নবযাত্রার আন্দনধ্বনির বার্তাবাহী গান

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় নবযাত্রার আন্দনধ্বনির বার্তাবাহী গান

নবযাত্রার আন্দনধ্বনির বার্তাবাহী গান

 

নবযাত্রার আন্দনধ্বনির বার্তাবাহী গানগান

 

নবযাত্রার আন্দনধ্বনির বার্তাবাহী গান

নজরুলের স্বদেশপর্বের গানের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যের উৎস খুঁজতে হলে তাঁর সংগীতে প্রতিফলিত মানসপ্রবণতা ও সংস্কৃতি-সচেতনতার স্বরূপ অনুসন্ধান বাঞ্ছনীয়। কারণ নজরুল ইসলাম তাঁর গানে স্বদেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ধারাকে এমন নিবিড়ভাবে সমন্বয় করেছেন যে তাঁর কোনো ভাবনাকে বিচ্ছিন্ন মনে হবে না।

স্বদেশের মানুষের প্রাণসত্তা ও মানসপ্রবণতা নজরুলের স্বদেশের গানে মর্মাহত হয়ে ওঠে। কবি নজরুল দেশের এই প্রাণময়তাকে তাঁর গানের অলঙ্কারে রূপ দিতে গিয়ে এর ঐতিহাসিক ভাঙাগড়া ও জাতিগত ধ্যান-ধারণাসহ এর সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও বৈশিষ্ট্যের রূপরেখাও প্রকাশ করেছেন যেমন তেমনি বহু স্বদেশের গানে পাই নবযাত্রার আনন্দধ্বনির হুংকার।

স্বদেশের সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করে, প্রাণসত্তাকে সম্বল করে নবীন আশায় শঙ্কাশূন্য হয়ে বজ্র-আলোকে সকলকে নবযাত্রার পথে নামবার আহ্বান করেছেন কবি। কবির ভাষায়:

“আজ ভারতের নব যাত্রাপথের

বাঁশি বাজলো, বাজলো বাঁশি

ফেলে তরুর ছায়া ভুলে ঘরের মায়া

এল তরুণ পথিক ছুটে রাশি রাশি।

সে যুগে ভারতীয় জনগণের প্রাণের প্রত্যাশা এবং প্রধান সংগ্রাম ছিলো সাম্রাজ্যবাসীদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করা। নজরুলের দেশাত্মবোধক এই সকল গান পরাধীন জনগণের মনে তুলেছিল সেই প্রলয়ের দুর্নিবার তুফান। তাঁর আগমনী নবযাত্রার বার্তাবাহী এই সকল গানে প্রভাতের পাখি গায়। জাগরণী গান। অটল হিমালয় সাগরে শঙ্কধ্বনি উঠেছে, বাঁচাতে হবে মৃত মানব প্রাণের হাহাকার রব। নতুন এই যাত্রা পথে আঁধারের শত্রুও আজ পরম আত্মীয়ের প্রত্যাশায়।

“এসো অষ্টমী পূর্ণচন্দ্র। এসো পূর্ণিমা-পূর্ণচাঁদ!

ভেদ করি’ পুনঃ বন্ধ-কারার অন্ধকারের পাষাণ ফাঁদ!

মাদারীপুর শান্তি সেনাবাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র দাস মহাশয়ের কারামুক্তি উপলক্ষ্যে রচিত এই গানে কবি সংহতি ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যের রূপরেখা তুলে ধরেছেন দেশীয় ঐতিহ্যের রূপায়ণের যথার্থ প্রয়োগ। বাংলাদেশের বুকের মানিক বলে সম্মোধন করে কবি স্বাগত জানিয়েছেন রূপক অর্থে সাবাস শুদ্ধ রুদ্ধ-প্রতাপ, প্রবুদ্ধ নবমহাবলীকে যারা নবপথ রচনার আলোকবার্তাবাহী আলোকঝটিকা বয়ে চলেছেন।

দেশীয় ঐতিহ্যের দুর্জের এই রূপায়ণ প্রকাশ নজরুলের স্বদেশপর্যায়ের গানের এক অনন্য ও ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। এই রূপভাবনার গানের মধ্যদিয়ে কবি প্রচলিত ধর্মের নামে জাত-পাতের সংঘাতকে যেমন ভ্রূকুটি হেনেছেন তীব্র ভাষায়, তেমনি তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ধর্মের বহিরাবরণ আচরণ-আয়োজন যা দিয়ে আমরা মত্ত থাকি তা কখনো মানবহৃদয়কে বড় করে না বরং সংকীর্ণতার নিমজ্জিত করে।

