এমন বহু গান আছে যেখানে সহজ সাদামাটা সুরের ব্যবহার সর্বসাধারণের উপযোগী হয়ে উঠেছে। স্বদেশ বন্দনার এই সকল গানসমূহে। তেমনি রাগ-রাগিণীর ব্যবহারও দেখা যায় তাঁর কতিপয় স্বদেশপর্বের গানে। যেমন-
১. হে পার্থ সারথী রাগ শিব রঞ্জনী
২. জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা রাগ : শুদ্ধ সারং
৩. আমি পুরব দেশের পুরনারী-রাগ মালকোষ।
রাগ-রাগিণীর প্রতি কবির বিশেষ অনুরাগের কারণেই তাঁর প্রকৃতিপর্বের দেশাত্মবোধক গানেও কবি রাগ রূপের ব্যবহার করেছেন। যদিও কবি সকল রাগের শুদ্ধরূপটি যে হুবহু ব্যবহার করেছেন তা নয়। তিনি সুরপ্রয়োগের ক্ষেত্রে নিজের সুবিধা অনুযায়ী খানিক পরিবর্তন করেছেন। তবে তা কখনো রাগভ্রষ্ট হয়েছে বলে মনে হয় না।
পর্বের অন্যান্য গীতিকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদ সেন যেমন একই গানের দুই বা ততোধিক রাগের মিশ্রণ করেছেন, কৰি নজরুলেরও তেমনি রাগ মিশ্রণের অনুরাগ দেখতে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে আমি পুরব দেশের পুরনারী” মালকোষ রাগের গানটি সম্পর্কে ড. লীনা তাপসী খানের রাগমিশ্রণের পর্যালোচনা তুলে ধরা হলো,
“গানটি শুরুতে মগ ম প মসধা সা-ঘট রাগের রূপ পাওয়া যায়।
গাগরী- প দ গ ম প দ গ এই স্বর সমন্বয়েও ঘট রাগের আভাস পাওয়া যায়। প্রথম অন্তরা ‘পদ্ম কূলে আমি পদ্মিনী বঁধু’ অংশটিতে ধানশ্রী রাগের আভাস পাওয়া যায়। ধানশ্রী দুই প্রকারের। এখানে যে ধানশ্রী সজ্ঞ ম প স প ঠ প মজ্ঞ ও স-এই স্বর সমন্বয়ে গঠিত তার কাছে মিল পাওয়া যায়।
আভোগ অংশের ‘এনেছি নবআশা ঊষার সিন্ধু’ অংশটিতে স দ প য ম স খ য স্বরের ব্যবহার আবার গুণকেলি রাগের আভাস পাওয়া যায়। গুণকেলির আরোহন সমপদ এবং আরোহন: সর্দ প ম া স তাই এক কথায় বলা যায়—এই গানটি কাজী নজরুলের একটি অপূর্ব সৃষ্টি।”
সামগ্রিক আলোচনায় দেখেছি, কবি নজরুল স্বদেশি গানের সুর প্রয়োগে বহু বিচিত্র ধারার সমন্বয় করেছেন। তাঁর মধ্যে মার্চসংগীত একটি সম্পূর্ণ নতুন ধারা যা নজরুলের পূর্বে কেউ কখনো করেননি। তাঁর জাতীয় সংগীতেও পাই স্বদেশের জন্য বলিষ্ঠ উচ্চারণ।
কোনো রকমের করুণা কবির গানের সুরে ঠাঁই পায়নি। তাঁর স্বদেশি গানের সুরে আছে উন্মাদনার মধ্যদিয়ে সত্যকে ছিনিয়ে আনবার শক্তি। এ শক্তি মাথা নোয়াতে নয় বরং চির উন্নত মম শিরের মধ্যদিয়ে দেশমাতার সম্মান রক্ষায় বদ্ধপরিকর।
আরও দেখুন :