আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বিবিধ পর্যায়ের গানে স্বদেশচেতনা
বিবিধ পর্যায়ের গানে স্বদেশচেতনা
বিবিধ পর্যায়ের গানে স্বদেশচেতনা
অন্যান্য গীতিকবিদের সামগ্রিক রচনার সাথে স্বদেশ পর্বের গানের সংখ্যার তুলনা করলে অতুলপ্রসাদ সেনের স্বদেশের গান সবচেয়ে বেশি বলে গণ্য হবে। তাঁর ২০৬টি গানের মধ্যে ১৩টি গান সরাসরি স্বদেশ এবং বিবিধ পর্বের অনেক গানেও স্বদেশবোধটি বারংবার প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সত্য বলতে ছোটবেলা থেকে জীবনের শেষকাল অবধি তিনি সর্বতোভাবে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের সহায় হয়ে থেকেছেন।
তাই বৃহত্তর অর্থে তিনি সারাজীবন নিরবচ্ছিন্নভাবে স্বদেশ সেবা করে গিয়েছেন। বঙ্গভঙ্গ সময়কে কেন্দ্র করে তাঁর স্বদেশ পর্বের উল্লেখযোগ্য গান নেই সত্য, কিন্তু সমগ্রজীবন জুড়ে স্বদেশের জন্য নিবেদিত এমন কবির সংখ্যাও বিরল। সাহিত্যের জগতে তিনি মূলত সংগীত রচয়িতা এবং গায়ক। যে কয়টি কবিতা লিখেছেন সেগুলোর মধ্যে স্বদেশ মাতার প্রতি রয়েছে প্রণতিভরা নিবেদন। তাঁর ‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতার অংশবিশেষ,
“খোল মা খোল মা দ্বার বহুদিন পরে
আজি ও তামসরাতে উল্কার আলোকে
পথ চিনি পুরাতন মাতৃগৃহে পুনঃ
ফিরিয়া এসেছি; মোরা কোটি পুত্র তোর,
নহি মা অতিথি দেহে ডেকে নে গো ঘরে।
এই কবিতাটির মধ্যে কবি আপন স্বার্থ ত্যাগী সকলকে মিলে জননীর আরাধনা করতে আহ্বান করেছেন। কোটি হাত যখন এক হবে তখন এ মায়ের ঘরে আর কোনো ক্ষুধা তৃষ্ণা থাকবে না। এমনি স্বদেশপ্রেমমূলক বাণী উপলব্ধি করা যায় তাঁর বিবিধ পর্বের কতিপয় গানে। আলোচনার এ পর্বে তাই নিরূপণের প্রত্যয় রাখছি,
“প্রবাসী, চল্ রে দেশে চল
আর কোথায় পাবি এমন হাওয়া, এমন গাঙের জল।
যখন ছিলি এতটুকু,
সেথাই পেলি মায়ের সুধা ঘুম-পাড়ানো বুক;
সেখাই পেলি সাথির সনে বাল্যখেলার সুখ।
বিবিধ পর্বের এই গানটিতে কবি বাংলার প্রকৃতির রূপের বর্ণনা করেছেন। অতুলপ্রসাদ সেনকে একটি নতুন পত্রিকার জন্য কবিতা বা গান লিখে দিতে অনুরোধ করলে কবি স্বদেশের প্রকৃতির অপরূপ রূপের বর্ণনা তর্জমা করেন এই গানটির মাধ্যমে। তিনি অন্তরে আঁকা স্বদেশের ছবির মাধ্যমে নিজের চোখের তৃষ্ণাকেই নিবারণ করতে চেয়েছেন।
পদ্মা নদীর ধার, খেলার মাঠ, পাখির গান, মায়ের ভালোবাসা, ছেলেদের সাথে প্রাণখোলা খেলা, কত ফুল, পাখি, বাতাস, সব কবির মনে পড়ে যায়। তিনি পঁয়ত্রিশ বছর আগে ফেলে আসা গ্রামটিকে খুব ভালোবাসতেন। এ গানটি লিখতে লিখতে কবির আবার মনে। পড়ে যায় গ্রাম বাংলার প্রকৃতির কথা। তিনি এই গানটিতে নিজের ছেলেবেলায় দেখা সেই প্রকৃতির কথাই তুলে ধরেছেন,
