Site icon Arts and Culture Gurukul [ শিল্প ও সংস্কৃতি গুরুকুল ] GOLN

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তথা জাতীয় চেতনায় রজনীকান্ত সেনের ভূমিকা

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তথা জাতীয় চেতনায় রজনীকান্ত সেনের ভূমিকা

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তথা জাতীয় চেতনায় রজনীকান্ত সেনের ভূমিকা

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তথা জাতীয় চেতনায় রজনীকান্ত সেনের ভূমিকা

 

 

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তথা জাতীয় চেতনায় রজনীকান্ত সেনের ভূমিকা

বাংলাদেশকে দ্বিধাবিভক্ত করা হবে বাঙালির চিত্তে এই বিষয়টি প্রচণ্ড ব্যাঘাত করে। বহুকাল যে মায়ের সন্তানেরা একই ভাষা, একই সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছে। একই আকাশের নিচে শস্য-শ্যামলা জন্মভূমির একই বাতাসে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে, সেই সন্তানদের এবং তাদের মা’কে দ্বিখণ্ডিত করা হবে এমন বাক্যে দিশেহারা সকল বাঙালি প্রাণ। গভীর বিষাদের ছায়া ফেলেছিল সকল বাঙালি চিত্তে।

বঙ্গমায়ের সকল সন্তান মায়ের সুখে-দুঃখে সকল আবেগ ভাগাভাগি করে নিয়েছে, একজন আরেক জনের কাঁধকে অবলম্বন করেছে, তাদের বঙ্গমাতাকেই দ্বিখন্ডিত করবার যে অভিপ্রায়ের কথা ব্যক্ত করেছে সরকার, তাতে বড্ড চঞ্চল হয়ে ওঠে পেশা-শ্রেণি নির্বিশেষে সকল বাঙালিপ্রাণ। রাজ আদেশের প্রতি সমগ্র বাঙালি জাতি প্রতিবাদের ঝড় তোলে। সময়টা ১৯০৫ সাল।

লর্ড কার্জন বৃহৎ জনগোষ্ঠী বঙ্গবাসীর তথা ভারতবাসীর ভাগ্য বিধাতা। ১৮৬৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা ভাষায় কোনো স্বদেশপ্রেমের গান রচিত হয়নি। ১৮৭৬ সালে হিন্দুমেলা স্থাপিত হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় সেসময় হিন্দুমেলার উদ্দেশ্যে রচিত হয় ‘জাতীয় সংগীত’ নামে একটি গ্রন্থ। “যে সংগীত জীবন ও চরিত্রের সার্থক ও মৌলিক পরিচয়ের বাহক, তাকেই বলে জাতীয় সংগীত।

জাতির স্বরূপ ও স্বধর্মের মান নির্ণয়ের অব্যর্থ সূত্রই জাতীয় সংগীত। এই সংগীতের চরিত্রই জাতীয় চরিত্রের নির্দেশক।… দেশপ্রেম বা স্বাজাত্যবোধ দেশমাত্রেরই এক ও অভিন্ন নয়। এই বোধের বিষণ্ণতাই বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংগীতের চরিত্র বিষমতার উৎস। … জাতীয়ভাব যতখানি বিশিষ্ট দেশ বা জাতিগত, ততখানি আন্তর্জাতিক নয়, যতখানি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ততখানি নৈর্ব্যাক্তিক যতখানি নয়; যুগ বা প্রয়োজন-ভিত্তিক, ততখানি সর্বকালীন ও প্রয়োজন-সীমাতিক্রমী নয়।

অর্থাৎ দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশের জন্য স্বজাতিকে সঙ্গবদ্ধ করবার উদাত্ত আহ্বানের ডাক তারা বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণার বহুকাল আগে থেকেই চর্চা করে আসছিলেন। বাঙালির চিত্তে, স্বদেশ ভাবনার এই বীজকে অঙ্কুরে নাশ করবার প্রয়াস ছিলো বঙ্গকে বিভাগ করবার পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য। অন্তরালে যতই শুভভাবনার উদ্দেশ্য থাকুক না কেন বঙ্গবাসীকে, বঙ্গমাতাকে শাসকশ্রেণি কর্তৃক দ্বিখণ্ডিত করা ছিলো বাঙালি ভাগ্যের অভিশাপ সমান।

এটি ছিলো মূলত ভাবপ্রবণ বাঙালির অন্তরাত্মাকে দ্বিখণ্ডিত করবার সমান। তাদের আত্মমর্যাদা, আত্মঅভিমানকে দুর্বল করবার এক সুদূর প্রয়াসী ষড়যন্ত্র। বাঙালিরা বহু আলোচনা ও আন্দোলন করে বঙ্গভঙ্গ রহিত করবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন। গভর্নমেন্টের কাছে লিখিত আবেদন দিলেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই আগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা দাঁড়ালেন না।

