পঞ্চগীতিকবির গানের উপসংহার
পঞ্চগীতিকবির গানের উপসংহার
পঞ্চগীতিকবির গানের উপসংহার
মানুষের সৃজনশীল প্রবৃত্তিকে বিকশিত করতে দেশাত্মবোধ বা স্বদেশচেতনা অতুলনীয় হৃদয়বৃত্তিরূপে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে বাঙালিসত্তার ইতিহাস ঘাটলে দেশাত্মবোধই হবে সংস্কৃতিসত্তা প্রতিষ্ঠার প্রধান ও প্রাচীনতম নিয়ামক। সুর প্রলেপিত স্বদেশচেতনা বিনির্মাণে সংগীতের ভূমিকা অপরিসীম। দেশাত্মবোধের মর্মবাণী সুরের জাদুস্পর্শে পরিণত হয় পরিবর্তনের এক মহাশক্তিশালী প্রতিবাদ হয়ে।
উনবিংশ শতকে বাংলা সংগীতের ইতিহাসে একটি বিশেষ বিবর্তনের অধ্যায় সূচনা করেন রাজা রামমোহন রায়। তাঁর ১৮১৫ সালে গড়া আত্মীয় সভা’ ও ১৮২৮ সালে ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এর প্রতিষ্ঠা মূলত বাংলা সংগীতের ধারা উন্মোচন কল্পে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ব্রাহ্মসমাজের সভ্যরা পৌত্তলিক ধর্মসংগীতের পরিবর্তে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা সংগীত রচনাতে মনোযোগী হন।
তাঁরা স্বাধীন ও উদার ভাবনা এবং একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। ফলে নিজস্ব সংস্কৃতি ও উপাসনার ফলশ্রুতিতেই সংগীতকলার সূত্রপাত। এক অর্থে স্বদেশি সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয় এই সময়ে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্বদেশ সংগীতের মধ্যদিয়ে উদ্দীপনা প্রবাহের উন্মেষ ঘটে। এই সময় বাঙালির মনে দেশপ্রেমের উদ্রেক হয় এবং ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে শত শত গান রচিত হয়।
দীর্ঘদিন ইংরেজ শাসনের অধীনে থেকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সভ্যতায় মুগ্ধ বাঙালি নিজের ঐতিহ্যের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। এমনকি ইংরেজরা ভারতবাসীর মঙ্গলার্থে ও উন্নতি সাধনে শিক্ষার বিস্তার করেছেন এই ভাবনার দরুন অনেক ভারতবাসীর মনে ইংরেজদের প্রতি বন্ধুবৎসল উদারতা যেমন আশ্রয় করে; তেমনি নিজেদের শক্তি, সংস্কৃতির প্রতি সন্দেহ ও অশ্রদ্ধা জাগতে শুরু করে যা একটি জাতির জন্য হতাশার সবচেয়ে বড় কারণ।
এই হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে সকলকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশ নৈরাশ্য আর অশ্রদ্ধার বেড়াজাল থেকে ভারতমাতাকে মুক্ত করতে সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করে। স্বজাত্যপ্রীতির তাগিদ ও প্রবণতা দেখা দেয় সর্বত্র। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জাতীয় চেতনা পুনরুদ্ধারে বাংলা স্বদেশচেতনায় সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার নানাবিধ চর্চা শুরু হয়। তারমধ্যে ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠা একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা।
এ সময় স্বদেশচেতনা-নির্ভর উদ্দীপনাময় গান-কবিতা রচনা ও চর্চার উন্মেষ ঘটে সর্বত্র। শত শত স্বদেশচেতনাবাহী গান রচিত হতে থাকে হিন্দুমেলার ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডকে ঘিরে। ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্লোগান স্বরূপ সংস্কৃতির ছায়াতলে স্বদেশপ্রেমকে জাগ্রত করতে থাকে নীরবে; তবে তাদের শত্রুজ্ঞানে নয়, বরং স্বদেশমাতার বন্ধুজ্ঞানে।
ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে হিন্দুমেলাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি কালপর্যায়ে স্বদেশসংগীতের ধারা বিপুলভাবে বিকশিত হয়। স্বদেশসংগীত, স্বদেশপ্রেমের গান, স্বদেশি গান, দেশাত্মবোধক গান অথবা মুক্তির গান—এই সকল নামে বহু গীতিকবিদের রচনায় স্বদেশপ্রেমবোধ প্রস্ফুটিত হতে থাকে। এসবের কারণেও মূলত একের পর এক ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাতে স্বদেশবাসীকে স্বদেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজনের তাগিদ দেখা দেয়।
