আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় পূজা পর্যায়ের গানে স্বদেশচেতনা
পূজা পর্যায়ের গানে স্বদেশচেতনা
পূজা পর্যায়ের গানে স্বদেশচেতনা
পূজা পর্যায়ের অনেক গানের মধ্যেই ব্রহ্মের পরিদর্শনের ভেতর দিয়ে কবি স্বদেশমাতাকে ইঙ্গিত করেছেন। স্বদেশ পর্যায়ের অনেক গানেই যেমন ঈশ্বর ও ঈশ্বর সৃষ্ট বহুবিধ উপমায় সাজিয়েছেন বা কখনো কখনো পূজা পর্বের গান মনে হয় তেমনি পূজা পর্বের কিছু গানেও স্বদেশ মাতৃরূপ দৃষ্ট হয়। এ বিষয়ে কিছু গানের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
“যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দী
সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে।
পূজা পর্বের এই গানটির মধ্যে স্বদেশের প্রতি আর্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এই ভূ-খণ্ড অপমানের গ্লানিতে ভরা, অত্যাচার আর নিপীড়নে সর্বহারা সকলে। সেখানে সেই অপমানের মাটিতে ঈশ্বরকে প্রণতি জানাতে রবীন্দ্রনাথের মন মানতে চায় না। মান-সম্মান-ঐশ্বর্যে এই জন্মভূমিকে পূর্ণ করতে কবি ঈশ্বরে প্রণতি জানাতে চান।
এই বিশ্ব-ভূষণ দীন দরিদ্র অবস্থার পরিবর্তন হবে তবেই সেদিন তাঁর প্রণতি যথার্থ রূপ পাবে। পূজা পর্বের এই গানটি ‘প্রণতি’ নামক কবিতার গীতরূপ। গীতাঞ্জলির ১০৭ সংখ্যক কবিতা এটি। রবীন্দ্রনাথ এটিকে রচনা করেন বোলপুরে ১৩১৭ সনে।
“আর নহে, আর নয়, আমি করি নে আর ভয়।
আমার ঘুচল কাঁদন, ফলল সাধন হল বাঁধন ক্ষয় ॥
অচলায়তন নাটকের পঞ্চকের গান এটি। অচলায়তন নাটক সম্পর্কে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে পরাধীনতার দেয়াল, অর্থহীন মন্ত্রের দাসত্ব মেনে না নেওয়া, পঞ্চকের প্রাচীর ভেঙে বাইরে বেরোবার আকাঙ্ক্ষা ও প্রচেষ্টার গল্প এটি। এ যেন ভারতবর্ষের অগণিত পরাধীন মানুষেরই বুকের হাহাকার। ভয়শূন্য চিত্তে রূপক চরিত্র পঞ্চক আকাশ ছুঁতে চায়। কোনো মায়াজন তাকে বাঁধতে পারে না।
তাই অস্ত্র নিয়ে, বর্ম পরে তৈরি পরাধীনতা ও কুসংস্কারের দেওয়াল ভাঙবে বলে, বিশ্বকে ছোঁবে বলে। অতুলনীয় এই গানটিতে পূজা ভাবনা থেকেও অধিক প্রতিফলিত হয় স্বদেশচেতনা। তাই এই গানটিকে স্বদেশভাবনার গান বলা যায়। গানটি ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয় এবং এর রূপকাল আনুমানিক ১৩১৮ এর আশ্বিনের মধ্যে।
“বাঁধা দিলে বাঁধবে লড়াই, মরতে হবে।
পথ জুড়ে কি করবি বড়াই, সরতে হবে।
অরূপরতন-এর অন্তর্গত গান এটি। শান্তিনিকেতনে বসে কবি এ গানটি রচনা করেন ১৯১৪ সালে জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে। পূজাপর্বের গানে যে ২১টি উপ-পর্যায় রয়েছে তার আত্মবোধনপর্বের গান এটি। মনের জোরে সব বাধাকে অতিক্রম করা যায়। যেকোনো প্রতিকূলতা অতিক্রম করবার জন্য লড়াই করে জিতবার আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। লজ্জা-সংকোচে কেঁদে বেড়ালে কখনো আত্মমুক্তির পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। লুট করা ধনের যে প্রাচুর্য তাও একদিন ধুলায় মিলাবে।
“এই কথাটা ধরে রাখিস মুক্তি তোর পেতেই হবে।
যে পথ গেছে পারের পানে সে পথে তোর যেতেই হবে। ১২২