বরং বাঙালির এই প্রতিবাদকে গভর্নমেন্ট বিরুদ্ধাচারণ মনে করলেন এবং যথাবিহিত ১৯০৫ সালে ১৬ অক্টোবর বঙ্গদেশকে দুইভাগে বিভক্ত করা হলো। ঐ দিনটি আজ ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন হয়ে আছে। সমগ্র বাঙালির আশাভঙ্গের ঐ কুঠারাঘাত বাঙালি জাতি কখনও ভুলতে পারেনি, পারবে না। অথচ শাসক ইংরেজ জাতি তা কর্ণপাত করলো না। বাঙালির ভাবাবেগকে তাদের কার্যবিধির অন্তরায় বলে মনে করলেন।

“কর্মী ইংরাজ ভাব অপেক্ষা কর্মের শ্রেষ্ঠতাই চিরদিন স্বীকার করেন, ভাবের উৎপত্তি যে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে, প্রাণের স্পন্দন যে ভাবের ভিতর দিয়াই প্রকাশ পায়, তাহা সহজে তাঁহাদের ধারণায় আসে না। তাঁহারা মনে করিলেন, শাসনকার্য্যকে সুকর করিবার জন্য তাঁহারা যে সঙ্কল্প করিয়াছেন, বাঙ্গালী মাত্র ভাবের আতিশয্যে তাহাতে বাধা দিয়া দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির পথে অন্তরায় হইতেছে।

তাই রাজপুরুষেরা বাঙ্গালীর এই ভাবাধিক্যের মূলে কুঠারাঘাত করিবার জন্য ১৩১২ সালে ৩০এ আশ্বিন (১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর) বঙ্গদেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করিলেন। পূর্ব্বে প্রেসিডেন্সী, বৰ্দ্ধমান, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজসাহী, এই পাঁচটি বিভাগ লইয়া বঙ্গদেশ গঠিত ছিলো।

বঙ্গদেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করিবার পর, প্রেসিডেন্সী ও বর্দ্ধমান, এই দুই বিভাগ লইয়া পশ্চিমবঙ্গ এবং ঢাকা, রাজসাহী ও চট্টগ্রাম, -এই তিন বিভাগ লইয়া পূৰ্ব্ববঙ্গ গঠিত হইল। বিহার প্রদেশ পশ্চিম বঙ্গের সহিত সংযুক্ত হইল এবং আসাম প্রদেশকে পূর্ব্ববঙ্গের সহিত সংযুক্ত করা হইল। দুই বঙ্গের জন্য স্বতন্ত্র দুইজন শাসনকর্তা নিযুক্ত হইলেন এবং রাজ্য- শাসনেরও স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত হইল। ”

বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা থেকে দেশজুড়ে যে আন্দোলন বিপ্লব শুরু হয় তাতে সকল শ্রেণির সকল ধর্মের মানুষ একাত্ম হয়ে পথে নামে। বিষাদের কালো ছায়ায় ঢেকে যায় সাধারণ মানুষের মন। বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ’ ঘোষণার প্রায় ২ মাস আগে ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে যে সভা হয় সেখানে বিদেশি পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

সেই সভাতেই সকল বাঙালি প্রতীক্ষা করেন বিদেশি পণ্য বর্জনের। যতদিন না বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়, ততদিন আমরা বিদেশী দ্রব্য ব্যবহার ত দূরের কথা, স্পর্শও করিব না। কবি রজনীকান্ত সেনের মনও সমগ্র জাতির ন্যায় বিপ্লবী ভাবাবেগে চঞ্চল হয়ে উঠলো। কোনো বুদ্ধি বিবেকমান মানুষের পক্ষেই ‘বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ’ ঘটনায় ঘরে বসে থাকা সম্ভবপর ছিলো না। কিন্তু পথে নামলেই সব অর্জিত হয় না, তারজন্য প্রয়োজন আত্মিক সমন্বয়।

সেই মনোগত জগতের সংস্কার ও বিকাশের নিভৃত দায়িত্ব নিলেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও রজনীকান্তসহ অগণিত গীতিকবিগণ । ডুবে যাওয়া সূর্যের উদয় ঘটাতে প্রয়োজন কঠিন সংযম ও সুযোগ্য নেতৃত্বের। বঙ্গজননীর সন্তানের এক করবার মনোভাবনায় দৃঢ় প্রত্যয়ের। আর এই সকল বাণী সম্বলিত স্বদেশ রচনার মন্ত্র তা পাই তৎকালীন কবিদের লেখনির যাদুস্পর্শে।

