বাদ্যযন্ত্রের আকৃতি ও নির্মাণকৌশলের বিবরণ ও কালানুক্রমিক আলোচনা (বিশ্লেষণ এবং বিবর্তনের ইতিহাস)

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বাদ্যযন্ত্রের আকৃতি ও নির্মাণকৌশলের বিবরণ ও কালানুক্রমিক আলোচনা (বিশ্লেষণ এবং বিবর্তনের ইতিহাস)

বাদ্যযন্ত্রের আকৃতি ও নির্মাণকৌশলের বিবরণ ও কালানুক্রমিক আলোচনা (বিশ্লেষণ এবং বিবর্তনের ইতিহাস)

বাদ্যযন্ত্রের আকৃতি ও নির্মাণকৌশলের বিবরণ ও কালানুক্রমিক আলোচনা (বিশ্লেষণ এবং বিবর্তনের ইতিহাস)

বাদ্যযন্ত্রের আকৃতি ও নির্মাণকৌশলের ধারাবাহিক বা কালানুক্রমিক আলোচনা করতে হলে যে বিষয় সম্পর্কে প্রথমে জানা দরকার তা হচ্ছে বাদ্যযন্ত্রের প্রকৃতি। কারণ বাদ্যযন্ত্রের প্রকৃতি এবং বাদ্যযন্ত্রের নির্মাণকৌশলের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বাদ্যযন্ত্রের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে সমগ্র বাদ্যযন্ত্রকে মূল তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যেমন,

১। ড্রোন (Drone) বা সুর ধরে রাখার যন্ত্র

২। পলিকর্ড (Polychord) অর্থাৎ যে যন্ত্রে একটি স্বর বাজানোর জন্য একটি তার ব্যবহৃত হয় এবং

৩। মনোকর্ড (Monochord) অর্থাৎ যে যন্ত্রে একটি তার দিয়ে সব স্বর বাজানো যায়।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে বাদ্যযন্ত্রের আকৃতির ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস সহজবোধ্য হবে।

ড্রোন

এ ধরণের বাদ্যযন্ত্র কোন রাগ বা সুর সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হয় না, বরং সুর ধরে রাখা ও তালের সমতা রক্ষার জন্য প্রযুক্ত হয়। যেমন একতারা ও তানপুরা। একতারায় একটি মাত্র তারই থাকে। যন্ত্রটির নিচের দিকে ছোট আকৃতির একটি লাউয়ে চামড়ার ছাউনি দেওয়া থাকে। ছাউনির সাথে কাঠ বা বাঁশের দন্ড আটকানো হয়। দন্ডটি খুব বেশি মোটা নয়। লাউটি অনুনাদক হিসেবে কাজ করে। দন্ডটি লাউয়ের নিচের দিকে একটু বেরিয়ে থাকে।

সেই বের হয়ে থাকা অংশে একটা ছোট আঙটা লাগানো থাকে। সেখান থেকে একটা তার ছাউনির ওপর দিয়ে দন্ডের প্রায় শেষ মাথা পর্যন্ত প্রসারিত। ছাউনির ওপরে এটি একটি ছোট ব্রিজের ওপর দিয়ে আসে। দন্ডের শেষ প্রান্তের কাছাকাছি এটি একটি খুঁটির সাহায্যে আটকানো হয়। খুঁটিকে মোচড় দিয়ে তারটিকে ইচ্ছামত ঢিলা বা আঁটো করা যায়।

গানের সুরের সাথে মিল রেখে এই তারের সুর বাঁধা হয়। গান গাওয়ার সময় ডান হাতের সাহায্যে টোকা দিয়ে তালে তালে শব্দ উৎপন্ন করা হয়। ফলে ছন্দোময় একটি মিষ্টি ঝঙ্কার সৃষ্টি হয়।

 

বাদ্যযন্ত্রের আকৃতি ও নির্মাণকৌশলের বিবরণ ও কালানুক্রমিক আলোচনা (বিশ্লেষণ এবং বিবর্তনের ইতিহাস)

চিত্র – একতারা

তুলনামূলকভাবে একটু বড় আকারের লাউ দিয়ে তৈরি যন্ত্র ‘লাউ’ নামেই পরিচিত। গ্রাম বাংলার বাউল এবং বৈরাগীদের কাছে এটি খুবই আদরণীয়। লাউয়ের নিচের দিক কেটে চামড়ার ছাউনি দেওয়া হয়। ওপরের অংশ সমান করে কাটা হয়। লাউয়ের তৈরি এই খোলের দু’পাশে বাঁশের চটা লাগানো হয়। তবে তার আগে বাঁশের দন্ডটিকে দু’ভাগে চিরে ফেলা হয়। বাঁশের জোড়া বা গিঁটের অংশটি অবিচ্ছিন্ন রেখে তার নিচ থেকে চিরে দু’ভাগ করতে হয়।

