বিবর্তনের ধারায় আধুনিক সরোদ

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বিবর্তনের ধারায় আধুনিক সরোদ

বিবর্তনের ধারায় আধুনিক সরোদ

 

বিবর্তনের ধারায় আধুনিক সরোদ

 

বিবর্তনের ধারায় আধুনিক সরোদ

সরোদ যন্ত্রটির ইতিহাসের সাথে আফগানিস্তানের পাঠানদের একটি ঐতিহাসিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। কারণ সরোদের ইতিহাসের সাথে কাবুলী রবাব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই রবাব আফগান যোদ্ধাদের হাতে করেই উপমহাদেশের মাটিতে প্রবেশ করে এবং পরবর্তীকালে রবার এবং সরোদ বাদনে পাঠান বংশোদ্ভূত শিল্পীদের ব্যাপক অবদানও রয়েছে। আফগানী রবাব এবং সরোদের সম্পর্কের বিষয়ে ই এস পেরেরার মতামত অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য।

তিনি বলেছেন, কাবুলি রবাব বাদকগন উপমহাদেশে স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। তারা এদেশে প্রচলিত সেনিয়া বাদকদের বাদনরীতি দ্বারা অনুপ্রানিত বোধ করে। সেই কারণে তারা তাদের যন্ত্রের রূপ এবং শব্দের গুণ পরিবর্তিত করতে এবং সেনিয়া রবাবের মত উন্নত মানের শব্দ এবং বাদন পরিবেশনা আয়ত্ব করতে উৎসাহী হয়। এই বিষয়গুলোই তাদেরকে সঙ্গে আনা যন্ত্রটিতে পরিবর্তন সাধন করতে উৎসাহিত করে।

পাঠান বংশোদ্ভূত কাবুলী রবাব বাদকদেরা ভারতবর্ষে মূলত অভিবাসী ছিলেন, যার ফলে এদেশের রাজন্যবর্গের পৃষ্টপোষকতা তাঁদের ভাগ্যে জোটে নি, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জগতে যাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তিও কম ছিলো। তাঁরা হিন্দুস্তানে এসে ধ্রুপদী সংগীত শিক্ষা লাভ করেছেন, অথচ তাঁদের কাবুলি রবাবে এই সংগীত ধারণ করতে গিয়ে বারবার বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।

হিন্দুস্তানী সরোদ আবিস্কারের পর এই বাধা অনেকাংশে দূর হলো এবং পাঠান বংশোদ্ভূত সরোদিয়াগন হিন্দুস্তানী সংগীতের মূলধারায় চলে এলেন। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুস্তানী সরোদ আবিস্কারের আগে থেকেই তাঁরা সেনিয়া সংগীতজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে হিন্দুস্তানী ধ্রুপদ সংগীতে দক্ষতা অর্জন করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের বাদ্যযন্ত্রের সীমাবদ্ধতা তাঁদের দক্ষতা বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো বারবার।

হিন্দুস্তানী সরোদ আবিষ্কারের পর সেই বাধা অপসারিত হলো প্রায় সম্পূর্ণভাবে। তারপরও বাধা সম্পূর্ণ অপসারিত হয়েছে – একথা বলার সময় কিন্তু তখনো আসে নি। যে আকাঙ্খা পরিপূরণের উদ্দেশ্য নিয়ে পাঠান বংশোদ্ভূত সরোদিয়াগন দিনের পর দিন আবিস্কারের নেশায় মেতে উঠেছিলেন অর্থাৎ সেনিয়া শিল্পীদের ধ্রুপদ অঙ্গের বাদনকৌশল ফুটিয়ে তোলা, সেই উদ্দেশ্য পরিপূরণে অভাবিত সাফল্য লাভের পরও তা শতভাগ পরিপূর্ণ হয় নি তখনও, আধুনিক হিন্দুস্তানী সরোদ আবিষ্কারের পরও।

ধ্রুপদী ধারার সংগীত সাধনায় ব্রতী এমন কিছু শিল্পী এবং সংগীত সাধক এর পরও অক্লান্তভাবে অনুসন্ধান করে গেছেন সেনিয়া রবাবের উপযুক্ত বিকল্প খুঁজে বের করতে। সংগীতের ইতিহাসের এই অভিযান সমাপ্ত হয় বাংলাদেশের সন্তান ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান এবং ওস্তাদ আয়েত আলী খানের সফল গবেষণার মাধ্যমে সরোদের সর্বাধুনিক এবং উন্নততর সংস্করণ আবিস্কারের পর।

সেনিয়া রবাবে দ্বাদশ অঙ্গের আলাপচারী থেকে ধ্রুপদী যত পকার কলাকৌশল পরিবেশন করা যায় তা সাফল্যজনকভাবে পরিবেশনের উপযোগী হলো দুই ভাইয়ের আবিস্কৃত এই পরিশীলিত সরোদ। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান শুধু যে একজন খ্যাতিমান বাদক ছিলেন তা নয়, একই সাথে তিনি ছিলেন বাদ্যযন্ত্রের একজন গবেষক। সরোদ যন্ত্রের আধুনিকায়নে তিনি সুদীর্ঘ গবেষনা করেছেন।

