বিশ্বের সকল সাংস্কৃতিসেবী, শিল্পী, উদ্যোক্তা, পৃষ্ঠপোষককে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা !
আমাদের সাংস্কৃতিক উদ্যোগগুলোতে আপনার আগ্রহের কারণে আমার কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ধন্যবাদ।
আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে, ইমাম উল হিন্দ, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে জেলে বসে, তার প্রিয় বন্ধু মৌলানা হাবিবুর রহমান খান শেরওয়ানীর কাছে চিঠিতে লিখছেন:
“আপনাকে একটা কথা জানাই,
আমি বারবার আমার তনুমনের পরীক্ষা নিয়ে দেখেছি – জীবনে প্রয়োজনীয় সবকিছু ছেড়েও আমি সুখী থাকতে পারবো, কিন্তু সঙ্গীত ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারবো না।
“আওয়াজ-ই-খুশ” বা সঙ্গীত আমার জন্য জীবন যাপনের সহায়, সকল মানসিক সংগ্রামের আশ্রয়, শরীর ও হৃদয়ের সমস্ত রোগের নিরাময়।“
আপনারা জেনে থাকবেন এত বড় রাজনীতিবিদ, এত জ্ঞানী এবং প্রজ্ঞাবান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের একান্ত সঙ্গী ছিল সঙ্গীত। বিশেষকরে সেতার। তিনি ওই চিঠিতেই বর্ণনা করেছেন, তাজমহলে রাত্রিবেলা সেতার বাজানোর নৈসর্গিক অভিজ্ঞতার কথা।
আপনারা জানেন বঙ্গবন্ধুকে সারা জীবন কিভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কিভাবে তিনি “আমার সাধ না মিটিল …” গানটিতে পান্নালালের গলায় তার অনুভব খুঁজে পেয়েছেন। আমাদের শিল্পীরা তাকে সহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংগ্রামের প্রতিজন যোদ্ধাকে কিভাবে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। কিভাবে শিল্প-সংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাইফেল বন্দুকের সাথে পাল্লা দিয়েছে অস্ত্র হিসেবে।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনিষ্টাইনের একান্ত সঙ্গী ছিল তার বেহালা। শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে এরকম আরও কত শত ঘটনা রয়েছে ……
বিখ্যাত দার্শনিক, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে, পৃথিবীর সকল বড় মানুষের একান্তে গেলেই আমরা দেখি শিল্প-সংস্কৃতির অন্তত একটি শাখার সাথে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক।
আমি মনে করি শুধুমাত্র সঙ্গীত নয়, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিটি শাখা মানব সভ্যতার উত্তর উত্তর উৎকর্ষের পিছনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
শুধুমাত্র বড় মানুষই নয়, আমাদের মতো সাধারণ ক্ষুদ্র মানুষদের একান্তের আশ্রয়ও সেই একই জিনিস। তবে – যে মানুষ বা জিনিস আমাদের খুব কাছে থাকে, আমাদের সাথে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে থাকে, তার গুরুত্ব আমরা বেশিরভাগ সময় বুঝি না। Granted ধরে নেই। তাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবা বা আয়োজন করার বিশেষ তাগাদা অনুভব করি না। আমাদের এই ব্যস্ত-দৌড়-ছুটের জীবনে শিল্প-সংস্কৃতির অবস্থা তাই হয়ে গেছে। যা আছে তার কাছে আশ্রয় খুঁজি ঠিক। মনের মতো হচ্ছে না বলে অভিযোগও করি। কিন্তু মনের মতো করে নেবার উদ্যোগ আর নেয়া হয়ে ওঠে না।
কিন্তু সব সম্পর্ক যত্নের দরকার হয়। সব সাথীর প্রতি মনোযোগের দরকার হয়। শিল্প-সংস্কৃতিও তার বাইরে নয়। আজ তেমনই কিছু উদ্যোগের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে, আপনাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
প্রধান পৃষ্ঠপোষকের বানী
আমাদের আজকের সংস্কৃতি দাড়িয়ে আছে আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ভিত্তির উপরে। যেটা আমাদের পুর্বজননেরা আমাদের জন্য তৈরি করে গিয়েছেন।
সেই ভিত্তিতে সাহিত্যে আছে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, পদ্মাবতী, নসীহতনামা, নূরনামা, কারবালা সহ বহু নাম।
সঙ্গীতে আছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, আছে নানা রকম উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীত। আর লোকসঙ্গীতের সমুদ্র তো আছেই।
বিশেষ করে বিগত দুশো বছরে, আমাদের পুর্বজনরা, শিল্প-সংস্কৃতির ভিত্তির প্রতিটি স্তম্ভ, যথেষ্ট মাত্রায় পুষ্ট করে দিয়ে গেছেন।
