বঙ্গভঙ্গকালে রচিত স্বদেশচেতনার গান

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বঙ্গভঙ্গকালে রচিত স্বদেশচেতনার গান

বঙ্গভঙ্গকালে রচিত স্বদেশচেতনার গান

 

বঙ্গভঙ্গকালে রচিত স্বদেশচেতনার গান

বঙ্গভঙ্গকালে রচিত স্বদেশচেতনার গান

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়কালকে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক জীবনের ক্রান্তিকাল বলা যেতে পারে। এ পর্বে মূলত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে ঘিরে তাঁর রচিত স্বদেশপর্বের গান ও এর তাৎপর্য নিয়ে আলোচনাই উদ্দেশ্য।

বঙ্গচ্ছেদ ঘোষণার সাথে সাথে সারা বাংলা জুড়ে প্রতিবাদের যে ঢেউ ওঠে তাতে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ সকলে ওই দিন অর্থাৎ ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ রাখি বন্ধন ও অরন্ধন ব্রত পালন করেন। রবীন্দ্রনাথ রচিত স্বদেশি গান তখন সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতা চেতনা ও আত্মোপলব্ধির দীক্ষায় উজ্জীবিত করে তার সাথে ছিলো বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিলো ৪৪ বছর। এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয় যে, এর আগে রচিত তাঁর প্রায় সকল স্বদেশ ভাবনার গানেই রাগাশ্রিত ও গম্ভীর তালের প্রয়োগ ছিলো। কিন্তু এ পর্বে এসে রবীন্দ্রনাথ বেছে নিলেন সাধারণের সহজ সরল সুর ও ছন্দ অর্থাৎ বাউল, কীর্তনের সুর। যাতে জনমন অনায়াসেই নিজেকে একাত্ম করতে পারে এসব গানের সাথে।

স্বদেশি গানের সুর বিশ্লেষণ নিয়ে আমরা অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করবো। এ পর্বে মূলত তাঁর যে সকল অসাধারণ স্বদেশি গণসংগীতের সুর দেশকে স্বদেশি আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিলো তার তালিকা ও ভাবার্থ নির্ভর সাংগীতিক চেতনার বিষয়টি আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য হবে। বঙ্গভঙ্গ সময়েই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ গৌরবী গানের বিশেষ তালিকাটি পাওয়া যায়।

পদ্মাতীরের বাউল ও কীর্তনীয়াদের মাটির সুরকেই তিনি গ্রহণ করলেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে। সহজ সরল বাণীর হৃদয়স্পর্শী সুর সকল বাঙালিকে এক করার মন্ত্রে আবদ্ধ করলেন কবি। স্বাদেশিকতা ও জাতির ব্রতচারণার চরণ কবি এ সময় রচনা করেন ২৫টি স্বদেশ ভাবনার গান। ৪৪ বছর বয়সের রচনা

“এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে,

‘জয় মা’ ব’লে ভাসা তরী

সারিগানের সরল ঢেউয়ের ছন্দে ও অপূর্ব বাণীর রূপক সমন্বয়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রাক্কালে রচিত এই গানটি সর্বকালের একটি সর্বজন গৃহীত গানে পরিণত হয়। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। তাই নদীকে দেশের সাথে তুলনা করে মাঝিকে আন্দোলনরত সকল সাধারণের মনে স্থাপিত করেছেন কবি। সেই ১৯০৫ সালের উত্তাল সময়ের রচিত গান আজো তেমনি আন্দোলিত করে; উদ্বেলিত করে দেশমাতৃকার প্রেমে।

এ গানের সুর ও ছন্দে তৎকালে আন্দোলনরত স্বদেশবাসীর বিমোহিত হবার কথা ব্যক্ত করেন কবি। প্রবীণ অধ্যাপক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মন্তব্যে ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, গানটি শুনে তরী ভাসাইব কি; গঙ্গাগর্ভে ঝাপাইয়া পড়িতে অনেকেই প্রবৃত্তি হইয়াছে। এ বিষয়ে ব্রাহ্মসমাজের পণ্ডিত সীতারাম তত্ত্বভূষণের কন্যা শান্তিময়ী দত্তের স্মৃতিচারণ উল্লেখ করা হলো-

“… রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখি ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে।.. ব্রাহ্মবালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরূপে গানের ক্লাশে গান শিখি-হঠাৎ একদিন ডাক এল রাস্তার অপরদিকের স্যার জগদীশ বসুর বাড়ি থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সদ্য লেখা স্বরচিত স্বদেশী গান শোনাবেন সেখানে। বিদ্যালয়ের গান-জানা মেয়েরা তাঁর মুখ থেকে শুনে গানগুলি শিখে নেবে।….. অর্গানে বসেছেন সি আর দাশের ভগ্নী অমলা দাশ।

কবি এসে পকেট থেকে ছোট নোটবই খুলে গাইলেন, যদি তোর ডাক শুনে…’ এবং ‘এবার তোর মরা গাঙে…. প্রথমে তিনি একবার গাইলেন খালি গলায়। তারপর অমলা দাশের বাজনার সঙ্গে। দরাজ, উচ্চ কণ্ঠস্বর কিন্তু একটু মেয়েলি ধরনের। তাঁর সেই সুউচ্চ মিষ্ট কন্ঠস্বরে ঘরখানা যেন গমগম করে ভরে গেল।… আমরা মেয়েরা গান শিখব কী গায়কের চোখ-ধাঁধানো রূপে অতুলনীয় গানের মাধুর্যে যেন সম্মোহিত হয়ে চেয়ে রইলাম।

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।

একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে

একই সময়ে রচিত অতুলনীয় বাউল সুরের গান এটি। পরপর এ দুটি গানই মূলত অন্য গানের আশ্রয়ে রচিত। লোক সুরের মুগ্ধতায় রবীন্দ্রনাথ এ সময়ে এই সুরকেই নিবেদনের একমাত্র অর্ঘ্য করে তুলেছেন। খুব সহজ বাণীর ও বাউল সুরের এ গান স্বদেশচেতনা উদ্দীপনার এক অতুলনীয় নিবন্ধনে পরিণত হয়। প্রতিটি স্তবকে একই সুর অথচ বাণীর অপরিহার্য যোজনায় সর্বকালের উদ্দীপনামূলক গানে পরিণত হয় এটি।

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে” গানটি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের ছাত্রদেরও শিখিয়েছেন। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র কামাখ্যানাথ রায় লিখেছেন, ‘প্রাক্-কুটিরের পুবদিকের উত্তর কোণে একটি জাপানি অরগ্যান ছিলো। সন্ধ্যায় গুরুদের এটি বাজিয়ে আমাদের শেখাতেন। “একলা চলো রে…. ছাত্রদের কণ্ঠে তুলে দেবার জন্য গানটি তিনি অনেকবার গেয়েছেন, এবং অনেকদিন ধরে।… (গায়ক রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে উদ্ধৃত)

“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি

তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!”

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে রচিত অসাধারণ এই গানটিতে লৌকিক ও বিভাস রাগ মিশ্রিত সুরের দুলনীতে। দেশমাতার সোনার মন্দিরের দুয়ার খোলার গল্প বলেছেন কবি। গানে দেবী দুর্গার শক্তির সাথে দেশমাতার শক্তির এবং দুর্গামাতার রূপের সাথে রূপক অর্থে স্বদেশমাতার প্রকৃতির রূপের বর্ণনা করেছেন।

শুধু অন্তরশক্তি বা বাহ্যিকরূপেই পরিপূর্ণ নয় এ দেশমাতা। এর রয়েছে দারিদ্র্যতাপূর্ণ ক্ষুধাতুর সন্তান। তবে দেশমাতার নয়ন ভোলানো রূপ আর এর কোমল পরশে সকল দৈন্যতা শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব হয়।

“মা কি তুই পরের দ্বারে পাঠাবি তোর ঘরের ছেলে ?

