আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বঙ্গভঙ্গ পরবর্তীকালে রচিত স্বদেশি গান। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে স্বদেশি গান রচনার বিপুল উত্তেজনার পর রবীন্দ্রনাথ অনেকটা দমে যান। সংকীর্ণ মানসিকতা ও রাজনৈতিক দলাদলি তাঁকে আহত করে। দুর্বলকে ব্যবহার করে সবলের স্বার্থসিদ্ধির ইঙ্গিত যখন তিনি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আন্দাজ করতে পারলেন তখন নিঃশব্দে ক্ষুণ্ণ মন নিয়ে সরে এলেন সে প্রাঙ্গণ থেকে।
বঙ্গভঙ্গ পরবর্তীকালে রচিত স্বদেশি গান
সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও নেপথ্যে থেকে দেশ ও জাতির কল্যাণের স্বার্থে স্বদেশসাধনা ও ভাবনার সাথে জড়িত থাকলেন। কিন্তু দেশাত্মবোধক বা স্বদেশপর্বের গান রচনার মনোভূমি প্রায় শুকিয়ে যায়। তাই বঙ্গভঙ্গ পরবর্তীকালে অর্থাৎ তাঁর ৪৮ বছর বয়স থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি মাত্র ১৫/১৬টি স্বদেশপর্বের গান রচনা করেন।
বিভিন্ন উৎসবের প্রয়োজনে নাটক বা অন্যকোনো উপলক্ষ্যে গানগুলো রচিত হলেও এদের মূল্যও অনেক। কবির বয়সের কালানুক্রমিক হিসেব অনুযায়ী পরিণত জীবন পর্যন্ত রচিত স্বদেশপর্বের গান নিয়ে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
“রইল বলে রাখলে কারে, হুকুম তোমার ফলবে কবে ?
তোমার টানাটানি টিকবে না ভাই, রবার যেটা সেটাই রবে ॥””
অসাধারণ বাউল সুরের এই গানটি রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ সময়ের প্রায় ৩ বছর পর রচনা করেন। এই মধ্যবর্তীকালীন সময়ে তিনি কোনো স্বদেশপর্বের গান রচনা করেননি। এই গানটি তিনি রচনা করেন ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকের ধনঞ্জয়ের চরিত্রের জন্য। উপলক্ষ্য যেটাই হোক না কেন জীবন সত্য উপলব্ধির একটি যথার্থ গান এটি। পরবর্তীকালে স্বদেশপর্বের গান হিসেবে সংযুক্ত করা হয়। ‘গান’, ‘মুক্তধারা’, “পরিত্রাণ’ প্রভৃতি গ্রন্থে এর সংকলন করা হয়।
“হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
“বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্ব থেকে যে সহজ সরল সুর ও বাণীর আশ্রয়ে রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করেছিলেন এই গানটি তার ব্যতিক্রমী উদাহরণ। কবি বোলপুরে বসে ১৩১৭ সনের ১৮ আষাঢ় গানটি রচনা করেন। ভারততীর্থ কবিতার গীতরূপ এই গানটি। এতে সর্বমানবের মিলনতীর্থ হিসেবে ভারতভূমির বন্দনা করা হয়েছে। অপূর্ব এই গানটি সুরের চলনে ও বাণীর সমন্বয়ে ভারতমাতার পুণ্যভূমির একটি প্রতিমন্ত্র যেন।
আর্য-অনার্য, হিন্দু-মুসলমান, ইংরেজ- খ্রীষ্টান, ব্রাহ্মণ পতিত সকলকে এই পুণ্যতীর্থে আহ্বান করেছেন কবি। সকলের স্পর্শেই এই পুণ্যভূমি স্বার্থক হবে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচেতনা, বিশ্বচেতনা ও উদার ধর্মচেতনাবোধ—এই গানটিতে একাকার হয়ে গেছে। এটি গীতাঞ্জলির ১০৬ সংখ্যক কবিতা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে এই কবিতাটি বারংবার প্রকাশিত হয়। মূল কবিতার প্রথম, দ্বিতীয় ও শেষ স্তবক সুরারোপ করে গানে ব্যবহৃত হয়েছে।
“জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা।