প্রকৃতপক্ষে সিপাহি বিদ্রোহের মধ্যদিয়ে স্বদেশি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সিপাহি বিপ্লবকালে ভারতবাসীর নিরাপত্তার প্রতি ইংরেজদের উদাসীনতা, ইংরেজদের স্বার্থপরতার রূপটি প্রকট হয়ে প্রকাশিত হলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন আরো তীব্রতা লাভ করে। এ দেশবাসী বুঝতে পারে তারা নিদারুণভাবে পরাধীন এবং জিম্মি হয়ে পড়েছে ইংরেজদের চতুরতার কাছে। তখন থেকেই দেশীয় শিল্প-সাহিত্য ও সংগীতের প্রকাশ লাভের চেষ্টা চলতে থাকে।
কারণ নিজস্ব যা কিছু তার মধ্যেই পরাধীনতা থেকে মুক্তির চেতনা নিহিত থাকে। সিপাহি বিদ্রোহের পরে স্বদেশি আন্দোলনের প্রবল জোয়ার দেখা দেয় ব্রিটিশ শাসক ও শোষণের বিরুদ্ধে। দেশাত্মবোধক গান রচনার মধ্যদিয়ে নবজাগরণের এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হলো। স্বদেশকে পরাধীনতার কালিমা থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় জনচিত্ত জেগে উঠলো তীব্র আবেগে। ইতিহাস পেল বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ অর্জন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
স্বদেশি যুগের সূচনা মূলত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি গান সেই আন্দোলনের মূল সম্পদ ও অনুপ্রেরণার সোপান হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর রাখীবন্ধন উৎসব বাঙালির মনে ভ্রাতৃত্ববোধের গভীর ছায়া ফেলে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠান সারা বাংলায় প্রাণ চাঞ্চল্যের জোয়ার বইয়ে দেয়। কণ্ঠে কণ্ঠে সেদিন গীত হয়, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল / বাংলার বায়ু বাংলার ফল পূর্ণ হউক।’
এ সময়ের একটি অন্যতম দাবি ছিলো হিন্দু-মুসলমান, ধনী-গরিব অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক ঐক্য স্থাপন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই পটভূমি রচনার উদ্দেশ্যে পালন করলেন রাখী বন্ধন উৎসব। বাংলার এই মিলন সংগীত প্রসঙ্গে আজও একটি বিষয় অবশ্য উল্লেখ্য, হিন্দুমেলা যুগে যে নবজাগরণের অধ্যায়ের সূচনা হয় তা মূলত হিন্দু ধর্মের আদর্শকে কেন্দ্ৰ করে।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের একচ্ছত্র প্রবেশাধিকার গড়ে ওঠেনি চৈত্রমেলা বা হিন্দুমেলায়। বিশেষত ব্রাহ্মসমাজের সভ্যরা এই মেলার সূত্রপাত করেন এবং নামকরণ থেকে শুরু করে সর্বত্র হিন্দু জাতীয়তাবোধের ভাবনাকেই ত্বরান্বিত করেন। স্বাদেশিক ধারণা মূলত হিন্দু আদর্শিক ধারণা দ্বারা পরিচালিত হতো। স্বদেশি আন্দোলনে বঙ্কিমচন্দ্রের স্বাদেশিক জাতীয়তাবোধও মূলত তাই। স্বাধীনতা অর্জনের মতো বিশাল স্বপ্ন কখনো আরেকটি সম্প্রদায়কে বাদ রেখে সম্ভব নয় বলেই কংগ্রেসের আবির্ভাব।
কংগ্রেসেই প্রথম হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যের বিষয়টিকে গুরুত্বারোপ করা হয়। কংগ্রেসের অধিবেশনকে কেন্দ্র করে রচিত হয় সম্প্রীতির গান। ১৮৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ সংগীত আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ মূলত কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতি ও ঐক্যের আহ্বানে গানটি রচিত হয়। ইংরেজরা জানতো হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্যের সম্পর্ক বজায় থাকলে তারা কখনো বঙ্গভঙ্গ করতে পারবে না।
তাই সুকৌশলে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মুসলিম সম্প্রদায়কে প্ররোচিত করতে থাকে যে বঙ্গভঙ্গ হলে পূর্ব বাংলার মুসলিমরা প্রাধান্য পাবে। এই যুক্তিতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে ভাঙনের চেষ্টা করে ইংরেজরা। ইংরেজরা বিশ্বাস করতো নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্যের ঘাটতি থাকলে বাঙালির শক্তি কমে যাবে এবং আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন তাদের পক্ষে বঙ্গকে দ্বিখণ্ডিত করা সহজ হবে।
