নির্মাণ উপকরণ এর সহজলভ্যতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের অবদান

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় নির্মাণ উপকরণ এর সহজলভ্যতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের অবদান

নির্মাণ উপকরণ এর সহজলভ্যতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের অবদান

 

নির্মাণ উপকরণ এর সহজলভ্যতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের অবদান

 

নির্মাণ উপকরণ এর সহজলভ্যতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের অবদান

বাংলাদেশে বর্তমানে যে বাদ্যযন্ত্রগুলো প্রচলিত রয়েছে সেগুলো বেশিরভাগই অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহ্য থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সংগীতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আঞ্চলিক বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে কিছু লোক বাদ্যযন্ত্র এদেশে রয়েছে যেগুলো শুধু একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলেই প্রচলিত।

এগুলো ছাড়া সামগ্রিকভাবে বিশেষত উচ্চাঙ্গ সংগীতের পরিবেশনে যে যন্ত্রগুলো প্রচলিত রয়েছে সেগুলো উপমহাদেশের ব্যাপক এলাকায় প্রায় অভিন্ন। যেমন, সেতার, সরোদ, সুরবাহার, এস্রাজ, দিলরুবা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। বর্তমান আলোচনা মূলত এইসব বাদ্যযন্ত্রকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

এই সমস্ত বাদ্যযন্ত্রের গঠনগত এবং ধ্বণিগত কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা। বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান বা প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে এ ধরণের ভিন্নতা এবং বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি হয়। উদাহরণের সাহায্যে বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা সহজবোধ্য হবে।

প্রথমে আসা যাক নির্মাণ উপকরণ প্রসঙ্গে। আমাদের দেশে প্রচলিত বাদ্যযন্ত্রগুলো কি দিয়ে তৈরি? সেতার, সুরবাহার, তানপুরা, সরোদ ইত্যাদি যন্ত্র তৈরি হয় মূলত কাঠ দিয়ে এবং এবং এদের বেশিরভাগের শব্দ প্রকোষ্ঠ বা সাউন্ড চেম্বার তৈরি হয় লাউ দিয়ে। কাঠের মধ্যে সেগুন এবং মেহগনি বেশি জনপ্রিয়। সেতার, সরোদ ইত্যাদিতে এই সব কাঠ ব্যবহৃত হয়। দোতারা, তবলা ইত্যাদিতে নিম কাঠ এবং আম কাঠও ব্যবহৃত হয়।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

এছাড়া লোকজ বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে বাঁশ এবং নারকেলের মালা ব্যবহৃত হয়। উপাদানগুলো একান্তই দেশীয এবং সহজলভ্য। ঐতিহাসিক অথবা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একই ধরণের নির্মাণ উপকরণ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দেয় একটি ভৌগোলিক এলাকায় কোন ধরণের উপকরণ সেখানকার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অবদান রাখবে। অর্থাৎ পরিবেশের উপর নির্ভর করে একটি অঞ্চলের সংস্কৃতির অনেক বিষয় গড়ে ওঠে।

মরু অঞ্চলে যেমন প্রচুর খেজুর গাছ জন্মায়, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে যেমন ডুমুর, আঙুর, কমলালেবু ইত্যাদি রসালো ফলের প্রচুর ফলন হয়, বনে জন্মায় সিডার, পাইন ইত্যাদি গাছ, তেমনি বাংলাদেশ ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত বলে এদেশে আম, নিম প্রভৃতি গাছ প্রচুর জন্মায়। তরিতরকারীর মধ্যে লাউ উল্লেখযোগ্য। বনাঞ্চলে জন্মায় সেগুন এবং মেহগনি কাঠ।

এছাড়া বাঁশ এবং নারকেল ও সহজলভা। এগুলোই আমাদের বাদ্যযন্ত্র নির্মাণের মূল উপকরণ। বিশেষ করে এদেশীয় বাদ্যযন্ত্রে শব্দ প্রকোষ্ঠ হিসেবে লাউয়ের ব্যবহার বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। শব্দ প্রকোষ্ঠ হিসেবে লাউয়ের ব্যবহার কোন ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্রে কখনো দেখা যায় না। এই শব্দ প্রকোষ্ঠ নির্মাণের বিষয়টি পাশ্চাত্যের যে কোন দেশ থেকে একেবারে আলাদা।

 

নির্মাণ উপকরণ এর সহজলভ্যতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের অবদান