এ গানটি ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করেছে। ভারতমাতার প্রাকৃতিক দানের এর সকল ঐশ্বর্যের কথা বর্ণিত হয়েছে এই গানটিতে। গাওয়া হয়েছে ভারতমাতার জয় জয়কার ধ্বনি যেখানে রয়েছে ভারতবর্ষের সকল জনগণের ঐক্যের কথা, শান্তির কথা, জয়ের কথা। অথচ অসাধারণ স্বদেশমাতৃভক্তির এ গানটিও সমালোচনার শিকার হয়। বিতর্ক ওঠে এ গানটি নিয়ে।
গানটি নিয়ে নিন্দুকের ভ্রান্ত ধারণায় অহেতুক সমালোচনা করে কবিকে ব্যথিত করেন। কলকাতায় ১৯১১ সালে এই গানটি রচিত হয় মূলত ২৭তম কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য জাতীয় নেতাদের অনুরোধে। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির দরবারে বঙ্গচ্ছেদ রদ ঘোষিত হয়। বিহার, উড়িষ্যায় নতুন প্রদেশ গঠনসহ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করার কথা ঘোষণা করা হয়।
এরপর বড়দিন উৎসব উপলক্ষ্যে পঞ্চম জর্জ কলকাতা আসেন। সেই সময়ই কংগ্রেসের ২৭তম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন কলকাতাতেই। আশুতোষ চৌধুরী প্রমুখ নেতাদের অনুরোধে অধিবেশন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ভারতমাতার বন্দনাস্বরূপ এই ‘জনগণমন’ গানটি রচনা করেন এবং ২৮ ডিসেম্বর কংগ্রেস অধিবেশনের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে গানটি প্রথম গাওয়া হয়। কিন্তু অনেকেই একটি ভুল ও অসত্য বিষয় অনুমান করেছে।
প্রচার করা হয় যে রবীন্দ্রনাথ এই গানটি সম্রাটের রাজ্যাভিষেকের প্রস্তুতির জন্য রচনা করেন। ব্যথিত কবি এ বিষয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হন এবং চিঠিপত্র লেখেন। এ বিষয়ে ১৯৩৯ সালে সুধাময়ী দেবীকে কবি লেখেন, ‘শাশ্বত মানব ইতিহাসের যুগ যুগ ধারিত পথিকদের চির সারথী বলে আমি চতুর্থ বা পঞ্চম জর্জের স্তব করতে পারি, এ রকম অপরিমিত মূঢ়তা আমার সম্বন্ধে যাঁরা সন্দেহ করতে পারেন, তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আত্ম-অবমাননা’।
এর ১৬ বছর পরে ১৯৩৬ সালের ২৮ অক্টোবর এই ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটির মাহাত্ম্য অনুধাবন করে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি একে স্বাধীন ভারতের জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি দেন।
দেশ দেশ নন্দিত করি মন্ত্রিত তব ভেরী
আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরি।
জীবনের প্রতি মুহূর্তের রচনায় রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি আত্ম-শক্তি উন্মোচনের সাথে বিধাতাকে সকল শক্তির আধার হিসেবে পাশে রাখতে। স্বদেশিযুগের মতো ১৯১৫ সালে ভারতবর্ষ আইন পাশ হলে অরাজকতা শুরু হয়, তাতে বিনা বিচারে কেবল সন্দেহের বশে যুবকদের বন্দী করে রাখা হয়। কথিত আছে কেবল বাংলাদেশের ১২০০ যুবককে এ আইন বলে জেলে পাঠানো হয়েছিল।
আন্দোলন চালানোর উদ্দেশ্যে স্কুল-কলেজের ছাত্রদের সম্পৃক্তের আহ্বান করা হলে প্রাদেশিক সরকার সরকারি বিদ্যায়তনের ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করাকে অপরাধ বলে ঘোষণা করেন। তাই সমগ্র ভারত জুড়ে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনের ব্যবস্থা হলো। তাতেও প্রাদেশিক সরকার বাধ সাধলেন। রবীন্দ্রজীবনী-২ এ উল্লেখ আছে যে, অ্যানি বেসান্ট মাদ্রাজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় খোলেন।