ইংরেজদের এই চক্রান্তের বিষয়টি অনুধাবন করে স্বদেশচেতনায় দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রতি বেশি জোর দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্বদেশ সংগীত রচনায়। ইংরেজরা বুঝে গিয়েছিল বাঙালিকে বিভাজন করতে পারলেই তাঁদের সকল উদ্দেশ্য সহজেই বাস্তবায়ন হবে এবং তা ফলপ্রসূ হবে। এই অভিপ্রায়ে মুসলিমদের একটি শ্রেণিকে প্রলুব্ধ করবার চেষ্টা চালাচ্ছিল তারা।
ইংরেজদের এই বিভাজননীতিকে ধুলিসাৎ করবার জন্য শিক্ষিত বাঙালি গীতিকবিদের আরো সচেতন হতে হলো- এই মর্মে যে ঐক্যই বড় শক্তি। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণের বিভাজন কমিয়ে সম্প্রীতির শক্তিকে মজবুত করবার প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথসহ বহু গীতিকবি ঐক্য সাধনের লক্ষ্যে দেশাত্মবোধক বহু গান রচনা করেন এবং এই সকল গান বিপুল অনুপ্রেরণাদায়ী ভূমিকা পালন করে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর গানে বৈচিত্র্যতার সমাবেশ ঘটিয়ে নাটকের মধ্যে স্বদেশের গান যুক্ত করলেন। শুধু তাই নয় বিলেত থেকে ফিরে সেই ধাচের খাড়া খাড়া সুরের প্রয়োগে রচনা করলেনস্বদেশি আন্দোলনে স্বদেশপ্রেমের অন্য ধাচের প্রেরণাদায়ক গান। গানের কথা এবং সুরের দোলাতে স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রাণ জেগে উঠলো। তাঁর ‘বঙ্গ আমার, জননী আমার’ গানটি একটি অনন্য আবেদন সৃষ্টিকারী গান ছিলো তখন।
নূরজাহান নাটকের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটি তো এ সময়ে এসেও স্বদেশি গানের অহংকার হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেকোনো জাতীয় উৎসবের এক ভুলনাহীন দেশাত্মবোধক গান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এটি বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয় ছিলো। সে দিন সুনীল সাগরে’, ‘মেবার পতন’ প্রভৃতি গান সে সময়ে অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত ও প্রাসঙ্গিক ছিলো।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কিছু হাসির গান তখন ব্যঙ্গরীতিতেও রচনা করেন। যার অন্তরালে মূলত স্বদেশপ্রেমকে ব্যক্ত করেন কবি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে তাঁর এই সকল গান মূলত আন্দোলনকে বেগবান করতে প্রেরণা জুগিয়েছে।
“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটি সর্বকালের শাশ্বত বাঙালি মায়ের রূপের কল্পনা দেয়। হীন দরিদ্র মায়ের জন্য একপ্রকার অদৃশ্য কল্পনায় আদর ছেয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এই ধারার গান রচনায় স্বদেশি আন্দোলনে সিদ্ধহস্ত রজনীকান্ত সেনও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কিছু স্বদেশি গান রচনা করেন। তাঁর ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে সকলের মুখে মুখে গীত হতো।
ইংরেজি পোশাকে অভ্যন্ত বাঙালি জাতিকে মোটা সুতার কাপড়ে অভ্যস্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এই গানে। পণ্য ব্যবহার মানেই ইংরেজদের দাসত্ব মাথা পেতে নেয়া। স্বদেশি আন্দোলনে তাই তাঁর এই গানটি বিলেতি চালে অভ্যন্ত বাঙালিদের টনক নড়াতে সহায়ক হয়। তাঁর স্বদেশপর্বের গানে আন্দোলনের প্রতিবাদী বাণী নয়, বরং স্বদেশের রূপ বর্ণনা, কখনো স্বদেশমাতার দুঃখ-দুর্দশার কথা এবং তার থেকে পরিত্রাণের পথের দিশা দিয়েছেন রজনীকান্ত সেন।
অতি সহজ সরল সুরে অতুলনীয় কথামালার মায়াভরণে রচিত তাঁর স্বদেশপর্বের গানসমূহ। যেমন ‘রে তাঁতী ভাই ফুল্লার করে হুকুমজারি’, ‘তাই ভালো মোদের মায়ের ঘরে শুধু ভাত”, ‘জয় জয় জন্মভূমি, জননী!’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। প্রেমের গানে সিদ্ধহস্ত অতুলপ্রসাদ সেন স্বদেশ প্রেমের গান যত না রচনা করেছেন তারচেয়ে বেশি করেছেন জনসেবামূলক কাজ।
