আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলা শ্যামা। ১৯৩৬ সালে শ্যামা যখন প্রথম অভিনীত হয় তখন তার নাম ছিল পরিশোধ। কথা ও কাহিনী কাব্যগ্রন্থের পরিশোধকে নৃত্যাভিনয়ে পরিকল্পনা করেন প্রতিমা দেবী। রবীন্দ্রনাথ গল্পটি নিজের মতো সাজিয়ে নতুন নতুন গান তৈরী করে পরিশোধকে নৃত্যভিনয়ের উপযোগী করে তৈরী। করে দেখল প্রথম অভিনীত হয় ১০ ও ১১ ই অক্টোবর কলকাতায় আশুতোষ কলেজের রঙ্গমঞ্চে।
বাংলা শ্যামা
বাংলা শ্যামা
১৯৩৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে শান্তিনিকেতনে পরপর দুদিন পরিশোধ নৃত্যকাব্যের অভিনয় হয়। শান্তিদেব ঘোষ এর লেখায় জানা যায়। ‘এবারকার পরিশোধ অভিনয়ের নৃত্যে আমরা নতুন ভাবে একটি পরীক্ষায় হাত দিয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম ভরতনাট্যম, মণিপুরী, করুক, কথাকলি ও সিংহলের ক্যান্ডি নাচকে নাটকের চরিত্রানুযায়ী ব্যবহার করতে।
যেমন: মৃণালিনী (সারাভাই) শান্তি নিকেতনে ছাত্রী হিসেবে যোগদানের পূর্বে ভারত নাট্যম শিখে এসেছিলেন তাঁকে বজ্রসেনের গানের সঙ্গে ভরতনাট্যমের নৃত্যভঙ্গিকে অভিনয় করার জন্য তৈরী করা হলো। নন্দিতা (কৃপালিনী) শ্যামার নাচ তৈরী করলেন মণিপুরীতে। আশা ওঝা জয়পুর ঘরানার কক্থক নৃত্যে ভালো করেই শিখে এসেছিলেন উত্তিয়ের ভূমিকায়। তার গান কটির নাচ তৈরী হয়েছিল খাটি কথক নাচের অভিনয় পদ্ধতিতে।
কথাকলি নৃত্যে প্রহরীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কেলু নায়ার। সিংহলের ছাত্র অনঙ্গলাল কোটালের চরিত্রে অভিনয় করেন ক্যান্ডী নাচের আঙ্গিকে। সখীদের নাচে ছিল মণিপুরী নাচের প্রাধান্য।’ রবীন্দ্র নৃত্যে ধ্রুপদী নৃত্যধারায় আরেকটি দিক কথকযুক্ত হয় আশা ওঝা নামের শান্তি নিকেতনের তৎকালীন একটি অবাঙ্গালী ছাত্রীর মাধ্যমে। কবি আশার নাচ দেখে মুগ্ধ হন এবং তারই ইচ্ছা অনুসারে তাকে উত্তিয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে বলা হয়।
আশার অবস্থাপন্ন পিতা সে খবর শুনে কথক নৃত্যের গুরুকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেন। আশা তার শুরুর সহযোগীতায় কথক এ শৈলীতে উত্তিয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সবাইকে মুগ্ধ করে। পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনের কত্থকের ভাল শিল্পী আর আসেনি বিধায় রবীন্দ্রনৃত্যধারায় কথকনৃত্য সংযুক্ত হতে পারেনি।
প্রসঙ্গক্রমে এ কথা অনায়াসে বলা যেতে পারে যে কবি তার গানের সঙ্গে নাচের জন্য যখন যে পদ্ধতির নাচের ছেলেমেয়ে বা শিল্পী পেয়েছেন তাকেই ব্যবহার করেছেন। এবিষয়ে প্রচলিত ধ্যান ধারণার নৃত্যপদ্ধতির প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ বা গোড়ামি কোনোটাই তার ছিল না। তার লক্ষ্য ছিল খন্ড নাচের গানের বা নৃত্যেনাট্যের যে রসটি প্রকাশ করার কথা তা সঠিক ভাবে প্রকাশিত হলো কিনা।
যেমন কোটালের চরিত্রে ক্যান্ডী নৃত্যভঙ্গিতে যে অভিনয় করা হয়েছিল তাতে উত্তিয়দের হত্যার দৃশ্যে। শেষ দিকে তেহাই এর সাথে তলোয়ার হাতে অঙ্গলাল উত্তিয়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার মূহুর্তেই বাতি নিভিয়ে অন্ধকার করে দেওয়া হয় নাটকীয়তা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। এই নাচটি নাটকের প্রয়োজনে তৈরী করা হয়েছিল। ক্যান্ডী নৃত্যে তলোয়ার হাতে কোনো নাচ ছিল না।
মিশ্রনের চুড়ান্ত পরীক্ষার নিদর্শন শ্যামা নৃত্যনাট্যের মধ্যে রয়েছে। শ্যামার মূল নৃত্যাদর্শ গড়ে উঠেছে চরিত্রের উপযোগী করে।
শ্যামার নাচে প্রত্যেক নৃত্য পদ্ধতির নিজস্ব রীতিতে অভিনয়ের প্রয়োজনে বোলের নাচ ব্যবহার করা হয়েছিল।
শুরুতে বজ্রসেন ও বন্ধুর প্রবেশের দৃশ্য, বন্দুর পলায়ন, কোটালের প্রবেশ, বজ্রসেনের পলায়নের পর তালের নৃত্য : উত্তিয় বধের প্রস্তুতি নৃত্য ইত্যাদী। ১৯৩৯ সালে অভিনয়ের সময় কবি পরিশোধ নাম পরিবর্তন করে শ্যামা নামকরণ করেন। সে নামই চলে আসছে।
আরও দেখুন :