তখন মাদ্রাজ সরকার তাঁকে এবং তাঁর দুই সহকর্মীকে অন্তরীণ করেন। এতে আন্দোলন আরো ভয়াবহ রূপ পায়। রবীন্দ্রনাথ তিন মাস পর আমেরিকা থেকে ফিরে এই পরিস্থিতি দেখে প্রতিবাদ শুরু করেন। বেঙ্গলি পত্রিকায় খোলা চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানালেন। ১৯১৭ সালের ৪ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম প্রবন্ধটি পাঠ করেন রামমোহন লাইব্রেরি হলে এবং প্রবন্ধের অনুবাদ হিসেবেই রচিত হয় উত্তেজনা ও উদ্দীপনার এই গানটি-
“দেশ দেশ নন্দিত করি মন্ত্রিত তব ভেরী।
এ বিষয়ে অমল হোম তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন :
“১৯১৭ সাল। দেশ জুড়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রবল হয়ে উঠছে। অ্যানি বেসান্টের নেতৃত্বে Home Rule for India আন্দোলনে ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত আলোড়িত। মিসেস বেসান্টকে বৃটিশ গভর্নমেন্ট করলেন ইন্টার্ন। টাউনহলে প্রতিবাদসভার আয়োজন চলেছে-গভর্নর রোনাল্ডসে জানালেন যে, মিটিং করা চলবে না।
সুরেন্দ্রনাথ চিত্তরঞ্জন, এঁরা সব ডেপুটেশনে গেলেন লাটসাহেবের কাছে। অনেক কাকুতি মিনতির পর মিলল মিটিংয়ের অনুমতি। ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ এলেন কলকাতা, সঙ্গে নিয়ে তাঁর সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ভাষণ ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। একদিন পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয় এলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি কবিকে অনুরোধ জানালেন, দেশের এই নবজাগরণের উদ্দীপনা উপলক্ষ্যের দিন তিনি যেন একটি গান বেঁধে দিন।
পরের দিনই রচিত হলো সেই বিখ্যাত গান ‘দেশ দেশ নন্দিত করি…। গানটি প্রথম গাওয়া হয় রামমোহন লাইব্রেরিতে এই প্রবন্ধ পাঠের দিন। দ্য ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেটের সেপ্টেম্বর ১৯৪১-এ প্রকাশিত Tagore Memorial Special Supplement-এ লেখা হয় … Composed at the request of Pandit Malaviya, his famous National song Desha Desha Nandita Kari Mandrita Taba Veri, which is sung for the first time at the meeting at Rammohan Library…
“মাতৃমন্দির-পুণ্য-অঙ্গন কর’ মহোজ্জ্বল আজ হে
বর-পুত্রসঙ্খ বিরাজ’ হে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু ও আত্মীয় আশুতোষ চৌধুরী ও নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের অনুরোধে গাইকোয়াড়ের কলকাতা আগমন উপলক্ষ্যে ১৯০৪ সালে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের জন্য গানটি রচনা করেন। তবে অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন না। পূর্বেও এই গানটি সম্পর্কে অন্য আলোচনা হয়েছে যে এই গানটি ভেঙে রবীন্দ্রনাথ পরে বেশ কয়েকটি গান রচনা করেছেন।
একই গান ভেঙে অন্য উৎসব বা উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে আরেকটি গান রচনার উদাহরণে এই গানটি অনন্য। যেহেতু পূর্বেও এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে বিধায় সমীর সেনগুপ্তের গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থ (পৃষ্ঠা-৯৬) থেকে ছকটি তুলে দেওয়া হলো-
সারনি : অনুষ্ঠানভেদে রূপান্তরিত গান
উৎস : গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ, সমীর সেনগুপ্তের বই থেকে গৃহীত।
“সাধন কি মোর আসন নেবে হট্টগোলের কাঁধে?
