বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনপর্বে অতুলপ্রসাদ সেন

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনপর্বে অতুলপ্রসাদ সেন

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনপর্বে অতুলপ্রসাদ সেন

 

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনপর্বে অতুলপ্রসাদ সেন

 

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনপর্বে অতুলপ্রসাদ সেন

মহাপূর্ণ মিছিল সেদিন কলকাতার পথে। সমগ্র বাংলার অভিজাত, উচ্চশিক্ষিত, মধ্যবিত্ত আর বুদ্ধিজীবীরা সেদিন প্রতিবাদে মুখর। সময়টি ১৯০৫, বঙ্গব্যবচ্ছেদ কাল। বহুবিধ বাকবিতঞ্জার বেড়াজাল তোয়াক্কা না করে ইংরেজ সরকার অবিভক্ত বাংলায় বিরাজমান হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যে ছেদ আনবার লক্ষ্যে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা দেয়।

সাদা চোখেই এই চক্রান্ত বাঙালি বুঝতে পারে বলে বাংলার ঐক্যশক্তিকে দুর্বল করবার এই দুষ্ট অভিপ্রায়কে কেউ সমর্থন করতে পারলো না। বরং সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য আলাদা ভু-খণ্ডের প্রলোভন সম্প্রদায়ভিত্তিক দাঙ্গার উদ্দেশ্যেই মূলত এই বঙ্গচ্ছেদের ঘোষণা দেয় ইংরেজ সরকার। কিন্তু তাদের চক্রান্ত আশীর্বাদে পরিণত হলো।

এর পূর্বে কখনো বাঙালি এভাবে সমস্বরে কণ্ঠ মেলায়নি। বাংলাদেশ যেন তার সকল সন্তানকে এক বাহুতে আগলে রাখতে জেগে উঠল। এত বাধা ও আন্দোলনের পরেও বঙ্গচ্ছেদ অবশেষে হলোই। ১৯০৫ সালে অতুলপ্রসাদ সেন লক্ষ্ণৌর অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। তিনি সকল কাজের সম্মুখ ভাগে থাকেন। তিনি দুঃখী মানুষের ত্রাণকর্তা ও অনুরাগী বন্ধু। বিপদে-আপদে লক্ষ্মৌবাসীর একান্তের স্বজন তিনি।

বঙ্গভঙ্গের ঘটনায় তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠল। ১৯০৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় বেনারসে। তাঁর বাসভবন তখন গণ্যমান্য শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীতে ভরপুর। গোবরনাথ মিশ্র, মমতাজ হোসেন, গঙ্গাপ্রসাদ ভার্মা, বিশ্বেশ্বরনাথ শ্রীবাস্তবসহ এমনি অনেকে। বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই মূলত ১৯০৫ সালে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।

কারণ কংগ্রেসের অভ্যর্থনা সমিতির জন্য লক্ষ্ণৌ থেকে আগত যেসকল নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। শুধু তাই নয়, যোগ্য ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁকে সমিতির পরিচালনার দায়িত্বভারও দেওয়া হয়েছিল। ইতোমধ্যে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। সমগ্র বঙ্গভূমি এক শোকাতুর ভূখণ্ডে পরিণত হলো। অতুলপ্রসাদ সেনও সেই আঘাতে বেদনার্ত, বিক্ষিপ্ত। তিনি বাঙালির এই দুর্দিনে চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না।

তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন গণআন্দোলনে। তিনি মানুষকে সচেতন করবার প্রয়াসে দূর-দূরান্তে ছুটে চললেন। এই ষড়যন্ত্র থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতেই হবে নতুবা সব শেষ হয়ে যাবে। সেই প্রত্যাশা নিয়ে তিনি সরাসরি আন্দোলনে যোগ দিতে লক্ষ্মৌ থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে ছুটে চললেন। দিনটি ১৬ অক্টোবর ১৯০৫।

হাওড়া স্টেশন থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা করতেই কানে এলো তার চিরচেনা একটি সুর। থমকে দাঁড়িয়ে তিনি শুনলেন সমবেত কণ্ঠে নিজের সৃষ্টি

“দেখ মা, এবার দুয়ার খুলে

গলে গলে এনু মা তোর

হিন্দু-মুসলমান দুই ছেলে।

 

