পারিবারিক বলয়ে স্বদেশ

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় পারিবারিক বলয়ে স্বদেশ

পারিবারিক বলয়ে স্বদেশ

 

পারিবারিক বলয়ে স্বদেশ

পারিবারিক বলয়ে স্বদেশ

পারিবারিক আবহেই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা অর্থাৎ স্বাদেশিকতার গোড়াপত্তন ঘটে। ইংরেজদের উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণ জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। জাতীয়তাবোধ ও স্বাদেশিকতার আদর্শের মূল মন্ত্র প্রায় সমতুল্য হলেও দেশকে পরাধীনতার গ্রাস থেকে মুক্ত করার যে চেতনা তাই জাতীয়তাবোধ। আর সকল সংকটের ঊর্ধ্বে দেশকে মাতৃরূপে গণ্য করাকেই স্বাদেশিকতা বলা যেতে পারে।

জাতীয়তাবাদী চেতনাই মূলত স্বদেশচেতনার জন্ম দিয়ে দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির পথ দেখায়। আন্দোলন, অনশন প্রমুখ পন্থার মধ্যদিয়ে মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ। রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিকতার প্রকাশ ঘটে কৈশোরে হিন্দুমেলায় জাতীয়তাবাদী উত্তাপের মধ্যদিয়ে। সে বিষয়ে আহমেদ রফিকের নানা আলোয় রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থ থেকে বক্তব্য তুলে ধরা হলো-

“রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিকতার প্রকাশ যদিও চৈত্রমেলা তথা হিন্দুমেলার জাতীয়তাবাদী উত্তাপে, তবু এর প্রকাশ মূলত বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী নির্মমতার প্রতিবাদী রচনায়: যেমন-আফ্রিকায় বুয়র যুদ্ধে এবং চীনে বক্সার যুদ্ধে ইংরেজ সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে বক্তব্যে। উনিশ শতকের শেষ দিনটিতে শিলাইদহে বসে লেখা ‘শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ মাঝে অন্ত গেল’ এবং অনুরূপ কবিতায় তীব্র সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বিরোধিতার প্রকাশ ঘটেছে।

বিশ শতকের প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ এমন ভাবনায় নিশ্চিত হন যে স্বাদেশিকতার কাজ শুরু করতে হবে দেশের বৃহত্তর জনশ্রেণী গ্রামবাসীদের মধ্য দিয়ে। তাঁর চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ইংরেজি শিক্ষিত সচ্ছল রাজধানীর এলিট শ্রেণীর নগর শহরের সঙ্গে গ্রামের বিশাল ফারাক। একসময় এমন কথাও লেখেন যে শহর রয়েছে বিশ শতকের আধুনিকতায়, অন্য দিকে গ্রাম পড়ে আছে মধ্যযুগে। ”

রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালে শিক্ষিত লোকজন দেশের ভাষা ও দেশের ভাব দূরে ঠেলে রেখেছিলো। সময়টি মোটেই স্বদেশপ্রেমের ছিলো না। যদিও রবীন্দ্র-পরিবারে এর ব্যতিক্রমী ছবি দৃশ্যত। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির লোকেরা ছোটবেলা থেকে স্বদেশের প্রতি গভীর অনুভূতি পোষণ করে বেড়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কথা সর্বাগ্রে গণ্য।

তিনি ছিলেন যেমন ধনী তেমনি সৌখিন। শুধু তাই নয় স্বদেশের মঙ্গলের জন্য তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজস্ব ঐতিহ্য তথা ভারতীয় জাতীয় বৈশিষ্ট্যের মর্যাদার প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যা তাঁর স্বজাত্যবোধ, পোশাক-আশাক এবং চালচলনে পরিলক্ষিত হয়।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন- আমাদের পিতৃদেব যখন স্বদেশের প্রচলিত পূজাবিধি পরিত্যাগ করিয়াছিলেন তখনো তিনি স্বদেশী শাস্ত্রকে ত্যাগ করেন নাই ও স্বদেশি সমাজকে দৃঢ়ভাবে আশ্রয় করিয়াছিলেন। তিনি বিলেতে থাকাকালীন সময়েও নিজের দেশের জাতীয় পোষাক পরিধান করতেন। তাঁর এ সকল বৈশিষ্ট্য ঠাকুর পরিবারের অন্য সদস্যদের সদা অনুপ্রাণিত করেছে।

দ্বারকানাথপুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে স্বাদেশিকতার প্রভাব আরো স্পষ্টত দৃষ্ট হয়। খুব ভালো ইংরেজি জানা সত্ত্বেও তিনি কোনো সভা-সমিতিতে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেন না। অথচ ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়া বা কথা বলাই ছিলো তখনকার উচ্চশিক্ষার পরিচয়। উপরন্তু নিজ পরিবারে ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে নিজ মাতৃভাষার উন্নতি ও প্রসারের জন্য গভীরভাবে চেষ্টা করে গেছেন।