লক্ষ্মৌ-এর সেনবাবু নামে খ্যাত অতুলপ্রসাদ সেন সকলের দুঃখ-দুর্দশার সাথী হয়ে পাশে দাঁড়াতেন। মাতৃভাষার প্রতি প্রেম ও প্রচারকল্পে কাজ করেছেন কবি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির সাথে যুক্ত ছিলেন শিক্ষাকর্মের প্রসারের জন্য। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা তিনি মাত্র ১৩টি গানের ভিতর দিয়ে অতীতকালকে স্পর্শ করেছেন। অতুলপ্রসাদের গান জুড়ে থাকে গভীর আবেগময়তা, সাম্প্রদায়িক ঐক্য, দেশের ভবিষ্যৎ গড়বার স্বপ্ন এবং তার দিক-নির্দেশনায় কর্মের আহ্বান।
তিনি প্রকৃতই একজন দেশপ্রেমিক কবি যার রচিত ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’ গানটি স্বদেশসংগীতের ভাণ্ডারে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের চির বরণীয় গান হয়ে বেঁচে থাকবে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা হিন্দুমেলার সময় থেকে বঙ্গভঙ্গপর্ব অর্থাৎ স্বদেশি যুগ পর্যন্ত বাঙালির স্বদেশচেতনা বিকাশে অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। প্রায় চল্লিশ বছর (১৮৬৭-১৯১১) স্বদেশি গানের জোয়ারে যুক্ত হয়েছেন অসংখ্য গীতিকবি।
জনজাগরণে তাঁদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। মুকুন্দ দাস, অশ্বিনীকুমার দত্ত (১৮৫৬-১৯২৩), কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ (১৮৬১-১৯০৭), কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩), সরলাদেবী চৌধুরানী (১৯৭২-১৯৪৫) প্রমুখ বঙ্গভঙ্গ যুগে স্বদেশসংগীত রচনায় বিপুল অবদান রয়েছে। এছাড়াও বিপিনচন্দ্র পাল, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখের রচনাও স্বদেশি গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরে স্বদেশি গান রচনায় একটা ভাটা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসহযোগ আন্দোলনের সাথে মতানৈক্যের কারণে সরে দাঁড়ান। তাঁর সাথে সমসাময়িক অনেক গীতিকবির নীরবতা লক্ষ্য করা যায়। স্বদেশি আন্দোলনে এরই মধ্যে রজনীকান্ত সেন (১৯১০) ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৯১৩) প্রয়াণ একটা গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে ইংরেজবিরোধী আন্দোলন বৈপ্লবিক তথা সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ লাভ করে।
ইংরেজ সরকার ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ধর-পাকড়, ভয়- ভীতি, অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করলে ব্রিটিশ সরকারবিরোধী রক্তাক্ত অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। প্রফুল্লচাকি, ক্ষুদিরাম বসুর আত্মদানে এক রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অভূতপূর্ব অধ্যায়ের সূচনা হয় যার হাল ধরে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের পন্থা। স্বদেশসংগীত রচনার এই ভাটাকালে অন্যধারার স্বদেশসংগীতের কলেবর নিয়ে আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম।
নবধারার স্বদেশি উদ্দীপনায় তিনি কেবল শূন্যতাই পূরণ করলেন। না, স্বদেশি গানে আন্দোলনের ঝড় তুলে দিলেন। ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ নজরুলের প্রথম রেকর্ডকৃত গান ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, নারী জাগরণ, যুব জাগরণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে বারুদের মতো উচ্চারিত হতে লাগলো তাঁর রচিত স্বদেশপর্বের গানে।
সাহিত্যমূল্য বিশ্লেষণে এই পঞ্চগীতিকবির স্বদেশপর্বের গান যেমন স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র তেমনি সুর প্রয়োগেও স্বাতন্ত্র্যের ছাপ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। তন্মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, ডি. এল. রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদ সেনের গানের সময়কাল খুব কাছাকাছি এবং গান রচনার প্রেক্ষাপটও একই ছিলো বলে সুর ও বাণীতে রবীন্দ্র- আদর্শিক বলে মনে হতে পারে। কারণ সেই সময়টা ছিলো রবীন্দ্র বলয়ের ছায়াপাতে ঘেরা।
