নাট্যসঙ্গীত রচনায় সুরের প্রাধান্যতা

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় নাট্যসঙ্গীত রচনায় সুরের প্রাধান্যতা

নাট্যসঙ্গীত রচনায় সুরের প্রাধান্যতা

 

নাট্যসঙ্গীত রচনায় সুরের প্রাধান্যতা

 

নাট্যসঙ্গীত রচনায় সুরের প্রাধান্যতা

বিশুদ্ধ সংগীতের বিচার যেমন হয় সরের বিন্যাস দিয়ে, কিংবা কথা-সুরের সংগতির প্রশ্নটি যেমন বড়ো হয়ে ওঠে গানের মূল্যায়ণ সঙ্গে, নাটকের গানের বিচার ঠিক সেভাবে করা যায় না কখনোই। শুধু কথার গৌরব, বা নিছক সুরমাধুর্য একেবারেই বড়ো নয় নাটকের গানে, এমনকি কথাসুরের সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য ও নাট্য-বিচ্ছিন্ন ভাবে জরুরি নয় তেমন। নাটকে গান মূল্য পায় নাটকীয় তাৎপর্যে, নাট্যবিষয়ের সঙ্গে একাত্মতায়।

তাই নাটকে গানের নিজস্ব সৌন্দর্য্য সন্ধানের পরিবর্তে আমরা মনোযোগি হয়ে উঠি নাটকীয় মুহূর্ত আর গায়ক চরিত্রের সঙ্গে গানটিকে মিলিয়ে নিতে, আর তারই সঙ্গে দেখে নিতে চাই কথা ও সুরে গানের সম্পূর্ণ হয়ে ওঠাকে। লক্ষ্য করতে ভালো লাগে যে রবীন্দ্রনাথের নাটকের অধিকাংশ গানই কথা-সুরে তালে সম্পূর্ণ, অর্থাৎ এগুলি ‘গান’, এবং নাটকের গান। সেই কারণে একই গান ভিন্ন তাৎপর্য পেয়ে যায় নাটকে, আর নাটক বিযুক্ত স্বতন্ত্র গান হিসেবে।

‘গীতবিতান’ এ শীতঙ্কতুর গান ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’, বা প্রেম-পর্যায়ের গান ‘তোমায় গান শোনাব’ ‘রক্তকরবী’ নাটকে পায় নতুন মাত্রা. অন্যতম ভাবব্যাঞ্জনা । কিন্তু এই সঙ্গে অনিবার্যভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয়, এই যে ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন মূল্য, এ তো গানের কথাই পায় কেবল, সুরও কি পায় এরকম বৈচিত্র্যময় মাত্রা। নাটকে গানকে যদি আমরা ধরে নিই সংলাপেরই ভিন্নতর রূপ, তা হলে গানের কথাই প্রাথমিকভাবে বেশি গুরুত্ব পায় সন্দেহ নেই।

তখন আর বুঝতে অসুবিধা হয় না ও চাঁদ চোখের জলের লাগল জোয়ার’ গানটি কেন সম্পূর্ণভাবে প্রযুক্ত হয় নি এই নাটকে; বিশুদ্ধ বক্তব্য সম্পূর্ণ হবার সঙ্গেই থেমে গিয়েছে গান। সুরের কি তবে নাটকে, আর নাটকের বাইরে ভিন্ন কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয়, গানের কথাকে তো সুরই পৌঁছে দেয় । আর তখনই ধারণা করা যেতে পারে যে গানটি সাধারণত যেমন ক’রে গাওয়া হয় বিশুর গান হিসেবে ঠিক সেই ভাবে গাওয়া হবে না নিশ্চয়ই।

বিশু গায়ক হলেও এ তো শুধু গান নয়, এ নন্দিনীর প্রশ্নের জবান, কিংবা তাও নয়, নন্দিনীর জিজ্ঞাসাকে উপলক্ষ মাত্র ক’রে এ বিশুর প্রেমিকচিত্তের নিভৃত বেদনার উদ্ঘাটন। সুরের ভাষায় এর প্রকাশ যথার্থ হলেও এই গানগাওয়া একটু আলাদা হতেই হবে। আর গাইবার ধরনেই গানের কথার মতো সুরও পাবে নতুন কোনো মাত্রা দুই শব্দের মধ্যবর্তী বিরতিতে বা সুরের স্থায়িত্বের তারতম্যে ।