যার যার অবস্থান থেকে যে যেভাবে সম্ভব বঙ্গচ্ছেদের অভিশাপ থেকে দেশমাতাকে মুক্ত করবার প্রতি গ্রহণ করেন। হলুদ সুতোর বন্ধনে সমগ্র দেশবাসীকে বাঁধতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গচ্ছেদের দিন তিনি পথে নেমে এলেন। রবীন্দ্রনাথ সকলের সাথে গঙ্গাস্নান সেরে খালি পায়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের হাতে রাখি পরিয়ে বাঙালি সকল ভাই এক ও অবিচ্ছেদ তাই প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলেন।

সেদিন কোনো বাঙালির ঘরে রান্না হয়নি। দেশমাতার এ-হেন দুঃখে সকলে দিশেহারা। উদাত্ত কণ্ঠে সকলে সমন্বরে গেয়ে বেড়ালেন স্বদেশ বন্দনার গান-

“বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল

পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান।

এই গানটির মধ্যদিয়ে স্বদেশাভিমান এক অন্য মাত্রার রূপ পায়। বিদেশি পণ্য বর্জনের যে সিদ্ধান্ত স্পষ্ট সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছিল কলকাতার টাউন হলের সভায় তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশীয় শিল্প ও স্বদেশজাত পণ্য ব্যবহারে বাধভাঙ্গা আকুলতা দেখা যায়।কিন্তু সকল বাঙালির পক্ষে এ কার্য সহজসাধ্য ছিলো না। বোম্বাই-আমেদাবাদের মানুষের জন্য মোটা কাপড় বয়নের ব্যবস্থা নেওয়া হলো।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যাস মিহিসুতোর কাপড়ে অভ্যন্ত বাঙালির পক্ষে এ কার্য ততোটা সহজ ছিলো না। দেশীয় পণ্য মোটা কাপড় সাদরে গ্রহণ করবার দ্বিধা দেখা দেয় অনেকের মনে। এমনকি এ মোটা কাপড়কে গ্রহণে অনেক বাঙালির মনে তাচ্ছিল্যের অভিপ্রায় দেখা যায়। তাই বিদেশি পণ্য বর্জনের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে স্বাদেশিকদের অনেক কঠিন সময়ের মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে।

এই স্বদেশি আন্দোলনকে স্থায়ী করবার জন্য বহু দেশপ্রেমীকে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হয়েছে। রজনীকান্ত সেন তাদের অন্যতম। ‘মোটা কাপড়’ যখন বিলাসী বাঙালির কাছে বিরাগের কারণ হয়ে উঠল, দেশীয় কাপড়ের বয়ন করা মোটা কাপড়ের শুভাগমনকে অনেকেই আনন্দের সাথে গ্রহণ করতে পারছিলেন না।

ঠিক তখনই রজনীকান্ত সেনের সহজ সরল সুরে স্বদেশমাতার মোটা কাপড়ের জয়গান সকলের মনে গভীর অনুভূতির সঞ্চার করে। রাজশাহীর পল্লীকবি এ গানে বাঙালিকে পবিত্র সংকল্পে ব্রতী করেন –

“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই

দীন-দুখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।

এই গানটির মধ্যদিয়ে সর্বস্তরে ছড়িয়ে থাকা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটালেন কবি। বাঙালির অনেক দিনের ঘুম ভাঙল। অলস এবং আত্মবিস্মৃত বাঙালি যারা জানতো না স্বদেশমাতৃকার গৌরবের মাহাত্ম্যে তাদের জাগিয়ে তুললেন কবি। এ গানটির মধ্যদিয়ে রজনীকান্ত সেনের নাম সর্বস্তরে পৌঁছে গেল। ‘মোটা কাপড়ের’ কবি রজনীকান্ত পৌঁছে গেলেন সকলের ঘরে ঘরে। এ গান হয়ে উঠলো সকলের প্রাণের গান।

রজনীকান্ত সেন খালি গায়ে কাঁধে হারমোনিয়াম নিয়ে মোহগ্রস্ত বাঙালিকে জাগাতে পথে পথে গেয়ে বেড়িয়েছেন এ গানটি । প্রথমে দুই একজন সাথে থাকলেও দেখতে দেখতে শত শত ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধ- বৃদ্ধা বা বুদ্ধিজীবী সবাই এই গানের সুরে কণ্ঠ মেলাতে মেলাতে পথে নেমে আসেন, ঐ মোটা সুতোর সঙ্গে মায়ের অপার স্নেহ দেখতে পাই / আমরা এমনি পাষাণ তাই ফেলে ঐ মায়ের দোরে ভিক্ষা চাই।’

এমনই সুশীল বাণীতে রজনীকান্তের চোখের জলে স্নাত হোন সকলে। জন-জোয়ার এই গানের সুরে রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ গানের বেলাতে। গানের যে কত শক্তি ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড়’ গানটি তেমনি একটি উদাহরণ। স্কুলের ছাত্রদের হাতে এ গানটির ছাপা কপি তুলে দিলে ছাত্র-ছাত্রীরা এ গানটি গেয়ে গেয়ে পদযাত্রা করতো রজনীকান্তকে ঘিরে।