খাঁটি জিনিস হয় রে মাটি নেশার পরমাদে। ১০
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্বের গানসমূহে যে কেবল স্বদেশ মাতৃকার স্তুতি, বন্দনা, উদ্দীপনা বা আত্মশক্তির কথা বলা হয়েছে তা নয়। এমন কিছু গান রয়েছে যেখানে জীবনের নিগূঢ় সত্য উদ্ভাসিত। বৈষয়িক জাগতিক কাজ, লোভ-লালসার মধ্যে কোনো সাধনা কর্ম সম্ভব নয়। জীবনের কোনো প্রাপ্তিই হঠাৎ হয়। না। দীর্ঘদিনের তপস্যায় কেবল তা বাস্তবে রূপ পায়।
ত্বরিত পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় যে সবকিছু ম্লান হতে পারে, চরম অসম্মান প্রাপ্ত হতে পারে—জীবনের এ রূঢ় সত্যটিই প্রতিফলিত হয়েছে এই গানটিতে। দেশমাতৃকাকে মুক্ত করবার প্রয়াসও একটি চরম সাধনা। এই সাধনাকে বাস্তব করতে অনেক ত্যাগ- তিতিক্ষা ও নিষ্ঠার প্রয়োজন। বহুজনের বহুদিনের তপস্যায় একটি ভূ-খণ্ডকে মুক্ত করবার মতো সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
১৯২২ সালে কবি শান্তিনিকেতনে বসে অসহযোগ আন্দোলনের সময় এ গানটি রচনা করেন। উল্লেখ্য যে, এই গানটির কোনো স্বরলিপি পাওয়া যায়নি।
“সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান,
সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ। ১১০
এই গানটি গাওয়া বা শ্রবণমাত্র মনের মধ্যে এক ধরনের বোধ জাগ্রত হয়। ভয়শূন্য মনে সম্মুখে এগুবার ভরসা মেলে গানটিতে। এক সুন্দর গল্প রয়েছে এই গানটি রচনার পিছনে। রবীন্দ্রনাথ সর্বদা ব্যতিক্রমকে বরণ করেছেন, নারীমুক্তি তথা মানবমুক্তির পথ উন্মোচন করতে চেয়েছেন।
বিশ্বের যে স্থানেই গেছেন ভারত- বর্ষের মানুষ কী করে নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার উন্নতি করতে পারে তার উপায় সংগ্রহ করেছেন প্রাণভরে এবং নিজ মাটিতে তা প্রয়োগ করবার চেষ্টা করেছেন। গানটি রচিত। হয়েছিল ১৯২৯ সালের ১৬-১৯ ডিসেম্বরের কোনো একদিন। সমগ্র দেশকে একা পরিবর্তন করতে পারবেন না বলেই গড়ে তুলেছিলেন শান্তিনিকেতন।
সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের বহিঃবিশ্বের নানাবিধ বিদ্যাশিক্ষায় সুশিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। যাতে সমগ্র ভারতবর্ষ একদিন এর সুফল পায় । তাঁর সেই স্বপ্ন বৃথা যায়নি। আজ কেবল ভারতবর্ষই নয়, সমগ্র বিশ্বের বাঙালিসহ অন্য ভাষাভাষীর কাছে রবীন্দ্রনাথ একটি বিস্ময়কর নাম।
জুড়ো ও জুজুৎসু কলাকৌশলের বিদ্যাটিতে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং এর প্রদর্শনীও হয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু কাজটি তত সহজ ছিলো না। এ বিষয়ে সমীর সেনগুপ্তের গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো-
“জাপানে জুজুৎসু ও জুডো পদ্ধতির নিরস্ত্র লড়াইয়ের প্রদর্শনী দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। অস্ত্র আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ ভারতবাসীর হাতে একটা লাঠিও রাখা তখন নিষেধ। রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, জুজুৎসু ভারতবাসীর অস্ত্রের অভাব ঘোচাতে পারবে। জাপানে তিনি ব্যবস্থা করে এসেছিলেন, সেই অনুযায়ী জুজুৎসু ওস্তাদ তাকাপাকি শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছেন ১৯২৯ সালের নভেম্বর মাসে।
এর জন্যে দু’বছরে প্রায় চৌদ্দ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন তিনি। টাকার অঙ্ক থেকে তাঁর উৎসাহের পরিমাণ আন্দাজ করা যায়। কিন্তু কোনো স্থায়ী কাজ হয়নি। শ্রমবিমুখ বাঙালি মধ্যবিত্ত যুবসমাজকে এবং লজ্জাভারক্লিষ্ট বাঙালি মধ্যবিত্ত নারীসমাজকে তিনি জুজুৎসু শিক্ষায় উৎসাহিত করতে পারেননি।