তাই বাণীর গভীরতা ও সুরের সরলতা সেই সময়ে রচিত সকল গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্বদেশসংগীত রচনাতে সুরের কালোয়াতি সাধারণের কর্ণগোচর হবে না এই বিশ্বাসটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পরিলক্ষিত হয় রবীন্দ্র-অতুল- রজনী-দ্বিজেন্দ্র রচিত স্বদেশের গানে। স্বদেশি আন্দোলনে তাই প্রত্যেকেই লোকসুরের সাদামাটা বাউলের ঢংটি বেশি গ্রহণ করেছেন। স্বদেশের কথা বলতে গেলে অবশ্য তাই নিজের চিরচেনা সুরের প্রয়োগই প্রাসঙ্গিক। তবেই তা সকলের গান হয়ে উঠবে।
বিষয়টি তেমনই হয়েছিল বটে। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘যদি তোর ডাক শুনে’ প্রভৃতি গান বাউল ও রামপ্রসাদী অর্থাৎ লোকধারা সুরে রচিত। ডি. এল. রায়ের ‘একবার গাল ভরা মা’, অতুলপ্রসাদের ‘মোদের গরব মোদের আশা’, রজনীকান্তের মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সবই সহজ সরল লোকসুরের আশ্রয়ে রচিত, বিশেষত সাধারণের হৃদয়ে স্বদেশি গানের বাণীটি প্রতিস্থাপনই ছিলো মূল উদ্দেশ্য, তাই এই পন্থার অবলম্বন ।
কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর বহু দেশাত্মবোধক গানে লোকসুরের আশ্রয় নিয়েছেন। ‘শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের’, ‘একি অপরূপ রূপে’, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে এমন বহু গানে লোকসুরের আশ্রয় পাই। এছাড়াও নজরুলে মার্চ সুরের ব্যবহার স্বদেশপর্বের গানে একটি নতুন পন্থার প্রয়োগ । স্বদেশি আন্দোলনে তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সেনাবাহিনীতে ছিলেন বলেই এই সুরটির প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মে এবং উদ্দীপনামূলক গানে মার্চ সুরের ব্যবহারে গানকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছেন।
তাঁর কালজয়ী দেশাত্মবোধক অধিকাংশ গানই মার্চ সুরে রচিত। ‘চল্ চল্ চল্’, ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘শিকল পরা ছল’ প্রভৃতি বিখ্যাত সকল গান মার্চ সুরের দ্রুত ছন্দে রচিত যা আজও উদ্দীপনায় যৌবনের জয়গান গেয়ে চলে। রবীন্দ্র-ডি. এল. রায়ের আমলেও এই ধারার বিদেশি সুরের চলনের প্রয়োগ দেখা যায়। যেখানে সুরটি লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এবং একটি ছান্দিক দোলা জাগায় মনে।
যেমন ডি. এল. রায়ের ‘বঙ্গ আমার, জননী আমার’, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ এই বিখ্যাত গানগুলোতে বিদেশি সুরের চলন পরিলক্ষিত। তাছাড়াও রাগ-রাগিণীর মিশ্রণ পঞ্চগীতি কবির প্রত্যেকেরই স্বদেশপর্বের গানে পরিলক্ষিত হয়-যা গানকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। তবে উল্লেখ্য যে, পঞ্চগীতিকবি রচিত গানে সুর প্রয়োগে রাগ-রাগিণীর ব্যবহারের থেকে সহজ সরল লোকসুরের প্রয়োগ অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে জনমনে।
পঞ্চগীতিকবির স্বদেশপর্বের গানে চেতনানির্ভর আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের মোট রচিত গানের প্রায় ২২২৩টির মধ্যে ৪৬টি স্বদেশপর্যায়ের গান, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মোট গানেররাষ্ট্রীয় মর্যাদা সংখ্যা ৫১১টির মধ্যে স্বদেশপর্বের গান ১৯টি, রজনীকান্ত সেনের ৩০১টি গানের মধ্যে স্বদেশপর্বের গান ১৬টি, অতুলপ্রসাদ সেনের ২০৬টি গানের মধ্যে স্বদেশপর্বের গান ১৩টি এবং কাজী নজরুলের প্রায় ৩১৭৪টি গানের মধ্যে স্বদেশপর্বের ১০৯টি গান পাই।
