প্রচলিত শুষির বাদ্যযন্ত্র বাঁশি

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় প্রচলিত শুষির বাদ্যযন্ত্র বাঁশি

প্রচলিত শুষির বাদ্যযন্ত্র বাঁশি

 

প্রচলিত শুষির বাদ্যযন্ত্র বাঁশি

 

প্রচলিত শুষির বাদ্যযন্ত্র বাঁশি

শুষির যন্ত্রো মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে বাঁশি। ঋক্ বেদ এবং অথর্ব বেদ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের উচ্চাঙ্গ বা লঘু সংগীত – সবক্ষেত্রে একটি অতি প্রচলিত এবং জনপ্রিয় নাম বাঁশি। প্রাচীন গুহাচিত্রে বাঁশ থেকে তৈরি বাঁশির যে রূপ দেখা যায় আধুনিক কালে তা থেকে খুব বড় কোন পরিবর্তন ঘটে নি।

প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে বাঁশি সবচেয়ে প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। প্রাচীন যুগের মানুষ পাখির হাড়ে ফুঁ দিয়ে শব্দ উৎপন্ন করতো। এগুলো ছিলো প্রাচীন শুষির যন্ত্রের উদাহরণ। বাঁশ, নলখাগড়া ইত্যাদির ফাঁপা দেহের ভেতর দিয়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ মানুষকে বাঁশি তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করেছিলো। ১০৮ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রাচীন কাল থেকে এদেশের সাধারণ মানুষের বাঁশি বাজানোর অভ্যাসের কথা জানা যায়।

বিভিন্ন ধরণের লোক সংগীতে এবং পাহাড়ী অঞ্চলের গানে বাঁশি আবহমান কাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু রাগ সংগীতে এর ব্যবহার তেমন প্রচলিত ছিলো না। বাঁশির রাগসংগীতে অন্তর্ভুক্তি সাম্প্রতিককালের ঘটনা। এই প্রচলনের মূল কৃতিত্ব বিশিষ্ট বংশীবাদক পান্নালাল ঘোষের।

ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে সর্ব প্রথম বাঁশির সুস্পষ্ট এবং সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায়। এই বর্ণনা থেকে বাঁশির গঠন এবং বাজাবার কৌশল সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়। বর্তমান যুগে প্রচলিত বাঁশির সাথে এই বিবরণের তেমন তারতম্য নাই। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে অঙ্কিত অজন্তার গুহাচিত্রে বংশীবাদনরত দুই রমনীর চিত্র পাওয়া গেছে। এছাড়াও সাঁচী, ইলোরা প্রভৃতির গুহাচিত্রেও বাঁশী বাজানোর অনেক চিত্র পাওয়া গেছে।

১১০ বাঁশি যে প্রাচীন কাল থেকেই কত ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো তা এ সব চিত্র দেখলে বোঝা যায়। এ সব চিত্র দেখে বোঝা যায় বাঁশি কখনো বৃন্দ বাদনে ব্যবহৃত হতো, কখনো গানের সাথে বাজানো হতো, কখনো এককভাবে বাজানো হতো। তবে একথা ঠিক উচ্চাঙ্গ বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বাঁশির ব্যবহার প্রাচীন আমলে ছিলো না। এ কারণে ‘আইন-ই-আকবরী’তে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া গেলেও বাঁশির কথা কোথাও পাওয়া যায় না।