তাকাগাকি আশ্রম ত্যাগ করবার সঙ্গে সঙ্গেই জুজুৎসুর চর্চা উঠে যায়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ক্ষোভের সঙ্গে মন্তব্য করেছেন, একজন কর্মী শিখিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাকে স্থায়ীভাবে রাখিবার কোনো ব্যবস্থা করা হইল না। কলকাতায় নিউ এম্পায়ার মঞ্চে নবীন উপস্থাপিত হল পরপর চারদিন, ১৭ থেকে ২০ মার্চ ১৯৩১। তার আগে ১৬ মার্চ সেই মঞ্চেই জুজুৎসুর প্রদর্শনী হল তাকাগাকি এবং শান্তিনিকেতনের ছাত্র-ছাত্রীরা দেখালেন। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ এই গানটি বেঁধে দেন।
উক্ত বিষয়ে তৎকালীন সময়ের ছাত্রী রমা চক্রবর্তীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য:
“শান্তিনিকেতনে ছোরা খেলা, লাঠি খেলা ও জুজুৎসু ( জুডো) শেখানো হত। গুরুদেব জুজুৎসু শেখাবার জন্য, জাপান থেকে সেখানকার সুবিখ্যাত একজন শিক্ষককে আনিয়েছিলেন। তাঁর নামছিলো তাকাগাকি। এসব শেখা মেয়েদেরও আবশ্যিক ছিলো। জুজুৎসু শিখতে প্রথমটা সংকোচ ও ভয় দুই-ই মনকে বেশ দুর্বল করেছিল, তা স্বীকার করি।
কিন্তু শিখতে শিখতে ক্রমে সেই আড়ষ্টতা ও ভয় সব চলে গিয়েছিল। তাকাগাকির মতো বেশ শক্ত সমর্থ দশাসই মানুষকে নিমেষে উল্টে ফেলার চমক আজও মনে পড়ে। ওখানে গিয়ে শুনেছিলাম যে জুজুৎসু শিখতে মেয়েরা সংকোচ করছে জেনে, শুরুদেব “সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান গানটি রচনা করেছিলেন।
“ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।
একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো ॥ ১১৩
কবির এই গানটি যেকোনো বিপদে বাঙালিকে শক্তি দেয়। ‘আগুন জ্বালো’ কথাটিতে যে প্রতিবাদ ও উদ্দীপনার মিশ্রণ রয়েছে তা সত্যিই বিরল। বিপদ-শঙ্কা-ভয় থেকে পরিত্রাণ পেতে মনের মধ্যে আগুন জ্বালাতে হবে। সেই আগুনে সব অবজ্ঞাশক্তিকে বিনাশ করতে হবে। কবির এই গানটি বাঁশরী নাটকে স্থান পেয়েছে। এই নাটকের ২য় দৃশ্যের চরিত্র সোম শংকরের গান এটি।
“চলো যাই, চলো যাই চলো যাই- চলো পদে পদে সত্যের ছন্দে চলো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে। ১৯৫ এই গানটিও ১৯৩৭ সালে ২৪ জানুয়ারি লেখা হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এই গান সম্পর্কে লিখেছেন :
“কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নিকট হইতে কবির কাছে অনুরোধ আসিয়াছে আগামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস -এর (২৭ জানুয়ারি ১৯৩৭) জন্য একটি বিশেষ গান লিখিয়া দিতে হইবে। সেই অনুরোধে কবি প্রথমে লেখেন ‘শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান’ও পরে লেখেন ‘চলো যাই, চলো যাই শেষ গানটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নির্বাচিত হয়।
শান্তিনিকেতনে কয়েক দিন এই গানের মহড়া চলে। ছাত্ররা এই গানটি শিখিয়া শ্রেণীবদ্ধভাবে শিক্ষকদের সঙ্গে অধ্যক্ষ ধীরেন্দ্রমোহন সেনের নেতৃত্বে মন্দিরে যাইত। কিন্তু এ গানটি চালু হইল না। কিন্তু ‘শুভ কর্মপথে গানটি নানা অনুষ্ঠানে গীত হইতে দেখা যায়।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে ছাত্ররা গানটি গাহিয়াছিল। দুঃখের বিষয় শ্যামাপ্রসাদের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠা দিবসের উৎসব সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয় নাই; কারণ মুসলমান ছাত্ররা উৎসবে যোগদান করে নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীল (seal)-এ ‘পদ্ম’ ও ‘শ্রী’ পৌত্তলিকতার প্রতীক বলিয়া তাহা উঠাইয়া দিবার জন্য মুসলমানরা কিছুকাল হইতে জিদ করিতেছিল। সেই আন্দোলনের অভিঘাতে প্রতিষ্ঠা দিবসের উৎসব অসম্পূর্ণ রহিয়া গেল।