অসহযোগ আন্দোলনের পরেও এই সকল স্বদেশপর্বের গানের আবেগ থেমে যায়নি, বরং বহু গুণে বেড়ে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ে বাংলাদেশের সোপান রচনায় অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেছে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের বীজ বপন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সবকয়টি অধ্যায়ে এই সকল গান গণমানুষকে উদ্দীপ্ত করে চলেছে।
আশার আলোর মশাল হয়ে পথ দেখাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাংস্কৃতিক বলয়ে ঘেরা সমৃদ্ধ এই সোনার বাংলা গঠনে এই সকল স্বদেশপর্বের সংগীতের ক্ষেত্রে অবদান রয়েছে। যে রবীন্দ্রনাথের গান এই বাংলায় গাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
পাকিস্তানি সরকার, সেই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্বের সংগীত মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সর্বাধিক প্রেরণাদায়ী গান ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’কে তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিলেন দিলেন জাতীয় সংগীতের সর্বোচ্চ মর্যাদার আসন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ে কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে বর্বর ও নির্মমভাবে হত্যার মধ্যদিয়ে ইতিহাসের যে ঘৃণ্য অধ্যায়ের সূচনা হয়।
তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার সংস্কৃতির উদীয়মান স্বপ্নে বিভোর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে চ্যুত হয়নি। এদেশের শিল্পী, গীতিকবিরা। ১৯৮৭ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ১৯৯১ সালের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন, ১৯৯৬ সালে মৌলবাদের উত্থানে যশোরে উদিচির সম্মেলন ও রমনার বটমূলে ১লা বৈশাখের বোমা হামলাসহ ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিহতকরণে এই সকল গীতিকবিদের গান আশা জাগানিয়া ভূমিকা পালন করেছে।
২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চে এই সকল স্বদেশপর্বের গানও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে। জাতীয় জীবনের যেকোন উৎসব ও সংকটে পঞ্চগীতিকবির স্বদেশচেতনার গান আজও অগ্রণি ভূমিকা রেখে চলেছে।
এ বছর (২০২২ ) জুন মাসে সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল বন্যাকবলিত হলে বাণভাসী অসহায় মানুষের জন্য ত্রাণ সংগ্রহে ঢাকা শ্বিবিদ্যালয়ের টিএসসি প্রান্তর থেকে কানে ভেসে আসে রবীন্দ্রনাথের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ গান। একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল সময়ে নতুন প্রজন্ম পরিত্রাণের পথ খুঁজছে এইসকল স্বদেশচেতনার গানের ভিতর দিয়ে।
সৃষ্টির শতবছরেরও বেশি সময় পরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটি কানে বাজলে স্বদেশের জন্য হৃদয় আকুল হয়। যে যেখানেই থাকুক স্বদেশমাতার শ্যামলবরণ ছবি, অঘ্রাণের ভরা খেত চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পঞ্চগীতিকবির স্বদেশচেতনাবাহী এই সকল গানের সার্থকতা এখানেই। চির অমরত্বের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই সকল হৃদয় নিংড়ানো স্বদেশপ্রেমের গান।
বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে পৃথিবীব্যাপী চলমান বিচিত্র সংকটে পঞ্চগীতিকবির স্বদেশচেতনাবাহী গান একত্রিতকরণ, আবিষ্কার ও নবরূপে বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন এই গবেষণার প্রাণবস্তু। তাছাড়া বক্ষ্যমান এই গবেষণায় বিশ্লেষিত গানসমূহের প্রভাব আলোচনার মাধ্যমে উৎকর্ষ শিল্প মানদণ্ড বিচারে এ সকল গানের সার্থকতা ও সফলতার প্রতিষ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে যা নতুন গবেষণার দিগন্ত উন্মোচিত করবে।
তাই শতসহস্র বছর পরেও এ সকল গানের এমনি গ্রহনযোগ্যতা থাকবে; শিল্পী, শ্রোতা ও সর্বসাধারণচিত্তে এমনি বলিষ্ঠ অনুপ্রেরণায় প্রাণের দিশা দেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করি।
আরও দেখুন :