 

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্রগুলো যে কাঠ দিয়ে তৈরি তা সাধারণত নরম প্রকৃতির কাঠ। গিটার, বেহালা, চেলো ইত্যাদি বহুল প্রচলিত বাদ্যযন্ত্রগুলো (শুধু পিয়ানো এবং হার্প ব্যতীত) পাইন, সিডার ইত্যাদি গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি। আমাদের দেশের বাদ্যযন্ত্রগুলো সাধারণত সেগুন, মেহগনি, নিম ইত্যাদি কাঠ দিয়ে তৈরি, একথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো বেশ শক্ত প্রকৃতির কাঠ।

তবলা তৈরি করতে হলে, অথবা সরোদের খোল তৈরি করতে হলে বড় কাষ্ঠখন্ড খুদে ভেতরটা ফাঁপা করে নিয়ে এগুলো তৈরি করতে হয়। শুধু সরোদ বা বীণা কেন, বীনা গোত্রীয় যতগুলো যন্ত্র রয়েছে, যেমন সেতার, সুরবাহার, তানপুরা, এস্রাজ, সারেঙ্গী, সুর-শৃঙ্গার ইত্যাদি সকল যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ শক্ত বড় কাঠের টুকরা থেকে প্রয়োজনীয় আকারের ছোট ছোট টুকরায় পরিণত করে, অত্যন্ত যত্নের সাথে নির্দিষ্ট আকৃতিতে নিয়ে এসে এবং সবশেষে মসৃণ করে এগুলোর কাঠামো তৈরি করা হয়।

ফলস্বরূপ মোলায়েম ধরণের শব্দ সৃষ্টি হয় যা বিভিন্ন ধরণের মীড়, গমক, ঘসিট, আশ, সুত, জমজমা ইত্যাদি বাজানোর জন্য খুব উপযুক্ত হয়ে ওঠে। এখানে পুনরায় আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এদেশীয় কোন যন্ত্র থেকেই খুব তীক্ষ্ণ ধরণের শব্দ উৎপন্ন হয় না। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্রগুলোর শব্দ তুলনামূলকভাবে তীক্ষ্ণ হয়ে থাকে। এটিকেও ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাব বলে ধরে নিতে হবে।

কেননা যুগের পর যুগ ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে এই সকল শব্দের শব্দের ধরণ পরিমার্জিত করা হয়। চূড়ান্তভাবে আমাদের বাদ্যযন্ত্রে আমরা যে আওয়াজ পেয়েছি (Final product) তা যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবে গড়ে ওঠা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রেও একই কথা সম্পূর্ণভাবে প্রযোজ্য।

সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় একটি পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রের এদেশের উচ্চাঙ্গ সংগীতের সাথে মিল রেখে অভিযোজন, তথা পরিমার্জন এবং কিছুটা রূপান্তরের উদাহরণ এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হবে। আলোচ্য বাদ্যযন্ত্রটি হচ্ছে পাশ্চাত্যের জনপ্রিয় হাওয়াইন গিটার। আমাদের দেশের উচ্চাঙ্গ সংগীতের যে বৈশিষ্ট্য – গভীরতা এবং পূর্ণতা, হাওয়াইয়ান গিটারের – অতি তীক্ষ্ণ শব্দের সাহায্যে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছিলো না।

 

নির্মাণ উপকরণ এর সহজলভ্যতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের অবদান

 

অথচ উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীদের কাছে এর জনপ্রিয়তা কিংবা গ্রহণ করার ইচ্ছা ক্রমশ বেড়ে চলছিলো। কাজেই শিল্পীরা এর তীক্ষ্ণতা হ্রাস করার গবেষণায় ব্রতী হলেন। ক্রমে এর শব্দ প্রকোষ্ঠ বড় আকারের করা হলো, তুলনামূলক মোটা তার ব্যবহারের প্রচলন এলো, এমনকি তারের সংখ্যায় পরিবর্তন এনে এবং তরফের তার সংযোজন করে এটি উপমহাদেশীয় উত্তরভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত বাদনের উপযুক্ত করে তোলা হলো।

সাম্প্রতিকতম সময়ে এর নামেও পরিবর্তন এসেছে এবং যন্ত্রটি এখন মোহনবীণা নামে বেশি পরিচিত। এর অপর নাম ইন্ডিয়ান স্লাইড গিটার।

আরও দেখুন :

Leave a Comment