এই গানটি সম্পর্কে ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকারও লিখেছেন যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের নিয়ে একটি প্রসেশন করতে চান। তাই রবীন্দ্রনাথকে একটি মার্চ সং লিখে দিতে অনুরোধ করেন। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিন প্রতিটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা নিয়ে কলকাতার রাস্তা দিয়ে ‘চলো যাই, চলো যাই’ গানটি গাইতে গাইতে ময়দানে সমবেত হলে শ্যামাপ্রসাদ ছেলেদের অভ্যর্থনা করেন।
ওরে, নূতন যুগের ভোরে
দিস নে সময় কাটিয়ে বৃদ্ধা সময় বিচার করে ।
একজন রবীন্দ্রনাথই পারেন ৭৬ বছর বয়সে তাঁর জীবনের শেষ স্বদেশিসংগীতে নতুন যুগের ভোরের কথা বলতে। রবীন্দ্রনাথ সবসময় যা কিছু নতুন তা বুক ভরে গ্রহণ করেছেন। অকারণ হিসেব কষে সময় পার করা, সংশয়-দ্বিধায় প্রাপ্যকে দুষ্প্রাপ্য করা কবির মনোবিরুদ্ধ ছিলো। তাই জীবনের এ পর্যায়ে এসেও কবি অজানাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছেন।
কবি জানেন যতই বাধা আসবে ততই জীবনের পথ প্রসারিত হবে। কারণ বাধা অতিক্রমের আনন্দে জয় অনিবার্য। সকল বাধাকে অজানাকে বুকে জড়িয়ে আলোর সন্ধান করতে হবে তবেই নতুন যুগের ভোরের সন্ধান মিলবে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালকে মধ্যমপর্ব ধরে এর পূর্বে ও পরের সময়ে এই তিনটি স্তরে রচিত রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্বের গানের তাত্ত্বিক আলোচনা করা হলো।
এই আলোচনার ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্যায়ের গানের একটি ইতিহাস-নির্ভর ছক প্রদান করা যায় যেখানে তা গীতবিতানের স্বদেশ ও জাতীয় সংগীত পর্যায়ের গানগুলোর সন্নিবেশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্যায়ের গানে স্বদেশচেতনার আভাস বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তারমধ্যে স্বদেশ পর্যায়, জাতীয় সংগীত পর্যায়, পূজা পর্যায়, বিচিত্র পর্যায় অন্যতম।
উল্লেখ্য স্বদেশ পর্যায়, জাতীয় সংগীত পর্যায়ে গানের তালিকা গীতবিতানে সুন্দরভাবে সন্নিবেশ করা আছে। অন্যদিকে গবেষণার স্বার্থে পূজা পর্যায়, বিচিত্র পর্যায়ের গানের মধ্যে থেকে গভীর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে স্বদেশ চেতনামূলক গানের তালিকা নিরূপণ করা হয়েছে। প্রথমে স্বদেশ পর্যায়ের ৪৬টি এবং জাতীয় সংগীত পর্যায়ের ১৬টি মোট ৬২টি স্বদেশচেতনামূলক গানের তালিকা নিম্নে উপস্থপন করা হলো।
বঙ্গভঙ্গ পূর্ব গান
বঙ্গভঙ্গ কালের গান
বঙ্গভঙ্গোত্তর কালের গান
উপরে প্রদত্ত তালিকা এবং গানের বিশ্লেষণ থেকে উপলব্ধি হয় যে, বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপর্যায়ের গান জাতিকে তৎসময় যথার্থ দিক নির্দেশনা দিতে সমর্থ হয়েছিলো। বঙ্গভঙ্গোত্তর পর্বের রচনা মূলত বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান, গীত ও নৃত্যনাট্যের প্রয়োজনে রচিত হলেও মানবের অন্তর জাগানিয়া গান গেয়েছেন তিনি বাঙালিসত্তার কল্যাণ সাধনে, কিন্তু ভদ্রলোক খ্যাত সকল বাঙালির মনে এই ভাবনার অপ্রতুলতায় রবীন্দ্রনাথ ব্যথিত হতেন
“বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাল জোয়ারে নেমে রবীন্দ্রনাথের লাভ হয়েছিল এই যে, রাজনীতি যাঁরা করেন সেই ভদ্রলোকদের সামাজিক অবস্থান ও দৃষ্টিকোণ যেমন তিনি ভিতরের লোক হিসেবে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন, তেমনি নিজস্ব উপলব্ধি ও চিপ্রবণতাকে স্পষ্টভাবে চিনে ওঠা সম্ভব হয়েছিল তাঁর পক্ষে।
স্বদেশীদের দেশহিতৈষণা ও জাতীয়তাবোধে কোনো ফাঁকি ছিল না, কিন্তু জাতিকে যথার্থ পরিত্রাণের ক্ষমতা তাদের পেশী ও মননে অনুপস্থিত ছিল তাঁরা ‘ভদ্রলোক’ বলেই। স্বদেশী আন্দোলনের ইতিহাসকার সুমিত সরকার প্রাঞ্জল ভাষায় গভীর সত্য কথা বলেছেন।
আরও দেখুন :