এ দৃশ্যে রজনীকান্তের চোখ-মুখ আনন্দাশ্রুতে ভরে উঠত। এ প্রসঙ্গে কবি তাঁর রোজনামচায় ১৩১৭ সালের ১৮ই বৈশাখ তারিখে উল্লেখ করেন,

“স্কুলের ছেলেরা আমাকে বড় ভালবাসে। আমি মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়ের কবি ব’লে তারা আমাকে ভালবাসে।’ পুনরায় ২১-এ বৈশাখ তারিখে শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বক্সী মহাশয়কে তিনি লিখিয়াছেন, ‘আমার মনে পড়ে, যে দিন মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গান লিখে দিলাম, আর এই কলিকাতার ছেলেরা আমাকে আগে করে procession (শোভাযাত্রা) বের ক’রে এই গান গাইতে গাইতে গেল, সে দিনের কথা মনে হইলে আমার আজও চক্ষে জল আসে। এ গানটি সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছেন,

“কান্তকবির ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ নামক প্রাণপূর্ণ গানটি স্বদেশী সঙ্গীত-সাহিত্যের ভালে পবিত্র তিলকের ন্যায় চিরদিন বিরাজ করিবে। বঙ্গের এক প্রাপ্ত হইতে আর এক প্রাপ্ত পর্যন্ত এই গান গীত হইয়াছে। ইহা সফল গান। যে সকল গান ক্ষুদ্র-প্রাণ প্রজাপতির ন্যায় কিয়ৎকাল ফুল- বাগানে প্রাতঃসূর্য্যের মৃদুকিরণ উপভোগ করিয়া মধ্যাহ্নে পঞ্চভূতে বিলীন হইয়া যায়, ইহা সে শ্রেণীর অন্তর্গত নহে।

যে গান দৈববাণীর ন্যায় আদেশ করে এবং ভবিষ্যদ্বাণীর মত সফল হয়, ইহা সেই শ্রেণীর গান। ইহাতে মিনতির অশ্রু আছে, নিয়তির বিধান আছে। সে অশ্রু পুরুষের অশ্রু- বিলাসিনীর নহে। সে আদেশ যাহার কর্ণগোচর হইয়াছে, তাহাকেই পাগল হইতে হইয়াছে।

স্বদেশীযুগের বাঙ্গালা সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আমার দেশ’ ভিন্ন আর কোন গান ব্যাপ্তি, সৌভাগ্য ও সফলতার এমন চরিতার্থ হয় নাই, তাহা আমরা মুক্তকণ্ঠে নির্দ্দেশ করি। স্বদেশীর সূচনাকালে লোকান্তরিত পশুপতিনাথবাবুর বাড়ীতে যে দিন এই গান প্রথম শুনিলাম -সেই দিন মুহূর্ত্তে এই অগ্নিময়ী বাণীর আদেশ শিরোধার্য্য করিয়াছিলাম।

রজনীকান্ত সেন মূলত এই একটি গানের মধ্যদিয়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলাকালে বাঙালির মনে তিনি আপন আসন করে নিয়েছিলেন। কান্তকবি যেহেতু নিভৃতচারী ছিলেন, নেতৃত্বের মোহে তিনি আন্দোলনের সম্মুখপ্রান্ত থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছিলেন; যেমনটা দেখেছি রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মধ্যেও। স্বদেশের দুর্দশায় বিচলিতপ্রাণ সারাজীবন দূর থেকে কেঁদে ফিরেছেন, মর্মভেদী অবরুদ্ধ অশ্রু বর্ষণ করেছেন গান ও সুরের বাণীর ভিতর দিয়ে।

 

 

স্বদেশি আন্দোলনের বহু আগে থেকে এবং বঙ্গভঙ্গ পর্ব ও এর পরবর্তী সময়েও স্বদেশবন্দনার বহু গান রচনা করেছেন তিনি। কখনও হাসির গানের মধ্যদিয়ে তুলে ধরেছেন সমাজের বহুবিধ বৈষম্যের চিত্র এবং হঠকারিতার বিচিত্র রূপ। আবার কখনো ঈশ্বর বন্দনায় দেখেছেন স্বদেশমাতৃকা তথা ভারতমাতার করুণ চিত্র। তবে এসকল রচনার কোনোটিতে ছিলো না সুউচ্চ উন্মাদনার ছায়া বরং পরম মায়ায়, করুণাভরা অনুনয়ের সুরে আচ্ছাদিত তাঁর স্বদেশ বন্দনার গান।

আরও দেখুন :

Exit mobile version