কারণ বাঁশী দরবারী বাদ্যযন্ত্র ছিলো না। সাধারণ মানুষের আনন্দ অনুষ্ঠান এবং পালা পার্বনে ছিলো বাঁশির ব্যবহার। অবশ্য সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ওস্তাদ মোহাম্মদ নামে এক শিল্পীর কথা জানা যায় যিনি খুব উঁচু দরের বংশীবাদক ছিলেন। সম্রাট তাঁকে তাঁর ওজনের সমান রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। ১১১ তবে এর পরও উচ্চাঙ্গ সংগীতে ব্যাপকভাবে বাঁশির চর্চার কথা শোনা যায় নি।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পান্নালাল ঘোষ (১৯১১-১১৫৯) বাঁশিকে উচ্চাঙ্গ সংগীতে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। পান্নালাল ঘোষ খুব ভাল বংশীবাদক ছিলেন এবং তাঁর সময়ে বাঁশির জনপ্রিয়তা নিয়েও কোন সংশয় নেই। আড় বাঁশি অর্থাৎ আড়াআড়িভাবে যে বাঁশি বাজাতে হয়, শব্দের দিক থেকে এটি শুনতে সাধারণ বাঁশি বা সরল বাঁশির চেয়ে বেশি ভাল ছিলো এবং লোক সংগীতে এর ব্যাপক ব্যবহার ছিলো।

বাঁশির দৈর্ঘ ছিলো প্রায় ত্রিশ সেন্টিমিটার এবং ব্যাস ছিলো দেড় থেকে দুই সেন্টিমিটার। বাঁশিতে ছিদ্র ছিলো ছয়টি। উল্লেখ্য বাঁশিতে ছয়টি ছিদ্র দিয়েই হাতের কৌশলে সব কয়টি স্বর উৎপন্ন করা হয়। পান্নালাল চেষ্টা করলেন এই বাঁশিতে কিভাবে উচ্চাঙ্গ সংগীত পরিবেশন করা যায়। কিন্তু গঠনগত কারণে বাঁশির আওয়াজে মিষ্টতার অভাব ছিলো। এছাড়া রাগদারী সংগীতের সূক্ষ্মতা প্রকাশ করা এতে সম্ভব ছিলো না।

পান্নালাল গবেষণা শুরু করলেন কিভাবে বাঁশিকে উচ্চাঙ্গ সংগীতের উপযোগী করে তোলা যায়। প্রথমে তিনি বাঁশ, কাঠ, প্লাস্টিক, স্টিল, পিতল সব ধরণের উপাদান দিয়ে বাঁশি তৈরি করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। কিন্তু কয়েক বছর গবেষণা করার পর অবশেষে তিনি কাঙ্খিত বাঁশি আবিষ্কার করতে সক্ষম হলেন। বাঁশিটি বাঁশের তৈরি। এ বাঁশিটি লম্বায় অনেক বড় এবং ব্যাসও বেশি প্রচলিত বাঁশির তুলনায়।

 

প্রচলিত শুষির বাদ্যযন্ত্র বাঁশি

 

বাঁশির দৈর্ঘ পঁচাত্তর সেন্টিমিটার এবং ব্যাস ২.৭ সেন্টিমিটার। এছাড়া পান্নালাল বাঁশিতে অতিরিক্ত একটি ছিদ্র সংযোজন করলেন। এতে করে খাদে অর্থাৎ মুদারা সপ্তকে তীব্র মধ্যম বাজানো সম্ভব হলো। বাঁশির সবগুলো ছিদ্রকে তিনি আরো বড় করলেন। ফলে আঙুলের চাপের কৌশলে বিভিন্ন রাগ পরিবেশনের সময় প্রয়োজনীয় শ্রুতি উৎপন্ন করা সম্ভবপর হলো। এছাড়া এই বাঁশির শব্দ অনেক গভীর খাদে নিখুঁতভাবে বাজানো যায়।

এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এতে সাধারণত দুই সপ্তক বা অরো বেশি অর্থাৎ আড়াই সপ্তক পর্যন্ত বাজানো যায়। এই বাঁশির সাহায্যে পান্নালাল ঘোষ উচ্চাঙ্গ সংগীতের জলসায় আলাপ, জোড়, গৎ, বোলতান এবং ঝালাসহ সম্পূর্ণ রাগদারী বাদন পরিবেশন করতে শুরু করলেন। উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরে একক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে এভাবে বাঁশি প্রতিষ্ঠা লাভ করল।

