নারী জাগরণের গান

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় নারী জাগরণের গান

নারী জাগরণের গান

 

নারী জাগরণের গান

 

নারী জাগরণের গান

অত্যন্ত আধুনিক ভাবনার কবি সর্বহারাদের কথা, সাম্যবাদের কথা যেমন বলেছেন তেমনি বলেছেন নারী জাগরণের কথা। নজরুলের দেশভাবনার গানে সুনির্দিষ্টভাবেই নারী জাগরণের উদাত্ত আহ্বান প্রকাশ করেছেন কবি। এই সকল গানের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও এক এবং অদ্বিতীয় এই গানে ফুটে উঠেছে বাংলার কুসংস্কারের আধারে তলিয়ে যাওয়া নারীদের আশার সূর্য স্নানে আত্মপরিত্রাণের প্রেরণামূলক বাণী।

যে দেশ মাতৃরূপে তুল্য সেই দেশের নারী অবহেলিত থাকতে পারে না। তাই কবি মূলত নারী জাগরণের শক্তির মধ্যদিয়ে দেশাত্মবোধ জাগাতে চেয়েছেন। এ ধারার গানে এই গানটি খুবই সাড়া জাগানিয়া। কবির ভাষায়:

“জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।

জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টীকা ॥

দিকে দিকে মেলি’ তব লেলিহান রসনা,

নেবে চল উন্মাদিনী দিসনা।

অর্থনৈতিক মুক্তি যে কেবল নারীকে তার সত্যিকারের সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারে নজরুল তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং গৃহকন্যার কাজের বাইরেও সমাজ পরিবর্তনে নারীর ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেই নজরুল এই গানটি রচনা করেন। নারী জাগরণ সম্পর্কে প্রবোধকুমার সান্যালের উদ্ধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক যা নজরুল গীতি প্রসঙ্গে গ্রন্থ থেকে উপস্থাপিত হলো :

“আমাদের উদ্দেশ্য সামনের দিকে থাকবে একটি পাঠাগার সেখানে থাকবে নানা রকমের বই এবং পড়াশোনার সুবিধা। ঘরখানা আলমারি দিয়ে পার্টিশন করা হবে। ভিতরের দিকে থাকবে শুধু একখানা বড় রকমের তক্তপোষ, সেখানে আনন্দমঠের সন্তানরা, অর্থাৎ বিপ্লবীরা গোপনে এসে মিলিত হবে। এই আইডিয়াটা পাওয়া গিয়েছিল সিমলা ব্যায়াম সমিতি’র কল্যাণে সামনের দিকে বাৎসরিক বারোয়ারী দুর্গাপূজো, ভিতরের দিকে সকল দলের বিপ্লবীদের বাৎসরিক সঙ্গোপন সম্মেলন ।

পাছে আনন্দমঠের উদ্বোধন অনুষ্ঠান গোয়েন্দা পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেজন্যে আমরা স্থির করলাম এর উদ্বোধন করা হবে হাজরা রোডের বাড়িরই নিচতলায়। এখানে উঠোন ছিলো প্রশস্ত, যেটি সমাবেশের পক্ষে সুবিধাজনক ছিলো। আমি নিজে গিয়ে কাজী নজরুল, নলিনীকান্ত সরকার এবং কাকে কাকে যেন নিমন্ত্রণ করে এলুম।

আমাদের মূল উদ্দেশ্য যে পাঠাগার নয়, এটি ইষ্টমন্ত্রের মতো সকলের কাছেই চেপে রাখতে হলো। এটি একটি মহিলা প্রতিষ্ঠান ও সমাজসেবাকেন্দ্র এটিই প্রচারিত থাকল। নলিনীদা ও নজরুল আমাকে অবিশ্বাস করেন নি। আনন্দমঠ-এর উদ্বোধনের দিন বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের আনিয়েছিলুম। দক্ষিণ কলকাতার বহু নেতৃস্থানীয়া মহিলা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন।

