আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় নাট্যপ্রসঙ্গ বিচ্যুত বিশুদ্ধ গান
নাট্যপ্রসঙ্গ বিচ্যুত বিশুদ্ধ গান
নাট্যপ্রসঙ্গ বিচ্যুত বিশুদ্ধ গান
রবীন্দ্র নাটকের বেশিরভাগ গান নাট্য প্রসঙ্গ বিচ্যুত বিশুদ্ধ গান। সেই গানগুলো উপভোগের জন্য মূল নাটকে পটভূমি না জানলেও চলে। এমন কি গানগুলির যে কোন নাট্যাশ্রিত তাও অনুমান করা কঠিন। ‘রাজা ও রাণী’ তৃতীয় অন্ধ দ্বিতীয় কুমারসেন সুমিত্রা সম্পর্কে বলে-
আর কি সে মনে করে
তখন ইলা সেই উক্তির সাথে সংগতি রেখে গান গায়-
‘এরা পরকে আপন করে আপনারে পর-
এই গানকে নাট্যপ্রসাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি বিশুদ্ধ গান হিসেবে সহজেই সম্ভোষ করা যায়। গানটির গায়ে নাট্যচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘রাজা’ নাটকে রাজার প্রসার গান।
‘আমি রাগে তোমায় ভোলাব না’ গভীর ভাবে নাট্য প্রসঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু নাট্যকনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকেও গান হিসেবে উপভোগ করা যায়- নাট্যস্মৃতি মনে পোষণ করার দরকার হয় না। এই রকম গান অজস্র। শারদ্যোৎসব’ এর সব নাম এই রকম।
‘আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে’
‘শারসোৎসব’ এর গান নয়, কোন নাটকেরই গান নয়, কিন্তু এই গানটিকে যেমন বিশুদ্ধ গান হিসেবে উপভোগ করি তেমনি শারদোৎসব’, এর অন্যান্য গানগুলিকেও করা চলে। ‘রাজা’ নাটকের তত্ত্বগান পূজাস্পর্শী গান বা বসন্ত বন্দনার গানও এই রকম। সেই রকম ‘মুক্তধারা’ ‘রক্তকরবী, তপতী’র গান। ‘গৃহপ্রবেশ’ এ যতীনের একটি মাত্র গান আছে,
‘ওরে মন যখন জাগলি নারে’-
গানটির শেষে যতীন মন্তব্য করেছে-
“তোরে মাসির কাছে শুনে বুঝেছি হিমি, মজির মন জেগেছে।’ এই উক্তির মধ্যদিয়ে। গানটিকে নাট্যপ্রকাশে সংগ্রহিত করা হয়েছে। তবুও এর স্বতন্ত্র উপভোগ আছে। নৃত্যনাট্যেও এমন গান পাই অনেক।’ ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্য নাট্যে এই রকম গান সবচেয়ে বেশি –
স্তরে ঝড় নেমে আয়’
বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে ।
ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে শুনি অতল জলের আহ্বান’
ইত্যাদি ‘চন্ডালিকা’ ও ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে এই রকম গানের উদাহরণ মেলে। বিশুদ্ধ গান হিসেবে রবীন্দ্রনাটকের গানকে যখন স্বতন্ত্র ভাবে উপভোগ করা যায় তখন তার মধ্যে এসে যায় এক ধরনের অ্যাম্বিগুইটি বা দ্ব্যর্থতা- এই দ্ব্যর্থতা আনে ব্যঞ্জনাময় অতিরিক্ত মাত্রাকে আশ্রয় করে। ধরা যাক ‘চিরকুমার সভা’ নেপথ্য গান-
ওগো, তোরা কে যাবি পারে
আমি তরী নিয়ে বসে আছি নদী কিনারে’
খুব কাছের বাড়ী থেকে ভেসে আসা এই গানের তাৎপর্য নাট্য প্রসঙ্গের দ্বারা সীমাবদ্ধ। শ্রীশং বিপিন ও পূর্ণ মিলে সেই তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছে, কিন্তু গানই নাট্যপ্রকাশ থেকে বিচ্যুত হয়ে পেয়ে যায় ব্যাপক তাৎপর্য। রবীন্দ্রনাটকের গানে এই রকম অ্যাম্বিগুইটির প্রমাণ অনর্গল। সুরমার মুখে দাদামশায় এসে পৌঁছেছেন শুনে বিভা যখন ভাবছে তিনি আমাদের দেখতে এখনো এলেন না কেন’ তখনই অন্তরায় গান গাইতে গাইতে প্রবেশ করে-
“আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে
নাটকে না নিতান্ত বসন্ত রায়ের মঞ্চপ্রবেশের উপলক্ষ। সেই উপলক্ষ, ঘটিত গান নাটক থেকে সরিয়ে নিজে হয়ে যায় এক ব্যঞ্জনামধুর প্রেমের গান। নাটকে গানের স্বপনতরীর নেয়ে তার সেই সাধের নন্দিনী, কিন্তু নাটকের বাইরে হয়ে উঠতে পারে যে কোন দহিতা রমনী।
‘গৃহপ্রবেশ’ এ যতীনের যে গানের কথা আগেই উল্লেখ আছে ‘ওরে মন যখন জাগলি নারে’ নাটকে সেটি বিশেষ করে যতীন মনির দাম্পত্য-পরিস্থিতির গান। নাটকের চৌহদ্দির বাহিরে নিয়ে এলে সেই প্রগতি সীমাবদ্ধতা মুছে যায়। নাটকের গান গেয়ে যায় সীমাহীন ব্যঞ্জনা। তা অর্জন করে দেশাতীতের কালাতীতের মাত্রা।
আরও দেখুন :