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনপর্বে অতুলপ্রসাদ সেন

 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এই আন্দোলনরত জনস্রোতে নিজের গান হঠাৎ শুনে স্তম্ভিত হলেন অতুলপ্রসাদ। সেই অভিজ্ঞতাটি তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরা হলো,

“তখন স্বদেশী আন্দোলন খুব চলিতেছে, আমি কলিকাতায় যাইব বলিয়া রওনা হইয়া হাওড়া স্টেশনে নামিয়া দেখি অনেক ছেলে মিলিয়া আমার একখানি স্বদেশী গান সমবেত কণ্ঠে গাহিতে গাহিতে চলিছে।

আমি অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনিলাম এবং ভাবিলাম আমার গান এতো সমাদৃত হইয়াছে! তখন কাছে একটি ছেলেকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম এ গানটি কার ভাই, তোমরা যা গাইছ!’ ছেলেটি আশ্চর্য হইয়া বলিল, কেন, এ তো অতুলপ্রসাদ সেনের গান।’ আমি আর কি বলিব, একটু হেসে নিজ গন্তব্যস্থানে চলিয়া গেলাম।

পুলকিত মনে গৌরব অনুভবে অতুলপ্রসাদ সেন সেই গানের সাথে গঙ্গার ধারে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে দেশপ্রেমিক শত শত লোক গান গাইতে গাইতে গঙ্গাস্নান করতে যাচ্ছেন। নিজেদের বঙ্গভঙ্গের পাপ থেকে, অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং গঙ্গা স্নান শেষ করে খালি পায়ে মাথা নিচু করে শোভাযাত্রার সম্মুখপ্রান্তে ছুটে চলেছেন

তারই উদ্দেশ্যে সমগ্র বাংলায় অরন্ধন ঘোষিত হয়েছে এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই রাখি পরিয়ে কলঙ্কমুক্ত হতে ব্রত সকলে। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য! সকলের কানে রবীন্দ্রনাথের রাখী বন্ধনের গান,

“বাংলার মাটি বাংলার জল

বাংলার বায়ু বাংলার ফল পূর্ণ হোক।

(সুর: বাউল, স্বদেশ-২০)

মহাপুণ্য এই মিছিলে সকলের মুখে মাতৃবন্দনার গান ‘যদি ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’। এমন দৃশ্যে অতুলপ্রসাদ আত্মপ্রণত হলেন দেশপ্রেমী সকলের চরণে। মহামতি গোখলের সভাপতিত্বে বেনারসে কংগ্রেসের অধিবেশনের আলোচ্য বিষয় ‘বঙ্গভঙ্গ’।

সারাদেশে বিরাজমান এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী পরিস্থিতি সত্ত্বেও সভায় কোনো ‘বঙ্গভঙ্গ’ বিষয়ে কোনো প্রতিরোধ আন্দোলনের কর্মসূচি গোখলে কর্তৃক ঘোষিত না হলে অতুলপ্রসাদ অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত হলেন। কংগ্রেসের নব্য সদস্য হিসেবে অতুলপ্রসাদ নিরুপায় কিন্তু ক্রোধে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ বিষয়ে এমন নিরুত্তাপ অধিবেশনকে মেনে নিতে পারলেন না। প্রতিবাদস্বরূপ অধিবেশন চলাকালে বেদনাসিক্ত হৃদয়ে গাইলেন,

“আপন কাজে অচল হলে

চলবে না চলবে না।

অলস স্তুতি-গানে তাঁর আসন

টলবে না রে টলবে না ”

অধিবেশনে উপস্থিত সকলের টনক নড়লো অতুলপ্রসাদের এই গানে। বঙ্গভঙ্গের প্রতিরোধ পন্থার জন্য কৃতকর্মের সংশোধনের উপায় খুঁজতে লাগলেন। কর্মসূচি গ্রহণ করতেই হবে প্রত্যয়ে সকলেই সম্মত হলেন। গোখলে স্বয়ং অতুলপ্রসাদকে আশ্বাস দিলেন এবং উদার কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন,

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

” The tremendous upheaval of popular feeling which has taken place in Bengal in consequance of the partition will constitute a landmark in the history of our national progress. For the first time since British rule began all sections of the community, without distinction of caste or creed, have been moved by a common inpulse and without the stimulous of external pressure to act together in offering resistance to a common wrong.”

আরও দেখুন :

Leave a Comment