তারা যে করে হেলা, মারে ঢেলা, ভিক্ষাঝুলি দেখতে পেলে

“তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে, তা বলে ভাবনা করা চলবে না ।

ও তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে, হয়তো রে ফল ফলবে না ॥

 

বঙ্গভঙ্গকালে রচিত স্বদেশচেতনার গান

 

অপূর্ব সুন্দর আশার কথা ব্যক্ত করেছেন কবি এই গানটিতে। বড় কোনো অর্জন সহজে আসে না, তার জন্য যেমন ত্যাগের প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন অপেক্ষার। সহজ ও সত্য উপলব্ধির বাণী এবং বাউল সুরের সমন্বয়ে একটি অতুলনীয় উদ্দীপনার গান এটি। হয়তো বারবার কোটার ফলেও বিফলতা আসবে। তাই বলে থেমে গেলে চলবে না। নতুন উদ্দীপনায় আবারও প্রস্তুতি নিয়ে এগুতে হবে। কারণ অন্ধকারের পরেই আলো আসে।

“ছি ছি, চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি।

এবার কঠিন হয়ে থাক্ না ওরে, বক্ষোদুয়ার আঁটি-

জোরে বক্ষোদুয়ার আটি ৬

স্বদেশপর্বের প্রতিটি গানে কোনো না কোনো দিকনিদের্শনার ইঙ্গিত করেছেন কবি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে রচিত হলেও এ সকল গান এতোকাল পরেও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে যেকোনো দুর্যোগ ও দেশ-সমাজের বিপর্যয়ে আমাদের উঠে দাঁড়াবার শক্তি জোগায়। কবি চোখের জলে মাটিকে জরাজীর্ণ না করে নিজেকে শক্ত হতে বলেছেন। কারণ নিজের দুর্বলতা কেবলই অন্যের পরিহাসের বস্তু।

কবি এ লজ্জা থেকে নিজেকে, নিজের দেশকে মুক্ত করতে বলেছেন। নিজের ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে শোকের আহাজারি কেবল সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়। কবি মুক্তি লাভের জন্যে সব ভুলে কৃতকর্মে ঝাপিয়ে পড়তে আহ্বান করেছেন।

“যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ক,

আমি তোমায় ছাড়ব না মা!

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে রচিত এই গানটিকে যেভাবে মাতৃরূপ দর্শন হয় তাতে স্বদেশ মাতৃকার প্রতি অপরূপ এক অনুভূতির উদ্রেক হয়। ব্যক্তিজীবনের আকাঙ্ক্ষায় পৃথিবীর যে প্রান্তেই ঘুরে ফিরি না কেন গ্রাম্য দরিদ্র মায়ের আদরের গন্ধমাখা ছেঁড়া কাঁথার তুলনা কিছুতে হয় না।

এই দেশমাতা যেন চির শাশ্বত মাতৃরূপ এবং গানটির শেষাংশে কবি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যেন এই প্রাণপ্রিয় দেশমাতাকে রক্ষা করতে পারেন। কোনো শক্তির কাছেই যেন পরাজিত হয়ে না যান। উল্লেখ্য, এই গানটির স্বরলিপি করেন ইন্দিরা দেবী।

“যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু

আজকে তোরে কেমন ভেবে অঙ্গে যে তোর ধুলো দেবে

কাল সে প্রাতে মালা হাতে আসবে রে তোর পিছু পিছু

স্বদেশ পর্যায়ের অন্তর্গত এই গানটিরও স্বরলিপি করেন ইন্দিরা দেবী। অপূর্ব এক প্রাণশক্তি রয়েছে গানটির অন্তরালে। স্বদেশমাতার কথা কোথাও উল্লেখ না করেও কী উপায়ে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন আনা সম্ভব, সে বিষয়ে দৃঢ়তার বাণী ব্যক্ত করেছেন কবি। দিন বদলায় তবে বদলের দায় নিজেদের। কারো কটাক্ষে পিছপা হলে চলবে না বরং চুপচাপ সামনে এগুতে হবে। এই গানের প্রতিপাদ্য বিষয় মূলত তাই-ই ইঙ্গিত করে ।

“ওরে, তোরা নেই বা কথা বললি,

দাঁড়িয়ে হাটের মধ্যিখানে নেই জাগালি পল্লী

বাউল সুরের অপূর্ব দ্যোতনায় আক্ষেপের বাণীও মধুর। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্বে ৪৪ বছর বয়সকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রতিটি গানেই দেশ সম্বন্ধীয় নানাবিধ ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে যা কখনও আশা জাগানিয়া, কখনো উদ্বেগের আবার কখনো উদ্দীপনার ভাবসমৃদ্ধ।