এরপর চেরা অংশ বা চটা দু’টো লাউয়ের দু’পাশে শক্ত করে আটকানো হয়। দন্ডের উপরের অংশে গাঁটের ওপরে তার আটকানোর জন্য একটি খুঁটি থাকে। এই খুঁটিতে তার জড়িয়ে বাঁশের চটা দু’টির মধ্য দিয়ে তারটি লাউয়ের খোলের ভেতর দিয়ে চামড়ার নিচ পর্যন্ত টেনে নিয়ে একটি চাকতির সাহায্যে আটকিয়ে দেওয়া হয়। খুঁটি মুচড়ে গানের সুরের সাথে তারের সুর মেলানো হয়।

এরপর ডানহাতের তর্জনীতে মিজরাব লাগিয়ে সেটির সাহায্যে তারে আঘাত করে বাজাতে হয়। একতারার চেয়ে এটি বেশি বৈচিত্রপূর্ণ এই কারণে যে, তারে আঘাত করার পরই বাঁশের চটায় একবার চাপ দেওয়া হয় আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। এভাবে তার ও চামড়ার ছাউনির চাপের যে পরিবর্তন হয় তা স্বরের উচ্চ-নিম্নতা সাধন করে। চাপ দিলে তারটি ঢিলে হয় এবং সুর নেমে যায়। আবার ছেড়ে দিলে যে সুরে বাঁধা থাকে সেই সুরে বাজে। ফলে ছন্দময় একটি সুরেলা শব্দ সৃষ্টি হয়।

 

বাদ্যযন্ত্রের আকৃতি ও নির্মাণকৌশলের বিবরণ ও কালানুক্রমিক আলোচনা (বিশ্লেষণ এবং বিবর্তনের ইতিহাস)

চিত্র – লাউ

সুর মেলানো বা সুর ধরে রাখার যন্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে তানপুরা। তানপুরা স্বর বৈভবে অতুলনীয়। এর প্রতিটি তার এমন স্বর-বৈচিত্র সৃষ্টি করে যার কোন তুলনা নাই, এমনকি কোনভাবে বিশ্লেষণ করেও বোঝানো সম্ভব নয়, কিন্তু মাত্র চারটি বা পাঁচটি তার থেকেই পূর্ণ সপ্তকের আবহ সৃষ্টি হয়। এই চারটি তার থেকে সা, পা এবং কখনো এর সাথে রাগের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আরো একটি বা দু’টি সুর উৎপন্ন করা হয়।

এই দু’টি বা তিনটি স্বর একত্রে বেজে উঠলে শুধু দু’টি বা তিনটি স্বর নয়, যেন সাতটি সুরের রেশ একত্রে বেজে ওঠে, ফলে অনেকটা গুঞ্জনের মত মনে হয়। ইংরেজিতে যাকে ‘ড্রোন’ বলে তানপুরার সুর তা থেকেও স্বতন্ত্র। সে কারণে অনেকের মতে তানপুরাকে শুধু ‘ড্রোন’ বললে ঠিক বলা হয় না। কারণ প্রকৃতপক্ষে এর অবদান আরো বেশি। শুধু মূল সুরটা ধরে রাখা নয়, তার চেয়েও বেশি এর কার্যকারিতা।

এটি চক্রাকার প্রবাহের মাধ্যমে সুরের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সুরের এই ঐশ্বর্যকে পটভূমি হিসেবে রেখে কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করা হয়ে থাকে। তানপুরার গঠন অতি সাধারণ। চামড়ার ছাউনি প্রায় নব্বই সেন্টিমিটার চওড়া বড় লাউয়ের খোল দিয়ে তুম্বা তৈরি হয়। লাউটি উপযুক্ত আকারে কেটে এর খোলা অংশ পাতলা কাঠের তক্তা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। একে তবলী বলো হয়। একটা ছোট্ট কাঠের গলা জুড়ে দেওয়া হয় এবং তার সঙ্গে একটি ডান্ডা সংলগ্ন করা হয়।

ডান্ডাটিকে বলে পটরী। লাউয়ের নিচের অংশে একটি হাড়ের তৈরি লেঙুট আটকানো হয়। তবলীর ঠিক মধ্যখানে কাঠের তৈরি একটা ব্রিজ বা সওয়ারি আঠা দিয়ে লাগানো হয়। চামড়ার ছাউনি তানপুরার উপরের দিকে দু’টো হাড়ের তৈরি তারগহন পটরীর সঙ্গে আঠা দিয়ে যুক্ত করা হয়। তারপরে দন্ডের দু’পাশে এবং পটরীর উপরের অংশে দু’টো ছিদ্র করে কাঠের তৈরি চারটি খুঁটি বা বয়লা লাগানো হয়।

চারটি বয়লা থেকে চারটি তার দু’টি তারগহনের ভিতর দিয়ে তবলীর উপরে অবস্থিত সওয়ারি অতিক্রম করে লেভুটের সাথে সংযোজন করা হয়। গান গাওয়ার সময় মধ্যমা ও তর্জনীর সাহায্যে তারে ক্রমান্বয়ে আঘাত করে শব্দ উৎপন্ন করা হয়। ফলে সুন্দর একটি সুরের রেশ তৈরি হয়। একক বাদ্যযন্ত্র বাজাবার সময় একজন তানপুরা বাদক মূল যন্ত্রসংগীত শিল্পীর সাথে সঙ্গত করে থাকেন।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

