আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলা গীতিনাট্যে রবীন্দ্রনাথ
বাংলা গীতিনাট্যে রবীন্দ্রনাথ
বাংলা গীতিনাট্যে রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের জন্মলগ্নেই ছিলো সঙ্গীতের আশীর্বাদ। তাদের অভিজাত পরিবারে একদিকে যেমন হিন্দুস্তানী রাগসঙ্গীতের চর্চা ছিল, তারই পাশে বাংলার দেশী সঙ্গীতেরও স্থান ছিলো। কিশোরী চাটুজ্যের বিবরণ থেকে জানা যায়, দাওরায়ের পাঁচালীর শব্দঝঙ্কার কবিকে কতখানি মুগ্ধ করেছিল। অন্যদিকে রামায়ণ- মহাভারত প্রভৃতি তৎকালীন সাহিত্য সঙ্গীতকে প্রভাবিত করেছিলো।
সেই কারনেই বিদেশী সাহিত্যরসিক হয়েও যুদঘর্মকে অস্বীকার করতে পারেন নি। এরই সঙ্গে, ঠাকুর পরিবারে পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তাঁর দিকটিও অনুধাবনযোগ্য। ইতিমধ্যে ১৮৬৮-৬৯ খৃষ্টাব্দের সময় বিদেশী ইতালীয় অপেরা কলকাতায় অভিনয় করেন। পুরানো গীতিনাট্যের (নাট্যগীতি ও যাত্রা) আদর্শ তো ছিলই, সেই সঙ্গে বিদেশী অপেরার আদর্শও দেখা গেল। শিক্ষিত-অভিজাত সমাজের দৃষ্টি গেল সেদিকে।
১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী’ নাটক অভিনীত হলে দেখা গেল তাতে দু’খানা গান ইংরেজি সুরে রচিত। রবীন্দ্রনাথও ইউরোপীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নিতান্ত পিছিয়ে ছিলেন না। প্রসঙ্গক্রমে ইন্দিরাদেবীর কথা উল্লেখ করে শ্রীশান্তিদেব ঘোষ পাঁচটি ইংরেজি গানের তালিকা দিয়েছেন। অতএব, দেখা যাচ্ছে স্পষ্টতই ঠাকুর পরিবারে রাগসঙ্গীত, দেশী সঙ্গীত এবং ইউরোপীয় সঙ্গীতের চর্চার ক্ষেত্র প্রশস্ত ছিল।
এর প্রথম দুটি প্রাচীন ঐতিহ্য, তৃতীয়টি নবীন। প্রাচীন ও নবীনের সাযুজ্যই ঊনিশ শতকের সাহিত্য সঙ্গীতের মূল কথা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সতেরো বছর বয়সে প্রথম বিলেত যান। যাত্রার তারিখ ছিল ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ (৫ আশ্বিন ১৮৮৫)। ব্রাউটনে থাকতে কবি ইউরোপীয় নৃত্য ও সঙ্গীতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। এই প্রবাসজীবনে তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীত শোনবার ও শেখবার চেষ্টা করেন।
১২৮৬ সালের মাঘ মাসের (ফেব্রুয়ারি ১৮৮০) মাঝমাঝি তিনি ফিরে এলেন কলকতায়। যেজন্য বিলেত গিয়েছিলেন, তা হলো না। কিন্তু এই প্রবাসজীবন নানাদিক থেকেই উল্লেখযোগ্য; বিশেষভাবে সঙ্গীতের দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। এই সময়ে লেখা চিঠিপত্র থেকে কবির সঙ্গীত সম্বন্ধে অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা স্মরণযোগ্য:
১. আমরা যেদিন ফ্যান্ডি-বলে অর্থাৎ ছন্দবেশী নাচে গিয়েছিলাম- কত মেয়ে-পুরুষ নানারকম সেজে গুজে সেখানে নাচতে গিয়েছিলো
২. গত মঙ্গলবারে আমরা এক ভদ্রলোকের বাড়িতে নাচের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম
৩. যা হ’ক এই পরিবারে সুখে আছি। সন্ধ্যেবেলা আমোদে কেটে যায়। গান বাজনা, বই পড়া।
একই সঙ্গে ‘জীবনস্মৃতি’র ‘বিলাতি সঙ্গীতের কিছুটা অংশ মিলিয়ে দেখা চলে :
১. ইহার পরে গান শুনিতে শুনিতে ও শিখিতে শিখিতে ইউরোপীয় সঙ্গীতের রস পাইতে লাগিলাম।… ইউরোপের গান এবং অমাদের গানের মহল যেনো ভিন্ন….
২. দেশে ফিরিয়া আসিয়া এই সকল এবং অন্যান্য বিলেতি গান স্বজনসমাজে গাহিয়া শুনাইলাম । সকলেই বলিলেন, রবির গুলা এমন বদল হইলো কেন, কেমন যেন বিদেশী রকমের, মজার রকমের হইয়াছে। এমনকি তাঁহারা বলিতেন, আমার কথা কহিবার গলারও একটুকেমন সুর বদল হইয়া গিয়াছে।
অর্থাৎ, প্রবাস-জীবনে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপীয় সঙ্গীতের যে অভিজ্ঞতা, তাতে দেখা গেল- তিনি ইউরোপীয় সঙ্গীতে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার বিলাত-প্রবাসে এ অভিজ্ঞতা আরো গভীরতা পায়।
আরও দেখুন :