আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলা নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা
বাংলা নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা
বাংলা নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা
১৯৩৬ সালে চিত্রাঙ্গদা কাব্যকে নৃত্য ও মূকাভিনয়ের মাধ্যমে ছাত্রীদের দিয়ে অভিনয় করার পরিকল্পনা করেন প্রতিমা দেবী। রবীন্দ্রনাথ যে কথা শুনে চিত্রাঙ্গদাকে অভিনয় উপযোগী করে গানের পরিবর্তন করে কাহিনী ও ভাবানুযায়ী সাজিয়ে দেন। পূর্বকৃত অনেকগুলো খন্ড নাচ যেগুলো প্রতিমা দেবী চিত্রাঙ্গদায় রাখতে চেয়েছিলেন সেগুলোর উপযোগী গানের কথা পরিবর্তন
করে দেন। যেমন:
- পূর্বের কথা
- সখী বহে গেল বেলা
- বাকি আমি রাখবো
- ও বধু সুন্দরী
- দূরের বন্দু সুরের দুতীরে
- দেখা না দেখার মেলা
- পরিবর্তিত কথা
- রোদন ভরা এ বসন্ত
- আমার এ রিক্ত ডালি
- তৃষ্ণার শান্তি
- কোন দেবতা সে
- স্বপ্ন মদির নেশায়
নব কুমার সিংহ ‘বাকি আমি রাখব না’ গানটির সঙ্গে যে নৃত্য কম্পোজিশন করেছিলেন। তাতে গানের কলির ফাঁকে ফাঁকে ছন্দানুযায়ী মণীপুরী খোলের বোল ছিল। তাতে নৃত্যটি অত্যন্ত জমজমাট লাগতো। এই নাচটি শ্রাবণগাথা এবং শাপমোচনে ব্যবহৃত আরেকটি নাচ, ‘দেখা না দেখার মেশা’ সঙ্গে নৃত্বের কম্পোজিশনে অভি বত্ব ছিল। নানা প্রকার নৃত্যভঙ্গির প্রয়োগে গানের উদ্দম ভাবটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
চিত্রাঙ্গদায় যখন গানটি থাকবে বলে স্থির হয় তখন কবি কথা বদল করে, স্বপ্নমদির নেশায় মেশা করে দিলেন। শিলচরে মণিপুরী নৃত্যশিক্ষকের পঞ্চম তালে একটি নৃত্য কম্পোজিশন করেছিলেন। সেই ছন্দে দূরের বন্ধু সুরের দুতীরে গান তৈরী করেছিল। ছন্দ ও ভঙ্গিবৈচিত্র্যে নাচটি ছিল খুবই আকর্ষণীয়। চিত্রাঙ্গদায় এই নাচ ব্যবহারের জন্য কবি কথা বদল করে কোন দেবতা সে পরিহাসে’ করে দিলেন।
কোচিনের মহারাজার প্রেরিত কল্যাণের আম্মা শান্তিনিকেতনে লোকনৃত্যের ঢং-এ ‘ওগো বধু সুন্দরী’ গান এর সাথে তালের নাচ শিখিয়ে ছিলেন। এটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছিল কখনো শাপমোচনে কখনো শ্রাবণগাথায়। চিত্রাঙ্গদার জন্য কবি এই নাচটিকে ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’ গান দিয়ে গেঁথে দেন।
১৯৩৬ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত চিত্রঙ্গদা প্রায় ৪০ বার অভিনীত হয়। প্রথম দুবছর চিত্রঙ্গদার নৃত্য আঙ্গিকে মণিপুরী নৃত্যধারা প্রয়োগ বেশি দেখি। কারণ সে সময় শান্তি নিকেতনে ব্যাপকভাবে মণিপুরী নৃত্যের চর্চা চলছিল। এ ছাড়া ছিল মালাবার ও বাংলার অন্যান্য প্রাদেশিক লোকনৃত্যের ভঙ্গি । ১৯৪০ সালের পরে নৃত্যাঙ্গিকে অন্যান্য অনেক ধারা যুক্ত। সেই সময়ে জাপানী ছাত্র মার্কী প্রাচীন জাপানী নৃত্য পদ্ধতি এবং ইউরোপীয় নৃত্যধারা মিশিয়ে মদনের ভূমিকায় নেচেছিলেন।