তবে শিল্প-সংস্কৃতি এমন জিনিস নয়, যেটা একবারে চূড়ান্ত উন্নয়ন করে শেষ করে দেয়া যায়। সেরকম শেষ করলে বরং মৃত্যু ঘটে। তাকে প্রতিদিন চর্চা করে আরও শানিত করতে হয়, পরিশীলিত করতে হয়, সময়োপযোগী করতে হয়। তবেই সমসাময়িক ও আগামী সংস্কৃতি-সেবীদের ক্ষুধা মেটে। জীবন্ত সংস্কৃতিও এগিয়ে চলে।
এজন্যই আমাদের পুর্বজনদের রচিত ভিত্তির উপর দাড়িয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শুধুমাত্র বিনোদন নয়, এই প্রয়োজনটিকে আমাদের পিতৃঋণ / মাতৃঋণ বিবেচনা করতে হবে।
আমাদের আজকের আয়োজন সেরকম ১৪ টি উদ্যোগের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। পাশাপাশি আমরা জানাবো, এসব উদ্যোগ নিয়ে আমরা কি কি করতে চাই।
শান্ত্রীয় সঙ্গীত, লোকগান, রবীন্দ্রনাথের সকল সৃষ্টি, কাজী নজরুলের সকল সৃষ্টি, সেতার, বেহালা, বাঁশি, তবলা, নৃত্য, আবৃত্তি, অভিনয়, চলচ্চিত্র, ফাইন আর্ট নানাবিধ উদ্যোগ নিয়ে আমরা কাজ করছি। এই উদ্যোগগুলো গুছিয়ে প্রাথমিক ভাবে প্লাটফরম দিয়েছে গুরুকুল অনলাইন লার্নিং নেটওয়ার্ক।
প্রতিটি উদ্যোগের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ওই বিষয়টিতে সবার আগ্রহ তৈরি করা। ওই আর্ট ফর্মটি বুঝে রস নেবার কায়দা ধরিয়ে দেয়া। এরপর যারা আগ্রহ আরও আগাবে, তাকে আর্ট ফর্মটি শেখা বা চর্চা করার জন্য প্রাথমিক রসদ হিসেবে – ভিডিও টিউটোরিয়াল, গাইডলাইন সরবরাহ করা।
এই কাজগুলো করার জন্য তারা প্রতিটি বিষয়ে ইতিমধ্যে পাঁচশো এর বেশি ভিডিও টিউটোরিয়াল, অসংখ্য আর্টিকেল তৈরি করেছে। তৈরি করছে উক্ত বিষয়ে বিশেষায়িত তথ্য ভাণ্ডার। এগুলো আপনারা ইউটিউব, ফেসবুক এবং ওয়েবসাইটে পেয়ে যাবেন। প্রদর্শনের জন্য এখানে আমরা ব্যবস্থাও রেখেছি।
এখন এটাকে আরেকধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। আর দেশের এ ধরণের উদ্যোগকে এগিয়ে নিতেই কাজ করে আমাদের ইয়ুথ গ্লোবাল ফাউন্ডেশন।
আমরা ইয়ুথ গ্লোবালের পক্ষ থেকে, এই যাত্রাকে চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, আরও এগিয়ে নিতে একটি রূপরেখা তৈরি করেছি। তার দু একটি বিষয় আপনাদের অবগতির জন্য বলবো।
এসব প্লাটফর্মে যুক্ত হয়ে, প্রাথমিক শিক্ষাটা শেষ করে, যারা যথাযথ মেধা ও আগ্রহের পরিচয় দিতে পারবেন, তাদের মধ্য থেকে ১ জনকে, প্রতি বছর আমরা স্কলারশিপের আওতায় নিয়ে আসবো। অর্থাৎ মোট ১৪ স্কলারশিপ আমরা দেব। স্কলারশিপ হতে পারে দেশে-বিদেশে অধিকতর তালিমের জন্য, হতে পারে নিবেদিত হয়ে রেয়াজ করার জন্য। আবার ওই বিষয়ে গবেষণার জন্যও হতে পারে।
এর পাশাপাশি ওই খাতে বিশেষ অবদানের প্রতি বছর ১ জন শিল্পীকে সম্মান জানাতে চাই। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, গুনি মানুষদের সম্মান জানানোর মাধ্যমে আরও গুনি মানুষ তৈরিতে উৎসাহ যায়।
এছাড়া অনলাইনের পাশাপাশি, দেশে ও বিদেশের সাংস্কৃতিসবীদেরকে, আমাদের দেশি শিল্পীদের কাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
যাত্রাপথে অভিজ্ঞতার সাথে সাথে আমরা আরও নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করবে।
আমরা সবাইকে আহবান করবো, আসুন এই প্লাটফরমগুলোর পূর্ণ ব্যবহার করি। প্লাটফরমগুলো দেখুন, যোগ দিন। আপনার পরামর্শ ও গঠনমূলক সমালোচনা প্ল্যাটফর্মগুলোকে সাহায্য করবে।
আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিবেশী দেশ যদি আর্ট কালচারকে একটি বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রির রূপ দিতে পারে। লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত বানাতে পারে, তবে আমরাও পারবো। কারণ আমরা একই সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। একই জায়গা থেকে আমরা আলাদা হয়েছিলাম। তারা অনেক এগিয়ে গেছে। আমরা নানাবিধ কারণে ততটা আগাতে পারিনি।
তবে আগানোর অন্তরায় যেসব কারণ ছিল, তার বেশিরভাগ এখন শেষ হতে চলেছে। এখন সার্বিক পরিস্থিতি সংস্কৃতি চর্চার অনুকূলে। এই সময়টির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের সবার সন্তানকে সাংস্কৃতিমনা করে গড়ে তুলতে হবে। যারা শিল্প-সাংস্কৃতিকে পেশা বানাতে চান, তাদের পরিবেশনা আরও পরিশীলিত-আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। সেই সাথে সমাজের যারা সামর্থবান মানুষ আছেন, তাদেরকে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাশে দাঁড়াতে হবে।
শুভেচ্ছান্তে,
ড. সীমা হামিদ’
প্রধান পৃষ্ঠপোষক, শিল্প ও সংস্কৃতি গুরুকুল
সাভাপতি, ইয়ুথ গ্লোবাল ফাউন্ডেশন