পলিকর্ড

তানপুরার মত এটি শুধু সুর ধরে রাখার যন্ত্র নয়। এতে সুর বাজানো যায়, তবে একটি স্বরের জন্য একটি তার রাখতে হয়। ইংরেজিতে হার্প বলতে যে ধরণের যন্ত্র বোঝায় এটি আসলে সেই যন্ত্র। চামড়ার ছাউনি যতগুলো স্বর বাজাতে চাই ততগুলো তার সংযোজন করতে হবে। একটি তার থেকে পৃথক পৃথক সুর বাজানো যাবেনা, যেমন করে সেতার বাজানো হয়। “একটি তার একটি স্বর” এটি হচ্ছে এই জাতীয় যন্ত্রের মূল তত্ত্ব।

এই ধরণের যন্ত্রের সবচেয়ে প্রাচীন উৎস সম্ভবত শিকারীর ধনুক। ধনুকের ছিলার টঙ্কার ধ্বণি আদিম মানুষকে তার সংগীত উপযোগিতা সম্পর্কে কোন ধারণা দিয়ে থাকতে পারে। একটি মাত্র তার হওয়ায় সূচনায় এটি শুধু টানা সুর হিসেবে ব্যবহৃত হবো। একই ধনুকে অনেকগুলো তার যোজনা করে বিভিন্ন স্বর উৎপন্ন হলো এবং সৃষ্টি হলো হার্প।

পাশ্চাত্যে প্রচলিত বিভিন্ন ধরণের হার্প কম-বেশি ধনুকাকৃতির। আমাদের দেশে আধুনিক যুগে পলিকর্ডের উদাহরণ হচ্ছে সম্ভর এবং সুরমন্ডল।

 

বাদ্যযন্ত্রের আকৃতি ও নির্মাণকৌশলের বিবরণ ও কালানুক্রমিক আলোচনা (বিশ্লেষণ এবং বিবর্তনের ইতিহাস)

চিত্র – পলিকর্ড জাতীয় যন্ত্র : সুরমণ্ডল

মনোকর্ড

এই জাতীয় যন্ত্রে সমগ্র সুর বাজানোর জন্য একটি তারই যথেষ্ট। হয়তো বাদ্যযন্ত্রটিতে একাধিক তার থাকতে পারে, কিন্তু প্রত্যেকটি তার অপরগুলো ছাড়াই স্বতন্ত্রভাবে সুর সৃষ্টি করতে পারে। মনোকর্ড পর্দাযুক্ত বা পর্দাবিহীন হতে পারে, লম্বা গলার বা ছোট গলার হতে পারে, তার টেনে বাজানোর অথবা ধনুযন্ত্র হতে পারে, এবং প্রকৃতিতে তারা অসংখ্য হতে পারে।

প্রত্নতত্ত্বের আবিস্কার বিশ্লেষণ করে গবেষকরা জানতে পেরেছেন যে, এদেশের প্রথম যুগের বীণা ছিলো পলিকর্ড ধরণের। অর্থাৎ একটি তার একটি সুর। পরবর্তীকালে এর বিবর্তন সাধিত হয় এবং ধরণ পরিবর্তিত হয়। চামড়ার ছাউনি ক্রমান্বয়ে প্রাথমিক ধরণের বীণা পরিণত হয় আধুনিক মনোকর্ড যন্ত্রে। যেমন, স্বরস্বতী বীণা কিংবা সেতার।

 

বাদ্যযন্ত্রের আকৃতি ও নির্মাণকৌশলের বিবরণ ও কালানুক্রমিক আলোচনা (বিশ্লেষণ এবং বিবর্তনের ইতিহাস)

চিত্র – মনোকর্ড জাতীয় যন্ত্র সেতার

বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাসের যে সকল প্রামাণ্য পুস্তক বাংলায় রচিত হয়েছে সেখানে যন্ত্রের আকৃতি ও নির্মাণকৌশল নির্বিশেষে অর্থাৎ পলিকর্ড মনোকর্ড নির্বিশেষে সবগুলোকেই বীণা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলায় সবকটিকে বীণা বলা হলেও আকারগত প্রকারভেদ অনুসারে এগুলোকে হার্প (Harp), লিউট (Lute) অথবা জিথার (Zither) ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনে দেখা যায় কোন নির্দিষ্ট সময়ের পরিসরে হার্প জাতীয় যন্ত্র, আবার অন্য কোন সময়ে লিউট, কখনো বা জিথার জাতীয় যন্ত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছে।

প্রাচীন একতারের তারযন্ত্র কিভাবে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অথবা বলা যায় বার বার রূপ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কিভাবে আধুনিক সেতার, সরোদ বা এস্রাজের পর্যায়ে পৌঁছালো তা বুঝবার জন্য হার্প, লিউট, জিথার ইত্যাদির স্বরূপ জানা অত্যন্ত জরুরী। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সাথে সমন্বয় রেখে এখানে একটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা দেওয়া হলো ।

আরও দেখুন :

Leave a Comment