শান্তিদের ঘোষ জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, প্রতিমা দেবী থেকে শুরু করে শান্তি নিকেতন বাসী সকলেই এই নাচ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে কেলু নায়ার শান্তি নিকেতনে অধ্যাপক যোগ দেওয়ার পর অর্জুন কথাকলি নৃত্যভঙ্গিতেই করা হত। তবে শাস্ত্রবদ্ধ মুদ্রাভঙ্গি রবীন্দ্রনৃত্যে খাপ খায় বলে হাত, মুখ ও চোখের ভাবভঙ্গি প্রকাশ করা হত সহজ ভাবে, গানের ভাবের সাথে মিলিয়ে, কথাকলির বাঁধা নিয়মে নয়।
গ্রামবাসী, বনচর প্রভৃতি সমবেত নৃত্য কিছুটা সিংহলের ক্যান্ডি বা দেশীয় লোকনৃত্যের আদলে তৈরী করা হয়। চিত্রাঙ্গদায় লক্ষনীয় চার/চার ছন্দের মণিপুরী কাওয়ালী তালের আধিক্য । তার সঙ্গে দাদরা, ঝাপতালও তেওরা গৌণভাবে স্থান পেয়েছে। দক্ষিণী তাল তেওরা ও দাদরা যদিও ব্যবহৃত হয়েছিল তবুও তা মণিপুরী খোলেতেই বাজানো হত।
কারণ মণিপুরী নাচের সঙ্গে খোলের বোল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং মণিপুরী খোলেই এইসব ভালবাদ্য অন্য এক আমেজ নিয়ে আসতো। পরবর্তীকালে অবশ্য কুরূপা চিত্রঙ্গদার মঞ্চে প্রবেশ এবং শিখার দৃশ্য এবং অর্জুনের প্রবেশের দৃশ্যে দক্ষিণ ভারতীয় তাল যন্ত্র চাড্ডা, মৃদঙ্গম প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়েছে।
নৃত্যকে মাঝে মাঝে স্বচ্ছন্দ্য বজায় রেখে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য এবং তার স্বরূপ ও স্বভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য, কেবল মাত্র তাল যন্ত্রের সঙ্গে নৃত্যের প্রচলন আছে ভারতীয় সব নৃত্যপদ্ধতিতেই। রবীন্দ্রনাথ এই পদ্ধতি অনুমোদন করেছেন কখনো কখনো। চিত্রাঙ্গদায় দেখা যায় প্রথম গানটি নেপথ্য থেকে পাওয়া হয়, তার পরই তালবাদ্যের সঙ্গে চিত্রঙ্গদা ও সহচরিদের মঞ্চে প্রবেশ এবং শিকারের আয়োজন সূচক নৃত্য।
চিত্রাঙ্গদার স্নানে আগমনের দৃশ্য, গ্রামবাসীদের অস্ত্রদানের দৃশ্য ইত্যাদি। চিত্রাঙ্গদার নৃত্যের আর একটি উল্লেখ্যযোগ্য বৈশিষ্ট্য আবৃত্তির সঙ্গে নাচ। চিত্রাঙ্গদা রচিত হওয়ার পূর্বেই কবি এই দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন। চিত্রাঙ্গদার ২২টি নৃত্য ছন্দে আবৃতি রয়েছে। প্রথম যুগে কবি নিজে সাধারণ ভাবে আবৃত্তিগুলো করতেন। পরবর্তী আবৃত্তির সঙ্গে নৃত্যছন্দে অভিনয়ের প্রচলন করলেন। তার পর থেকে এই রীতি প্রচলিত হয়ে আসছে। নাটকের ঘটনাসূত্রের যোগ রাখা এবং দর্শকচিত্রকে বিশ্রাম দেওয়াই এর কাজ।
আরও দেখুন :