তেমনি এই গানটিতে একপ্রকার চাপা অভিমানের আভাস স্পষ্ট। যদি দেশমাতার এহেন দুর্দশায় কেউ চুপ থাকে, যদি কেউ বাইরে বেরিয়ে না আসে, নিজ কাজকে দেশের কাজের থেকেও বৃহৎ বিবেচনা করে তবে কবি তাদের অগ্রাহ্য করেন।

“যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা-না। তবে তুই ফিরে যা-না।

যদি তোর ভয় থাকে তোর করি মানা

দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভয় নিয়ে কোনো বৃহৎ কাজ সম্ভব নয়। তাই কবি স্বদেশব্রতের কাজে যাদের পিছুটান রয়েছে তাদেরকে এ পথে না আসারই পরামর্শ দিয়েছেন অতি সহজ সুরে ও বাণীর সম্মিলনে। এ গান যেন প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধের ইঙ্গিতবাহী বক্তব্য। মনের মধ্যে শঙ্কা থাকলে সেই কাজের পরিণতি শুভ হয় না। বরং একজনের ভয় অন্যের মনে দ্বিধার সঞ্চার করতে পারে।

নিজ থেকে শক্তি অনুভব না করলে, প্রাণ দানের উচ্ছ্বাস-সুখ উপলব্ধি না করতে পারলে বৃথা কালক্ষেপন ছাড়া আর কিছুই হবে না। তাই কবি মহৎ কাজে আত্মনিবেদনে দ্বিধা থাকলে তাদের ফিরে যেতে বলেছেন এই গানটিতে।

“ও আমার দেশের মাটি তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।

তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্বের গানে আরেকটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তা হলো আন্তর্জাতিকতা। তাঁর অনেক স্বদেশভাবনার গানেই স্বদেশচেতনা মিশেছে বিশ্বচেতনার সাথে। দেশকে ভালোবেসেছিলেন বলে তিনি বিশ্বকে আপন করতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর প্রতিটি গান সর্বকালের ভৌগোলিক সীমারেখা পেরিয়ে পৃথিবীর সব দেশের সব সময়ের।

স্বদেশ বিশ্বেরই একটি অংশ, বিশ্বমাতার এক খণ্ড রূপ। তাই তিনি স্বভূমিকে প্রণতি জানিয়েছিলেন বিশ্বজননীর পাতা আঁচলের আশ্রয়ে রেখে। অন্যদিকে তিনি বিশ্বমাতাকে প্রণাম জানিয়েছেন দেশমাতাকে প্রণতি নিবেদনের মধ্যদিয়ে। এ প্রসঙ্গে অমল মুখোপাধ্যায়ের অভিমত স্মরণ করা যায়: সন্তানের শিরায় শিরায় প্রবাহিত। রক্ত ধারায় থাকে মায়ের নাড়ীর টান, মাতৃসত্ত্বার সপ্রাণ অনুভব তাঁর শরীর জুড়ে।

দেশমাতাও তেমনি মিশে আছেন কবির সমগ্র সত্ত্বায় প্রাণে মনে। বঙ্গমাতার শ্যামল-কোমল মূর্তি কবির নয়নে, কবির অন্তরে চির জাগ্রত। এ মাটিকে কবি সর্বং সহা মাতৃরূপে তুলনা করেছেন। সকল মায়ের যে ‘মা’ সেই তো স্বদেশ। কোটি সন্তানের অনাচার কদাচারের ভার বহন করে চলেছে এই মাটি অথচ কোনো প্রতিবাদের প্রত্যাশা নেই চিরায়ত মায়েরই মতন।

কবি স্বদেশের এই মাটির প্রতি ঋণী। কিন্তু কবি শঙ্কিত-লজ্জিত যে, শক্তিদাতা ও জীবনদাতার সকল দানই বুঝি বৃথা যায়। কবির একমাত্র প্রার্থনা এই মাটিতে যে মায়ের কোলে জন্ম লাভ করেছেন যেন সেই মাটিতেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাই বারংবার এই মাটিকে নানা উপমায় তিনি প্রণতি জানিয়ে গেছেন।

“ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে, মোদের ততই বাঁধন টুটবে,

ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আখি ফুটবে, ততই মোদের আঁখি ফুটবে ॥

গিরিডি থেকে ট্রেনে যাত্রা পথে গানটি রচনা করেন কবি। ঐক্যের শক্তি যখনই মজবুত হবে শত্রু তখনই দুর্বল হবে। বন্দিদশা থেকে উত্তরণের একমাত্র পন্থা অন্তরের ডাকে সাড়া দিয়ে আত্মশক্তির উপলব্ধি । এই সকল গান বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে সেই কাজটিই করেছে সঙ্গোপনে। রাখীবন্ধনের দিন যে জনস্রোত ‘ভাই ভাই’ রবে সকলে পথে নেমেছিল, তাদের উদ্দীপ্ত করেছিল এই সকল গান।

কেবল স্বপ্ন দেখে নষ্ট করবার সময় আর নেই, পথে নেমে কাজ করতে হবে। বাউলের সুরে এমন আকুল করা জাগরণের বাণী এর পূর্বে কোনো কবিকে বলতে শোনা যায়নি। সহজ ও সত্য কথায় সেদিন যে বিশ্বাস মনে বপন করেছিল সকল বাঙালির চিত্তে তা আজো অম্লান। এ যেন চিরদিনের গান। শত্রু বার বার হানা দিবে আঙ্গিনায় এবং এমনিভাবে রবীন্দ্রবাণী আমাদের প্রাণিত করবে, শক্তি দেবে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণায়।

“এখন আর দেরি নয়, ধর্ গো তোরা হাতে হাতে ধর্ গো।

আজ আপন পথে ফিরতে হবে সামনে মিলন-স্বর্গ

শোনা যায় দুর্গা পূজার সময়ে ১৯০৫-এর অক্টোবর থেকে নভেম্বরের কোনো এক দিন গানটি রচিত হয়। পরবর্তীকালে শৈলজারঞ্জন মজুমদার স্বরলিপি তৈরী করেন। বঙ্গভঙ্গকালীন উত্তাল সময়কে কেন্দ্র করে স্বাদেশিকতা ও জাতীয় ব্রতচারণায় কবি যে ২৫টি গান রচনা করেন তার ২০টি গানই ‘বাউল’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও গীত সংকলনেও এই সকল বাউল ও রাখীসংগীতগুলো বারবার প্রকাশিত হয়।

উল্লেখ যে, ১৯০৮ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকার কর্তৃক সংকলিত গান গ্রন্থে পূর্বের ২০টি বাউল গান এবং ১৬টি জাতীয় সংগীত নামে নির্বাচিত স্বদেশি গান মুদ্রিত হয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্বের এই ২৫টি গানে রয়েছে সরল সহজিয়া লোকসুর ও সহজ কথার মিশেল। সহজ সুর- ছন্দ সহযোগেই কেবল জনসাধারণের মর্মমূলে আঘাত করে স্বদেশের প্রতি লুকায়িত প্রেমানুভূতি জাগরণের কাজটি সহজ করে তোলা সম্ভব।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

এই বাউল ও রাখীসংগীতগুলোতে বাউল, কীর্তন ও লোকসুরের প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশপ্রীতির যে জোয়ার এনেছিলেন তা পরবর্তীকালে সময়ে রচিত স্বদেশ গানেও পরিলক্ষিত হয়। সুরপ্রয়োগ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে স্বদেশসংগীতের সুর পর্যালোচনা বিষয়ক অংশে।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্বের আগে অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ৪৩তম বছর বয়স পর্যন্ত ২৩/২৪টি স্বদেশসংগীত পাওয়া যায়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালীন সময়ে অর্থাৎ তাঁর ৪৪ বছর বয়সেই তিনি রচনা করেন ২৫টি গান। যার প্রতিটি গানই কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হলেও তা সর্বকালীন প্রভাব বিস্তার করে, দেশ-জাতি-কালকে অতিক্রম করে।

আরও দেখুন :

Leave a Comment