বাংলা নৃত্যনাট্য

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলা নৃত্যনাট্য

বাংলা নৃত্যনাট্য

 

বাংলা নৃত্যনাট্য

 

বাংলা নৃত্যনাট্য

ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের যে কটি মূলধারা, রবীন্দ্রনৃত্যধারা সে অর্থে কোনো ধ্রুপদী নৃত্যধারা নয়। বরং রবীন্দ্রনৃত্যধারাকে বলা যেতে পারে বিভিন্ন ধ্রুপদী নৃত্যধারার এক পূর্ণাঙ্গ এবং মিলিত সমন্বয়। নৃত্য সম্বন্ধে কবিকে আমরা ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠতে দেখি, ১৮৮৮ সালে মায়ার খেলা গীতিনাট্য রচনার পর থেকে ১৯৩৫ সালে চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য রচনার পরবর্তী সময়টুকুতে।

এই সময়ের রচিত কাব্যগ্রন্থ কড়ি ও কোমল, চিত্রা, গীতাঞ্জলি, নৈবেদ্য, খেলা, বলাকা ইত্যাদি কাব্যের অনেক কবিতায় কবিমনের নিরুদ্দেশ যাত্রার আভাস পাই। এ হলো সীমা থেকে অসীমের যাত্রা। এই যাত্রা গতিময়তার প্রকাশ। গতিশীল জীবন বোধের প্রেরণায় বন্ধনমুক্তির অদম্য বাসনা এই কাব্যগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রকাব্যের এই যে অনাড়ম্বর আটপৌরে মানস উল্লাস অর্থাৎ বন্ধনমুক্তির আনন্দ তা বস্তুত চিত্রধর্মী।

এই কবিচেতনা অবশেষে চিত্রময় বা রূপময় জগতে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই জগত নৃত্যালোকের জগত। যে জগতের মূল চেতনা চিত্রগীতি ছন্দোবোধ। সমগ্র বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে যে ছন্দ অবিরত বেজে চলেছে। যার একটুখানি পতনেই সৃষ্টির প্রলয়। সেই মহাকালের ছন্দবৈচিত্র্য রবীন্দ্রনৃত্যভাবনার নেপথ্যের মূল সুর। এই দুই এর মিলনে যে ছন্দে মহাকালের মন্দিরা ডাইনে বাঁয়ে সদাই বেজে চলেছে তাতে যে নৃত্যের গতি, প্রকৃতিতেও সেই নৃত্যের ছন্দ।

জন্ম-মৃত্যু-সুখ-দুঃখ, জোয়ার-ভাটা এ সবই সেই মহাকালের নৃত্যছন্দের এপার-ওপার। সেই বিশ্বছন্দের সাথে তাল মেলানোই কবির নৃত্য ছন্দের মূল সূর এবং সাধনা। গীতবিতানের বিচিত্র পর্যায়ের প্রথম সাতটি গান কবির নৃত্য ভাবনার প্রতিফলন।

১. আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো

২. নৃত্যের তালে তালে

৩. নাই ভয় নাই ভয় নারে

৪. প্রলয় নাচন নাচলে

৫. দুই হাতে কালের মন্দিরা

৬. মম চিত্তে নিতি নৃত্যে

৭. আমার ঘুর লেগেছে

 

বাংলা নৃত্যনাট্য

 

রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ভাবনার নায়ক নটরাজ। তাকেই তিনি নর্তকের রূপকল্প হিসেবে গ্রহণ করে বলেছেন,

‘নটরাজের তান্ডবে তাঁহার এক পদক্ষেপের আঘাতে বহিরাকাশে রূপলোকে আবর্তিত হইয়া প্রকাশ পায়। তাঁহার অন্য পদক্ষেপের আঘাতে অন্তরাকাশে রসলোক উন্মথিত হইতে থাকে। অন্তরে বাহিরে মহাকালের এই বিরাট নৃত্যছন্দে যোগ দিতে পারলে জগতে ও জীবনে অখন্ড লীলারস উপলব্ধির আনন্দে বন্ধন ক্ত হয়। নটরাজ পালাগানের এই মর্ম।

নৃত্যের সংজ্ঞা কবি দিয়েছেন এভাবে, ‘আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভার, তাকে চালনা করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতিবেগ। এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পরের মিলনে লীলায়িত হয় তখন জাগে নাচ। দেহের ভারটাকে দেহের গতি নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র করে জীবিকার প্রয়োজনে নয়- সৃষ্টির অভিপ্রায়ে; দেহটাকে দেয় চলমান শিল্পরূপ। তাকে বলি নৃত্য’।

আরেক জায়গায় বলেছেন, ‘আমি সেই বিচিত্রের দূত। নাচি নাচাই, হাসি হাসাই, গান করি, ছবি আঁকি, যে আসি; বিশ্বপ্রকাশের অহেতুক আনন্দে অধীর আমি তাঁরই দূত। যে বিচিত্র বহু হয়ে খেলে বেড়ান দিকে দিকে সুরের গানে নৃত্যে চিত্রে বর্ণে বর্ণে রূপে রূপে সুখে দুঃখের আঘাতে সংঘাতে ভালোমন্দের দ্বন্দ্বে তাঁর বিচিত্র রসের বাহনের কাজ আমি গ্রহণ করেছি।

এই আশ্রমের নীলাকাশ উদয়াস্তর প্রাঙ্গণে এই সুকুমার বালক বালিকাদের লীলাসহচর হতে চেয়েছিলেন। লীলাময়ের লীলার ছন্দ মিলিয়ে এই শিশুদের নাচিয়ে গাইয়ে এদের চিত্তকে আনন্দে উদ্বোধিত করার চেষ্টাতেই আমার আনন্দ আমার সার্থকতা।’

রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি থেকেই শান্তিনিকেতনের পাঠক্রমে নৃত্যকে অন্তর্ভুক্ত করার আগ্রহ এবং প্রচেষ্টার খানিকটা সূত্র পাওয়া যায়। শান্তিনিকতনের যে নৃত্যধারা সে কেবল নৃত্যশিল্পী তৈরি করার উদ্দেশ্যে নয়। পরিপূর্ণ শিক্ষার অংশ হিসেবে কবি জ্ঞানার্জনের সঙ্গে সঙ্গে সংগীত, অভিনয় ও চিত্রকলার মত নৃত্যকে সমমর্যাদার প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন।

তিনি চেয়েছিলেন রুচিশীল ধ্রুপদী ও দেশীয় নৃত্যকলার সমন্বয়ে একটি মন সম্পন্ন নৃত্যধারার চর্চা যা আধুনিক সমাজের একটি সংস্কৃতি মনস্ক মন তৈরী করবে এবং নব্যভারতীয় নৃত্যধারাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে। যদিও সেটা সহসাই সম্পন্ন হয়নি।

 

বাংলা নৃত্যনাট্য

 

মনে রাখা দরকার যে তার নৃত্যভাবনা সম্পূর্ণ ভাবে শান্তি নিকেতন আশ্রমের প্রকৃতি, পরিবেশ এবং পাঠ্যক্রমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। নেপথ্যে ছিল।বিদেশে এবং দেশের বিভিন্ন প্রদেশে, প্রচলিত নৃত্য পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা আর বিশ্বজগত আর জীবনস্বরূপ যে লীলায়িত নটরাজের নৃত্যছন্দ প্রত্যক্ষ করেছিলেন তারই প্রতিফলন ।

আরও দেখুন :

Leave a Comment