অসাধারণ পূজাপর্বের এই গানটি রচিত হয়েছিল সুরুলে ১৯১৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। সাধনা ও সংকল্পের কথা বলা হয়েছে এই গানটিতে। আত্মবিশ্বাসে যেকোনো কঠিন পথেও পাড়ি জমালেও পারের কিনার ঠিকই মিলবে। অভয় মনে শুধু সম্মুখে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই পথের যত কাঁটা বাঁধা পদতলে দলে নিজের আরাধ্যে পৌঁছতে পারা যাবে।
এবং কবি এটাও বলেছেন, এ জীবন যাত্রা সহজ নয়, জীবনের লক্ষ্য জয়ও সহজ নয়। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত রয়েছে, তা অতিক্রম করবার শক্তি অন্তরে লালন করতে হবে তবেই মুক্তি আসবে।
“হবে জয়, হবে জয় হবে জয় রে
ওহে বীর, হে নির্ভয়
এই গানটি স্বদেশ ভাবাশ্রিত। কারণ বিবিধ উপ-পর্যায়ে এই গানে বীর ও নির্ভয়ের জয়গাঁথা গাওয়া হয়েছে। বীরের প্রাণের কখনো ক্ষয় হয় না। কবি আলোচ্য গানে সেই জয় প্রার্থনা করেন। প্রেম, ক্ষেমেরও জয় প্রার্থনা করেন কবি। কারণ সকল আঁধার একদিন আলোতে পরিণত হবে। সেই আলোকবর্ষী বীরের জয় জয়কার করেছেন কবি। সকল প্রকার পিছুটান চ্যুত করে আকাঙ্ক্ষার বাস্তবতা দিতে হবে। অরুণালোকে অভ্যুদয় নিশ্চিত করতে হবে। এটি ফাল্গুনী নাটকের বাউল চরিত্রের গান।
“আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে ॥
কবির ৬০ বছর বয়সে রচিত এই গানটিতে স্বদেশপর্বের ভাবাদর্শ পরিলক্ষিত হয়। এটি শান্তিনিকেতন থাকাকালীন সময়ের রচনা। ১৯২২ সালের ১৪ জানুয়ারি এর রচনা কাল। মুক্তধারা নাটকে ধনঞ্জয় চরিত্রের গান এটি। যদিও পূজা পর্যায়ের দুঃখ উপ-পর্যায়ের ইঙ্গিত করেছেন কবি। ‘বিষম ঝড়ের বায়’ বলতে কবি জীবনের নানা প্রতিকূলতাকে অসমতাকে, পরাধীনতাকে ইঙ্গিত করেছেন।
হয়তো নৌকার পাল ছেঁড়া হতে পারে তবুও মনের শক্তিতে বলীয়ান হলে ছেঁড়া পালেও হাওয়া লাগাতে পারা যায়। সেই হাওয়াই নৌকা ছুটে চলবে এর গন্তব্যে এবং এত ঘাত-প্রতিঘাতের মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে ঠিকই একদিন আশার ঘাটে পৌঁছাবে। সেদিন এই কঠিনসম ভার জীবনের অর্জন অর্ধস্বরূপ বিধাতার পায়ে তুলে দিতে বলেছেন কবি।
“জ্বল জ্বল চিতা, দ্বিগুণ দ্বিগুণ পরান সঁপিবে বিধবা বালা।
জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন, জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা
নাট্যগীতি পর্বের এই গানটিতে স্বদেশানুভূতি পরিলক্ষিত হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরোজিনী নাটকের জন্য মাত্র ১৪ বছর ৬ মাস বয়সে রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৫ সালের নভেম্বর মাসে গানটি রচনা করেছিলেন। এই গানটির মধ্যেও সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে নারীর যে অন্তর দহন ছিলো তা প্রতিভাত হয়েছে মূলত নান্দনিক ভঙ্গিতে নাটকীয় দৃশ্যপটের মাধ্যমে। নিম্নে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি থেকে উদ্ধৃতিটি তুলে ধরা হলো :
“রবীন্দ্রনাথ তখন বাড়ীতে রামসার পণ্ডিতের নিকট সংস্কৃত পড়িতেন। আমি ও রামসর্বস্ব দুইজনে রবির পড়ার ঘরে বসিয়াই, “সরোজিনী”র প্রুফ সংশোধন করিতাম। রামসার খুব জোরে জোরে পড়িতেন। পাশের ঘর হইতে রবি শুনিতেন, ও মাঝে মাঝে পণ্ডিতমহাশয়কে উদ্দেশ্য করিয়া, কোন্ স্থানে কি করিলে ভাল হয় সেই মতামত প্রকাশ করিতেন।