বাঁশের সরু নল কেটে বাঁশি তৈরি করা হয়। সাধারণ বাঁশি এক দেড় ফুট লম্বা বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়। উচ্চাঙ্গ সংগীতের জন্য বাঁশের দৈর্ঘ্য বেশি নিতে হয়, বাঁশের ব্যাসও বেশি থাকা দরকার। মাথার দিকে একটি গিঁট রেখে বাঁশ কাটা হয়, যাতে ওপরের দিকটা বন্ধ থাকে। বাঁশির অপর প্রান্ত খোলা থাকে। গিটের কাছে একটি গোল ছিদ্র করা হয়। এটিকে বলা হয় ফুৎকার বন্ধু।

এর নিচে পর পর ছয়টি গোল ছিদ্র করা হয়। এগুলোকে বলা হয় তাররন্ধ্র। ফুৎকার রন্ধ্রে মুখ রেখে আড়াআড়িভাবে বাঁশিটি ধরে অপর ছিদ্রগুলোতে দুই হাতের তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকা দিয়ে বায়ু নিয়ন্ত্রণ করে বাঁশি বাজানো হয়। আকার ও প্রকার ভেদে বাঁশির বিভিন্ন নাম আছে। যেমন, আড়বাঁশি, কদবাশি, টিপারা বাঁশি ইত্যাদি। এর মধ্যে আড়বাঁশি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। এর অপর নাম মুরলি অথবা মোহনবাঁশি।

আড়াআড়িভাবে ধরে এ বাঁশি বাজাতে হয়। দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের মধ্যভাগে টিপ দিয়ে ধরে বাম হাতের তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকা এই তিনটি আঙুল বাঁশির ওপর দিককার তিনটি ছিদ্রের মুখে এবং ডান হাতের ঐ তিনটি আঙুল নিচের তিনটি ছিদ্রের উপর রেখে প্রয়োজন মত আঙুলের চাপ নিয়ন্ত্রণ করে আড়বাঁশি বাজাতে হয়। কদবাশির মাথা তেরছাভাবে কেটে কাঠের পাতলা খিল আঁটা হয়।

খিল পুরোপুরি বন্ধ না রেখে ঈষৎ ছিদ্রপথ রাখা হয়। সেই ছিদ্রপথে ফুঁ দিলে এই বাঁশি বাজে। এর নিচে চারকোনা একটি উন্মুক্ত বায়ুরন্ধ থাকে। কদবাশির ওপরের অংশ দেখতে অনেকটা হুইসেলের মত। অঞ্চলভেদে কদবাশির বিভিন্ন নাম আছে।

যেমন, মুখের কাছে খিল থাকে বলে ফরিদপুরে একে ‘খিলবাশি’ বলা হয়, মুখের মধ্যে পুরে বাজাতে হয় বলে উত্তরবঙ্গে একে ‘মুখবাঁশি’ বলা হয়, ‘সরল বাঁশি’ নামেও এটি পরিচিত, আবার কলমের মত দেখতে বলে অনেকে একে ‘কলম বাঁশি’ বলে। ১১৩ তবে কলম বাঁশির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুর বলেছেন যে, এটি নাতিদীর্ঘ, সাতটি ছিদ্র থাকে এবং মাথার দিকে, যেখানে ফুঁ দিয়ে বাজানো হয়, সেখানে দেশী সানাইয়ের মত একটি তালপাতার রিড থাকে।

টিপারা বাঁশির উভয় মুখ খোলা এবং এতে আটটি ছিদ্র থাকে। কদবাশির মত মাথায় ফুঁ দিয়ে এটি বাজাতে হয়। তবে উভয় প্রাপ্ত খোলা থাকে বলে এর বাদনে বিশেষ কৌশল ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়।

 

প্রচলিত শুষির বাদ্যযন্ত্র বাঁশি

ছবি – বাঁশি

আরও দেখুন :

Leave a Comment