উদ্বোধনসংগীত গাইল নজরুল তার অনবদ্য কণ্ঠে। এই উপলক্ষে সে একটি গান রচনা করেছিল : জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা। বর্তমানেও সর্বাধিক প্রচলিত এই নারী জাগরণী গানটি প্রবল তেজোময় ও শক্তিদীপ্ত গান হিসেবে নারী দিবসসহ যেকোনো নারী আন্দোলনের স্লোগানে গাওয়া হয়ে থাকে।

 

নারী জাগরণের গান

 

“আমি মহাভারতী শক্তিনারী।

আমি কৃশ-তনু-অসিলতা, স্বাহা আমি তেজ-তরবারি আমি আশা-দীপ,

জ্যোতি, আমি কল্যাণ, সাম্য, প্রেম, সংহতি।

আমি ভবনে করুণা-কোমল আমি ভূবনের সর্ব দ্বন্দ্ব সংহারি ॥

বাংলার নারী মহাভারতী শক্তিরূপিনী। নারী শান্ত, ত্যাজ জ্যোতির্ময়ী তড়িতলতা। কি প্রেম, কি মায়া ! করুণা-সংহতি-সকল কিছুর এক আশ্চর্য সম্মিলন একজন নারী। অশান্ত পৃথিবীকে শান্ত করতে যেমন নারী পারে তেমনি পরাজিত বীরকে নিরাশার ভেলা হতে উত্তোলন করে দেখায় আশার পথ। নারী এমনই আলোর বন্যা আধার বিনাশী। নারীকে এমন করে শ্রদ্ধা জানাতে খুব কম লেখনিতেই পাই।

স্বদেশচেতনার এই গানে কবি নারীর স্তুতি বন্দনার মধ্যদিয়ে মূলত স্বদেশের মাতৃরূপেরই স্তুতি বন্দনা করেছেন। এমনই আরো গান পাই চাঁদের কন্যা চাঁদ সুলতানা’, ‘মেলি শত দিকে চাঁদের লেলিহান রসনা’। এই সকল গানে নজরুল চাঁদের আলোর সাথে নারীর কীর্তিকে তুলনা করেছেন। নারী কেবল চুড়ির ঝঙ্কারে মোহিত থাকে না, তারা জানে বিপদে পথ দেখাবে, দেশের মানুষকে রক্ষা করতে তরবারী ধরতেও। নারী চিন্ময়ী, রণ-রঙ্গিনী, নারী লক্ষ্মী ও স্বরসতী এক সম্মিলিত জ্ঞানের আধার।

“চাঁদের কন্যা চাঁদ সুলতানা, চাঁদের চেয়েও জ্যোতি।

তুমি দেখাইলে মহিমান্বিতা নারী কি শক্তিমতি ॥

শিখালে কাঁকন চুড়ি পরিয়াও নারী,

ধরিতে পারে যে উদ্ধৃত তরবারী।

এ প্রবন্ধে স্বদেশচেতনা উদ্বুদ্ধকরণে নারী জাগরণের আরো একটি আহ্বান যুক্ত করতে চাই। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে যে, ‘তুরস্কের নারী জাগরণের অগ্রদূতিকা খালিদা এদিব কলকাতায় এলে তাঁকে কারমাইকেল হোস্টেলের ছেলেরা অভ্যর্থনার আয়োজন করেন। এই উপলক্ষ্যে কবি ছেলেদের অনুরোধে গানটি রচনা করেন।

“গুণে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায়

রূপে লাবণ্যে মাধুরী ও শ্রীতে হুরী-পরী লাজ পায় ॥

নর নহে, নারী ইসলাম, পরে প্রথম আনে ঈমান

আম্মা খাদিজা জগতে সর্বপ্রথম মুসলমান।’

রাগ : মালকোষ মিশ্র, তাল: দাদরা।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

নারী মুক্তির ভাবনার সাথে নজরুলের স্বদেশচেতনামূলক গানে স্বদেশকে মাতৃরূপে দর্শনের কিছু উদাহরণও পাই যেমনটি আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের স্বদেশপর্যায়ের গানে। এ বিষয়ে নিচে আলোকপাত করছি।

আরও দেখুন :

Leave a Comment