 

পারিবারিক বলয়ে স্বদেশ

 

যে কারণে তিনি ইংরেজিতে চিঠি পর্যন্ত লিখতেন না। সকল বিষয়ের চর্চা মাতৃভাষায় সাধিত হোক-এইছিলো তাঁর জীবনের আকাঙ্ক্ষা। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনস্মৃতি পাতায় বলেছেন :

“বাহির হইতে দেখিলে আমাদের পরিবারে অনেক বিদেশীপ্রথার চলন ছিলো, কিন্তু আমাদের পরিবারের হৃদয়ের মধ্যে একটি স্বদেশাভিমান হির দীপ্তিতে জাগিতেছিল। স্বদেশের প্রতি পিতৃদেবের যে একটি আন্তরিক শ্রদ্ধা তাঁহার জীবনের সকলপ্রকার বিপ্লবের মধ্যেও অক্ষত ছিলো, তাহাই আমাদের পরিবারস্থ সকলের মধ্যে একটি প্রবল স্বদেশপ্রেম সঞ্চার করিয়া রাখিয়াছিল।

বস্তুত সে সময়টা স্বদেশপ্রেমের সময় নয়। তখন শিক্ষিত লোকে দেশের ভাষা এবং দেশের ভাব উভয়কেই দূরে ঠেকাইয়া রাখিয়াছিলেন। আমাদের বাড়িতে দাদারা চিরকাল মাতৃভাষার চর্চা করিয়া আসিয়াছেন। আমার পিতাকে তাহার কোনো নূতন আত্মীয় ইংরেজীতে পত্র লিখিয়াছিলেন, সে পত্র লেখকের নিকটে তখনই ফিরিয়া আসিয়াছিল।

রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পাহাড়ে থাকতেন তাই মায়ের মন প্রায়ই উচাটন থাকত। বাড়ির কর্তা বাইরে থাকলে যেকোনো শঙ্কা যেমন দ্বিগুণ মনে হয় তেমনি রবীন্দ্র মাতারও ছিলো ভয়ে কাতর মন। তাই রাশিয়ান বিপ্লবের আশঙ্কায় সহসা বালক রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে পাঠান। মায়ের উদ্বেগবাহী পিতার কাছে রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম চিঠি।

সেই চিঠির উত্তরে পিতা লিখেছিলেন, “ভয় করিবার কোনো কারণ নাই, রাসিয়ানকে তিনি স্বয়ং তাড়াইয়া দিবেন। এই প্রবল আশ্বাসবাণীতেও মাতার রাসিয়ানভীতি দূর হইল বলিয়া বোধ হইল না-কিন্তু পিতার সম্বন্ধে আমার সাহস খুব বাড়িয়া উঠিল।
পারিবারিক এমনি ভয় ভাঙ্গানিয়া আশ্বাসে ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভীষণ সাহসী যা তাঁর পরবর্তী সকল পদক্ষেপেই দেখতে পাই।

রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে আরো জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের পিতামহ বেলগাছিয়ার বাড়িতে প্রায়ই ইংরেজ রাজপরিবারের সদস্যদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। কিন্তু তিনি নিজেই পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে কোনো ইংরেজকে যেন বাড়িতে ডেকে না খাওয়ানো হয় তার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই ঠাকুর পরিবারের সাথে ইংরেজদের সংশ্রব প্রায় শেষ হয়ে যায়।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের রাজনীতিতে যোগদান খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও তাঁর অদম্য উৎসাহ ও উপদেশ তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মীদের অনুপ্রেরণা জোগায় এবং লক্ষ্য স্থিরতায় সহায়তা করে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে এইরূপ উদ্দীপনামূলক ও তেজস্বী প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।

বেদান্তধর্ম অনুসারী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪৫ সালে মিশনারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সংগঠিত হন এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় লেখেন, “সমাজ সংস্কারের আন্দোলনের একেবারে গোড়া হইতে দেবেন্দ্রনাথ তাহার সহিত যুক্ত ছিলেন। প্রথম আন্দোলন স্ত্রীশিক্ষার আন্দোলন, বিদ্যাসাগরীয় বিধবা বিবাহের আন্দোলন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা তাঁহার প্রধান পৃষ্ঠপোষাক।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

” ঠাকুর পরিবারে স্বাদেশিকতার বীজ বপন হয় রবীন্দ্র বাল্যেই। তারই ফলস্বরূপ ছেলেরা শুরু করে ‘হিন্দুমেলা’। মূলত ‘ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভঙ্গির সহিত উপলব্ধির বোধ সেই প্রথম হয়।

আরও দেখুন :

Leave a Comment