প্রকৃত সত্যের আলোর সন্ধান দেয় কেবল মানবহৃদয় যা পারে কেবল নতুন আলোর আনন্দযাত্রার দুয়ার খুলতে। এই আলোর মিছিলে কবি সবসময় তরুণদের আহ্বান জানিয়েছেন আগে। কবি যে সময়টাতে গান রচনা করেছেন সে সময় ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক ভেদ-রাজনীতি প্রকট হতে থাকে।

ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষ পরিচয়কে কবি মূলমন্ত্র করে সকলকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন আর এই আয়োজনে করি সর্বদা তরুণদের সম্মুখ নেতা করতে চেয়েছেন। এইরূপ কিছু স্বদেশের গান নিচে উল্লেখ করা হলো :

ক. “চল রে চপল তরুণদল বাঁধনহারা।

চল অমর সমরে চল ভাঙি কারা

জাগায়ে কানন নব পথের ইশারা।

খ. “জাগো জাগো জাগো নব আলোকে।

জ্ঞান-দীপ্ত চোখে

ডাকে উষসী আলো।

গ. “জাগো রে তরুণ দল।

(স্বতঃ) উৎসারিত ঝর্ণাধারার প্রায় জাগো প্রাণ চঞ্চল ॥

ঘ. “নবীন আশা জাগল যে রে আজ!

নূতন রঙে রাঙা তোদের সাজ

ঙ. “জাগো দুস্তর পথের নব যাত্রী।

জাগো জাগো ঐ পোহাল তিমির রাত্রি।”

চ. “বীরদল আগে চল।

কাঁপাইয়া পদভরে ধরণী টলমল

যৌবন-সুন্দর চির-চঞ্চল।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

কবির বিশ্বাস তরুণ ও যৌবনই পারে প্রাণের চাঞ্চল্য অদম্যভাবে প্রকাশ করতে, জগতের সকল গ্লানি ও সংকীর্ণতাকে দূরীভূত করে পৃথিবীকে প্রাণের ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ ও নবীনরূপে জাগ্রত রাখতে।

সকল কুসংস্কার, অবসাদ ও জড়তার আবর্ত থেকে তরুণরাই পারে মানুষের মনকে মুক্ত করে নবযাত্রার আনন্দধ্বনির প্রেরণা হতে। নতুনের প্রাণচঞ্চলতা, অদম্য সাহসিকতা, পিছুটান ও সংস্কারমুক্ত মনোভাবই কেবল অসম্ভবের স্বপ্ন পূরণে দুর্নিবার ছুটে চলার পথ রচনা করে। যুগে যুগে বিপ্লব ঘটিয়ে তরুণরাই পৃথিবীকে সজাগ রাখতে পারে। তাই কবি তরুণদের শির উঁচিয়ে জগতের মাঝে দাঁড়াতে বলেছেন।

শীর্ণ হয়ে বসে থাকবার দিন শেষ। দুন্দুৰী-ডাক বাজিয়ে সকলকে জাগিয়ে তুলবার সময় এটা। কাননে নতুন পথের ইশারা জেগেছে, সে নতুন পথ মুক্তির পথ, স্বাধীনতার পথ। কবি বাঁধনহারা, ঘরছাড়া তরুণ দলকে তাজা প্রাণের মঞ্জরি ফুটিয়ে পথে নামতে বলেছেন। আঁধার ঘরে যে একলা পড়ে আছে কবি তাদের জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব দিয়েছেন তরুণ দলকে।

নব- আলোকে, জ্ঞানদীপ্ত চোখে নিশি পোহাবার আনন্দে যাত্রা শুরুর আহ্বান করেছেন কবি। নববিস্ময়ে তাই কল্পনার মায়া আবরণে কবি সকল কালোকে নাশ করে প্রভাত পাখির গানে বিভোর হতে নতুন যাত্রার পথিক হতে বলেছেন কবি। তবে এ পথ মসৃণ নয়। পুরাতন জঞ্জাল, কুসংস্কারের জগদ্দল শিলা, শাস্ত্রের প্রাচীরে এ পথ রুদ্ধ। কবি নজরুল তাঁর এ পর্যায়ের গানে এই সকল জরাজীর্ণতাকে তরুণের শক্তিবলে ধ্বংস করে নতুন পৃথিবী গড়তে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।

ব্রিটিশ উপনিবেশে বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ভারতবর্ষ বহুবিদ সমস্যা-দ্বন্দ্ব হতাশা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় নজরুলমানসে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারই বহিঃপ্রকাশ পাই তাঁর কিছু গানে। ধর্মের বড়াই, নিজ নিজ ধর্মীয় মূল্যবোধকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের এক পৈশাচিক প্রতিযোগিতার রুঢ়তাও কবি তুলে ধরেছেন তাঁর গানে।