একটু ভিন্ন উদাহরণ গানের এই প্রসঙ্গকে আর স্পষ্ট করবে। ‘রক্তকরবী’ নাটকের এক অভিনয়ে গানটি আরম্ভ হয়েছিল গানের অন্তরা থেকে- ‘আমার তরী ছিল চেনার কুলে। স্বতন্ত্র গান হিসেবে এভাবে পাওয়া প্রত্যাশিত নয় বলা বাহুল্য, কিন্তু নন্দিনীর ‘কোথায় তুমি গেলে বলো তো’— এই প্রশ্নের উত্তরে যখন শুনি, ‘আমার তরী ছিল চেনার কুলে’ তখন সমস্ত পরিবেশটি হয়ে ওঠে আশ্চর্য প্রাণময় প্রশ্ন-উত্তরে গাঁথা।

সংলাপের ধরণ বলে নয়, সুরের দিক দিয়েই – প্রয়োগের ধরণটি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। নন্দিনীর প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই সুর বা স্বরের যে জায়গায় শেষ হওয়া সংগত বলে কল্পনা করি, গানের অন্তরার চড়া সুরটি যেন তারই সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমাদের মনকেও বেঁধে দেয় উদাস ঔদার্যের সুরে। গানের ভিতর দিয়েই, কিন্তু গানকে অতিক্রম করে বিশুর ব্যর্থ প্রেম, তার প্রচ্ছন্ন মর্মবেদনা আমাদের কাছে সত্য হয়ে ধরা দেয়।

এই গান প্রয়োগের এটিই একমাত্র বা চূড়ান্ত আদর্শ এমন নয়, কিন্তু দেখা যায় উপস্থাপনার বৈচিত্র্যে গানের কথার মতো সুরের মূল্যও বদলে যেতে পারে, যেমন যায়, বিভিন্ন গায়কের গায়ন ভঙ্গির স্বাতন্ত্রে। একেই বলা যায়, সুরকারের সুর বজায় রেখেও এক্সপ্রেশনে’র বা “ইন্টাপ্রেপেটশনের স্বাধীনতা’, যা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দেবার কথা ভেবেছিলেন তাঁর গানের গায়কদের।

অবশ্য এ হল একেবারেই গানের প্রয়োগগত ভাবনার কথা। তা হলেও নাটক এবং গান- দুটিই প্রয়োগনির্ভর শিল্প বলে নাটকের গানের ক্ষেত্রে এ কথাটি বিশেষ করেই মনে রাখবার। এই প্রসঙ্গেই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের নাটকে এমন গানও আসে কখনো কখনো, যা ‘গান’ হিসেবে সম্পূর্ণ হয়েও সুর নাট্যপ্রয়োগের পক্ষে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের মনে পড়বে

 

নাট্যসঙ্গীত রচনায় সুরের প্রাধান্যতা

 

‘অচলায়তন’ নাটকে-

দুরে কোথায় দূরে দূরে

‘সকল জনম ভরে ও মোর দরদিয়া’,

কিংবা ‘রাজা’ নাটকে-

‘বিরহ মধুর হল আজি,

“আমি রূপে তোমায় ভোলাব না’ প্রভৃতি গান ।

নাট্য-বিচ্ছিন্নভাবে গানগুলির আবেদন বারবার আমাদের মুগ্ধ মনোযোগ আকৃষ্ট করে নিঃসন্দেহে;

কিন্তু পঞ্চক চরিত্রের পক্ষে যতখানি স্বত:স্ফুর্ত মনে হয়

“তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে

‘ঘরেতে ভ্রমর এল’

তবু এই ধরনের সমস্যা খুব প্রবল নয় রবীন্দ্রনাথের নাটকে। এমনকি তাঁর নাটকে গানের প্রাচুর্যকে কখনো কখনো অতিরিক্ত মনে হলেও নাট্য-বিষয় থেকে দূরে নয় প্রায় কোনো গানই। ব্যতিক্রম কিছু আছে, যেমন ‘তপতী’ নাটকে বিপাশার গান। তার ‘মন যে বলে চিনি ‘চিনি’, বা ‘বকুলগন্ধে বন্যা এল.’ কিংবা ‘দিনের পরে দিন যে গেল’ গান হিসেবে যত সম্পূর্ণই হোক নাটকে এ গানের কোনো মূল্যই নেই প্রায় ।