তাঁর এই গবেষনাকার্যে একনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তাঁরই ছোট ভাই আরেকজন গুণী শিল্পী, সুরবাহার বাদক এবং সেইসাথে একজন দক্ষ বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা ওস্তাদ আয়েত আলী খান। আকৃতি পরিবর্তন এবং তারের পরিবর্তনের মাধ্যমে এই দুই ভাই সরোদ যন্ত্রের শব্দের গুণগত মানে এমন উৎকর্ষ সাধন করেন যার ফলে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে তা গুণে মানে অনেক উন্নত হলো এবং বলা যায় এ সময় থেকেই সরোদের সাহায্যে বিশ্বজয়ের সূচনা হলো।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সরোদে পরিবর্তন আনয়নের আগে সরোদের খোল ছিলো মাত্র নয় ইঞ্চি, ফিংগারবোর্ড ছোট এবং সরু ছিলো এবং গলার অংশ ছিলো মোটা। খোলে গায়ে খুব গভীর করে কাটা ছিলো। তারের সংখ্যা কম ছিলো, তার মেলানোর পদ্ধতিও আলাদা ছিলো, সবচেয়ে আসল কথা তারে শব্দের রেশ ছিলো ক্ষণস্থায়ী। সেনিয়া ঘরানার ধ্রুপদ অঙ্গের বাদন পদ্ধতিতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর গভীর জ্ঞান ছিলো।

 

বিবর্তনের ধারায় আধুনিক সরোদ

 

সেইসাথে কণ্ঠ সংগীত এবং বিভিন্ন ধরণের বাদ্যযন্ত্রে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিলো। যার ফলে তিনি বুঝতে পারলেন যে, তত্তালীন সরোদ যন্ত্রের প্রচলিত দৈর্ঘ্য প্রস্থের ফলে এর এমন কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে যার কারণে এতে ধ্রুপদ অঙ্গের কাজগুলো সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় না। তিনি ও তাঁর ভাই দু’জনে গবেষণা করে প্রথমে এর খোলটিকে আরো প্রসারিত এবং গোলাকার করে তৈরি করলেন। তৎকালীন সরোদে নয়টি তরফের তার ছিলো।

তাঁরা আরো ছয়টি তরফের তার এর সাথে সংযুক্ত করলেন। ফলে তরফের তারের মোট সংখ্যা দাঁড়ালো পনেরোতে। চিকারীর তারের সংখ্যা একটি বৃদ্ধি করলেন। সুর ধরে রাখার জন্য চারটি তার সংযোগ করলেন। এগুলো ড্রোন হিসেবে কাজ করা শুরু করল। অর্থাৎ সরোদের মধ্যেই তানপুরার আবহ সৃষ্টি হলো। এই চারটি তার লাগানোর জন্য ফিংগার বোর্ডের শেষ মাথায় মেরুর ঠিক নিচে ছোট আকারের আরেকটি পৃথক জওয়ারি লাগানো হলো।

এছাড়া ফিংগারবোর্ডের শেষ প্রান্তের কাছে খুঁটি লাগাবার জায়গার পেছন দিকে তাঁরা পিতলের একটি ছোট আকারের অনুনাদক বা তুম্বা সংযুক্ত করলেন। টেলপিস অর্থাৎ তার লাগানোর অংশটিকে নতুন আকৃতিতে তৈরি করলেন, যাতে মূল তার লাগাতে অসুবিধা না হয়। আগের টেলপিস ছিলো অনেকটা পেরেকের মত। নতুন টেলপিস অনেকটা প্রসারিত এবং পাতলা হলো। এই সকল পরিবর্তনের পেছনে সেনিয়া রবাব এবং সুরশৃঙ্গারের প্রভাব সার্থকভাবে কাজ করেছিলো।

বর্তমান শতাব্দীর বিশের দশকে সরোদে এই পরিবর্তন সাধিত হয়। পরিবর্তিত এবং উন্নততর এই সরোদের শব্দ আগের চেয়ে অনেক উন্নত হলো। আওয়াজ গভীর এবং জোরালো হলো এবং এর রেশও অনেক দীর্ঘস্থায়ী হলো। এর সুর প্রতিধ্বনিত হওয়ার ক্ষমতা, যাকে ইংরেজিতে Reverberate বলা হয়, তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। এই সমগ্র গুণাবলির কারণে যন্ত্রটি বীনে বাজানোর মত আলাপচারীর সকল অঙ্গ পরিবেশনের যোগ্যতা অর্জন করল।

পরিবর্তন সাধনের আগে সরোদে শুধু দ্রুত গৎ বাজনো হতো। মীড় বাজানো গেলেও মীড়ের স্থায়ীত্ব কম ছিলো। যে কারণে ধ্রুপদী শিক্ষাপ্রাপ্ত শিল্পীরা সরোদে গৎ বাজানোর আগে সুরশৃঙ্গার যন্ত্র নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলাপচারীর কাজ পরিবেশন করতেন। ঠিক যেমনভাবে আগেকার দিনে সেতারে গৎ বাজানোর আগে সুরবাহারে আলাপ বাজানোর প্রথা প্রচলিত ছিলো।

সঙ্গত কারণেই সরোদের নতুন সংস্করণ দ্রুত সমগ্র উপমহাদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করল। ওস্তাদ আয়েত আলী খান নিজ হাতে নতুন সংস্করণের একটি সরোদ তৈরি করে ভ্রাতপুত্র ওস্তাদ আলী খানের বিয়েতে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।

কোলকাতার প্রখ্যাত সরোদ নির্মাতা হেমেন সেন এই সরোদটিকে মডেল হিসেবে নিয়ে এর মাপজোখ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিপিবদ্ধ করে রাখেন এবং পরে সেই মাপ অনুযায়ী সরোদ তৈরি করে সমগ্র উপমহাদেশে এমনকি উপমহাদেশের বাইরেও প্রসিদ্ধি অর্জন করেন।

 

বিবর্তনের ধারায় আধুনিক সরোদ

চিত্র – প্রাচীন এবং ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের পরিমার্জিত সরোদের তুলনামূলক চিত্র

আরও দেখুন :

Leave a Comment