রাজপুত মহিলাদের চিতাপ্রবেশের যে একটা দৃশ্য আছে, তাহাতে পূর্ব্বে আমি গদ্যে একটা বক্তৃতা রচনা করিয়া দিয়াছিলাম। যখন এই স্থানটা পড়িয়া প্রুফ দেখা হইতেছিল, তখন রবীন্দ্রনাথ পাশের ঘরে পড়াশুনা বন্ধ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া বসিয়া শুনিতেছিলেন। গদ্য-রচনাটি এখানে একেবারেই খাপ খায় নাই বুঝিয়া, কিশোর রবি একেবারে আমাদের ঘরে আসিয়া হাজির।
তিনি বলিলেন—এখানে পদ্যরচনা ছাড়া কিছুতেই জোর বাঁধিতে পারে না। প্রস্তাবটা আমি উপেক্ষা করিতে পারিলাম না। কারণ, প্রথম হইতেই আমারও মনটা কেমন থুৎ খুঁৎ করিতেছিল। কিন্তু এখন আর সময় কৈ ? আমি সময়ভাবের আপত্তি উত্থাপন করিলে, রবীন্দ্রনাথ সেই বক্তৃতাটির পরিবর্ত্তে একটা গান রচনা করিয়া দিবার ভার লইলেন, এবং তখনই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই “জ্বল্ জ্বল্ চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ” এই গানটি রচনা করিয়া আনিয়া, আমাদিগকে চমৎকৃত করিয়া দিলেন।
নাটকের মঞ্চসফলতার মূল কেন্দ্রে থাকে এই গানটি। যদিও তখন অনেকেরই ধারণা গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা এবং এই গান সংক্রান্ত সকল প্রশংসা মূলত তিনিই পেয়েছিলেন। বিভিন্ন গ্রন্থেও এই গানটির রচয়িতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামই প্রকাশিত হয় এবং এই নাটক প্রকাশের প্রায় ৩৭ বছর পর নিজে জীবনস্মৃতিতে উল্লেখ করেন যে গানটি রবীন্দ্রনাথের রচনা।
সরোজিনী নাটকটি ১৮৭৬ সালের ১৫ জানুয়ারি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ব্যাপক আকারে প্রথম অভিনয় হয়। সরোজিনীর চরিত্রে যিনি অভিনয় করতেন তিনি প্রতিভাময়ী বিনোদিনী, তখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। বিনোদিনীর অভিনয় এবং এই গানটির আবেদনময় দৃশ্যটি দর্শকদের উন্মাদ করে দিত। এই গানটির বিপুল জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গে স্বয়ং অভিনেত্রী বিনোদনী তাঁর আমার কথায় উল্লেখ করেন :
“সরোজিনী” নাটকের একটি দৃশ্যে রাজপুত ললনারা গাইতে গাইতে চিতারোহণ করছেন। সে দৃশ্যটি যেন মানুষকে উন্মাদ করে দিত। তিন চার জায়গায় ধূ ধূ করে চিতা জ্বলছে, সে আগুনের শিখা দু’তিন হাত উঁচুতে উঠে লকলকে করছে। তখন ত বিদ্যুতের আলো ছিলো না, স্টেজের ওপর ৪/৫ ফুট লম্বা টিন পেতে তার ওপর সরু কার্ট জ্বেলে দেওয়া হত। লাল রঙের শাড়ী পরে কেউ বা ফুলের গয়নায় সেজে, কেউ বা ফুলের মালা হাতে নিয়ে এক এক দল রাজপুত রমণী, সেই-
‘জ্বল জ্বল্ চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ
পরান সঁপিবে বিধবা বালা।’
গাইতে গাইতে চিতা প্রদক্ষিণ করছে, আর ঝুপ করে সেই আগুনের মধ্যে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে পিচকারী করে সেই আগুনের মধ্যে কেরোসিন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর আগুন দাও দাও করে জ্বলে উঠছে তাতে কারু বা চুল পুড়ে যাচ্ছে, কারু বা কাপড় ধরে উঠছে- তবুও কারুর ভ্রূক্ষেপ নেই- তারা আবার ঘুরে আসছে, আবার সেই আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তখন যে কি রকমের একটা উত্তেজনা হত তা লিখে ঠিক বোঝাতে পারছি না।
উল্লেখ্য যে, এই গানটি রবীন্দ্রনাথের রচনা হলেও সুর সম্ভবত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কারণ পর্যালোচনায় দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ তখন সুর সংযোজন শুরু করেননি।
আরও দেখুন :