আসলে প্রচলিত প্লটগঠন চরিত্রবিদ্যাসমিতির বাইরে যে নাট্যরচনা শুরু হল ‘শারদোৎসব’ সংলাপ বা কথার ভাষাই যথেষ্ট হল না, তাই সেখান থেকে আরম্ভ হল ‘কথার ভাষা’র সঙ্গে ‘সুরের ভাষা’ মিশিয়ে ভাবের ভাষা’কে ধরবার আয়োজন। আমরা দেখেছি এর আগে প্রথম জীবনে গীতিনাট্যরচনার সময় অক্ষরিক অর্থেই কথার ভাষা আর সুরের ভাষাকে মিলিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ রচনার নেপথ্যে তার চিন্তাই ছিল; আগাগোড়া সুর করিয়া নানা ভাবকে গানের ভিতর দিয়া প্রকাশ করিয়া অভিনয় করিয়া গেলে চলিবে না কেন?’ হার্বাট স্পেন্সরের রচনায় তিনি পড়েছিলেন আমাদের অনুভূতি প্রকাশের সঙ্গে সুরের কথা, সংগীতের যোগের কথা; তারও আগে ‘সংগীত ও ভাব’ প্রবন্ধে তিনি ঘোষণা করেছেন; ‘সংগীত মনোভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠতম উপায়মাত্র।

অনুভবের সঙ্গে সুরের যোগ প্রসঙ্গে এই প্রবন্ধে দেখি; ‘আমরা যখন হাসি -হা: হা: হা: হা:, কোমল সুর একটিও লাগে না, টানা সুর একটিও নাই, পাশাপাশি সুরের মধ্যে দূর ব্যবধান, আর তালের ঝোঁকে ঝোঁকে সুরে লাগে।’ রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনার প্রায় হুবহু প্রতিফলন ঘটেছে ‘ বাল্মীকি-প্রতিভা’র গানে-

‘হা: হা: ভায়া খাপ্পা বড়ো

‘তবে আয় সবে আয়’, কিংবা

“কালী কালী বলো রে আজ’

গানে হাসির প্রকাশ হয়েছে শুদ্ধসুরের কাটা কাটা প্রয়োগে। পথ তুলেছিস সত্যি বটে গানের হাসিতে অবশ্য কোথাও কোথাও কোমল সুর গেগেছে, কিন্তু হাসির মূল রূপটি এখানে অব্যাহত:

অর্থাৎ টানা বা গড়ানো সুর একটি নেই, প্রতিটি সুরের মধ্যে দূর ব্যবধান হাসির ভাবটিকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে।

ভাবের সঙ্গে সুরের এই যে সংগতি, নাটকের গানে, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের নাটকের গানে এটিই তাৎপর্যময় মনে হয় আমাদের কাছে। তখন বাল্মীকি প্রতিভার কোন গান ‘বিলাতি সুরে রচিত, কোন গান ‘জ্যোতিভিদাদার রচিত গতের সুরে বসানো, আর কোন গান বিশুদ্ধ ‘বৈঠকিগান ভাঙা’

 

নাট্যসঙ্গীত রচনায় সুরের প্রাধান্যতা

 

এই খবর তথ্যের অতিরিক্ত কিছু দেয় না আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করি প্রয়োগের বৈশিষ্ট্য- ‘শ্যামা, এবার ছেড়ে চলেছি না’ পৃথক হয়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের রামপ্রসাদী সুরে রচিত অন্যান্য গানের থেকে। রক্ষণীয় যে গোটা নাটকাটিতে একবারই মাত্র প্রযুক্ত হয়েছে রামপ্রদাসী সুরের গান, শ্যামার কাছ থেকে বাল্মীকির বিদায় গ্রহণ মুহুর্তে।

যে সুরে শ্যামার আরাধনা করা হয় সেই সুরেই বিদায়গান গাওয়ায় বাল্মীকির দ্বন্দ্ব, বেদনা, উত্তরণ-সবটুকু গাঁথা হয়ে যায় এক নিমেষে। সুর আর শুধু সুরের সমায় বাঁধা থাকে না তখন, ভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে খুঁজে পায় আপন পূর্ণতা।

আরও দেখুন :

Leave a Comment