‘খেলাফত-অসহযোগ-সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের (১৯০২- ১৯৩০) মূলমন্ত্র সম্পৃক্ত মানুষের অন্তর জিজ্ঞাসায় ও প্রত্যাশায় ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গন ছিলো অস্থির। এই অস্থিরতা ফুটে উঠেছে নজরুলের গানেও। নবযাত্রার আলোর পথ রচনার জন্য এ সকল বিবাদমান সম্প্রদায়ের বিষয় বিবেচনাহীন আবেগ ও ঈর্ষায় উদ্ভ্রান্ত মানুষকে শান্ত করতে হবে।

স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও সমাজ পরিবর্তনের আশা-আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টির লক্ষ্যে কবি মুক্তির গান রচনা করেছেন।
কবি নজরুল শাসন-শোষণমুক্ত, পরাধীনতা ও অত্যাচার মুক্ত একটি পৃথিবী রচনা করতে চেয়েছেন। দেশের দারিদ্র্যপীড়িত, হতাশাক্লিষ্ট এবং পরাধীনতার অভিশাপে অভিশপ্ত জীর্ণ প্রাণকে জাগাতে কবি মুক্তির গান বেঁধেছেন।

সামাজিক ও রাজনৈতিক হতাশাসহ টানাপোড়নে ক্ষত-বিক্ষত জাতির মনে নতুন আশা ও উদ্দীপনার স্বপ্ন দিতে আলোর পথ রচনায় নতুন পথের সন্ধানে আনন্দবার্তাবাহী গান রচনায় ব্রতী হন। এহেন কিছু দেশাত্মচেতনানির্ভর গানের উল্লেখ করছি-

ক. “জগতে আজিকে যারা আগে চলে ভয় হারা। ডেকে যায় আজি তারা, চল্ রে সুমুখে চল।

খ. “ঝড় এসেছে ঝড় এসেছে কারা যেন ডাকে। বেরিয়ে এল নবীন পাতা পল্লব-হীন শাখে ॥ ক্ষুদ্র আমার শুকনো ডালে দুঃসাহসের রুদ্র ভালে কচি পাতার লাগরো নাচন ভীষণ ঘূর্ণিপাকে ॥”==

গ. “দুর্গম দূর পথে চল যাত্রী। ভয় নাহি নাহি ভয় বলো যাত্রী ॥””

ঘ. “ব্রজ আলোকে মৃত্যুর সাথে হবে নব পরিচয় জয় জীবনের জয়। শক্তিহীনের বক্ষে জাগাবো শক্তির বিস্ময়, জয় জীবনের জয়

এই সকল গান রচনার মূল উপলক্ষ্য ছিলো রাজনৈতিক ও সামাজিক বিরাজমান দুরবস্থায় বাংলার বিপ্লবী যুবকেরা, তরুণেরা যেন রাজশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে, আওয়াজ তুলতে পারে। নজরুল জানতেন সমাজে বিপ্লব মানে তরুণরাই অগ্রগামী হয়ে কলঙ্কমুক্ত করবে। জীবনের সকল গ্লানি, কলুষতা, মলিনতা এবং অবসাদ দূর করতে কবি আনন্দযাত্রার পথিক হতে আহ্বান করেছেন। চলার বেগে নতুন পথের সন্ধান হবে।

 

নবযাত্রার আন্দনধ্বনির বার্তাবাহী গান

 

সে পথ কি বারতা বয়ে আনবে তা নির্ভর করবে স্ব স্ব কর্মের উপর। ভবিষ্যৎ রচনার আশায় অতীতকে ছুঁড়ে ফেলে নয় বরং অতীতের অভিজ্ঞতার সমন্বয় করে সম্মুখে এগুতে হবে। বিশ্বসভাস্থলে সকলের সাথে মিলিত হতে হবে। পল্লবহীন বৃক্ষের নতুন পাতা বেরিয়ে আসায় আনন্দে নতুনের মহোৎসব লাগে। কবি সেই ভয় ভাঙানো অভয়-মহাত্মাকে প্রণাম জানিয়েছেন।

দুর্গম দূর পথের যাত্রীকে ‘ভয় নাহি ভয় নাহি’ বলে সাহস জুগিয়েছেন কবি। দুর্জয় চঞ্চল যাত্রীকে অজানাকে জয়ের লক্ষ্যে মরুপথের যাত্রী হতে বলেছেন।

আরও দেখুন :

Leave a Comment