“সেদিন আমার দেশের কয়েকটি ভাই আমাকে তাদের নবজাত পত্রিকার জন্য একটি কবিতা বা গান লিখে পাঠাতে বিশেষ করে অনুরোধ করেছিল। তখন আমার দেশের গ্রামখানির কথা মনে পড়ে গেল। সেই পদ্মা নদীর ধার, সেই খোলা মাঠ, খোলা প্রাণ, পাখির গান, বকুল ফুল, হরির লুটের বাতাসা, মায়েদের ভালবাসা, ছেলেদের সঙ্গে খেলা, খুব মনে পড়ে গেল।
আমার সেই মিষ্টি দেশটি আমার চোখের সামনে, আমার প্রাণের সামনে ভাসতে লাগল, ভাল করে মনে হল আমি ভুলিনি, ভুলিনি আমার দেশমাতাকে…যদিও প্রায় পঁয়ত্রিশ বৎসর সে গ্রামখানিতে যাইনি। দূর দেশে থাকলে কি হবে, মা’র টান বড় টান।
অপূর্ব আরেকটি বিবিধ পর্বের গানে বঙ্গজননীর জয়মালা গেঁথেছেন কবি। মায়ের সপ্তকোটি সন্তান বঙ্গমাতাকেই স্বর্গ মানেন। তাই প্রাণের বিনিময়েও মায়ের চরণে অর্ঘ্য দিতে প্রস্তুত। কবির ভাষায়,
“জননী বঙ্গ, তোমার সঙ্গ লভিয়া যদি গো
অঙ্গ আমার হয় না মা,
ক্ষয় তথাপি রঙ্গে ভ্রুকুটি ভঙ্গে তুচ্ছ করিয়া
গাহিব জননী, তোমারি জয়।
স্বদেশমাতার রূপের বর্ণনা পাই তাঁর আরো একটি বিবিধ পর্যায়ের গানে। তিনি প্রকৃতির বর্ণনা করতে করতে এই প্রকৃতির নিষ্ঠুর দানে নিঃস্ব মানুষের জন্য ভিক্ষা প্রার্থনা করেছেন। মায়ের সন্তানেরা অনাহারে থাকলে সে রূপের কী মূল্য! অতুলপ্রসাদ চিরকাল দুঃখীর পাশে, আর্তের সেবায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর একার সেবায় মায়ের শত শত সন্তানের ক্ষুধা নিবারণ সম্ভব ছিলো না।
তাই কবি গোমতীর বন্যায় বিধ্বস্ত গরিব পল্লীবাসীদের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। কবির ভাষায়, ‘মা, তোর শীতল কোলে তুলে নে আমায় / তোর মেঘে-ঢাকা পাখি-ডাকা শ্যামল শাখায়। বিবিধ পর্যায়ের এই গানটির মধ্যেও স্বদেশের তরে সকলের কাছে মিলনের আহ্বান জানিয়েছেন কবি। অতুলপ্রসাদ সকলকে প্রেমডোরে বাঁধতে চেয়েছেন।
যুবকজনের এই সম্মিলন দেশের কাজে দশের কাজে যেন পরিপূর্ণ সুবাতাস বয়ে আনে কবি এটি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছেন। তিনি যেমনি ছিলেন মানব ও দেশের জন্য নিবেদিত প্রেমে ভরা প্রাণ, তেমনি আকুলতা ছিলো তাঁর ঈশ্বরের প্রতি। একা নিবিষ্টচিত্তে তিনি ঈশ্বরের দ্বারে নিজেকে উন্মোচন করতেন যেমনি আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাই তাঁর ব্রহ্ম উপাসনায়।
ব্রহ্মের মধ্যদিয়ে তিনি সমগ্র বিশ্বকে অবলোকন করতেন। তাই রবীন্দ্রনাথের সকল ক্ষেত্রে নিজেকে আত্মনিবেদনে প্রস্তুত থাকতেন অতুলপ্রসাদ। যখনই রবীন্দ্রনাথের ডাক আসতো কি শান্তি নিকেতন, কি ঠাকুরবাড়ী তিনি ছুটে যেতেন শত ব্যবস্ততার মাঝেও প্রকৃতিপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ অভ্যস্ততার অভাবে মানুষের সাথে সহসা কোলাকুলি, গলাগলি, মাখামাখি করতে পারতেন না।
কিন্তু প্রকৃতির মতো তিনি মানুষকেও বড় বেশি ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন অতুলপ্রসাদ সেনকে। অতুলপ্রসাদ সেনও মানুষের ভালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারতেন। এত বিশাল রবীন্দ্রনাথ অথচ তাঁর অন্তরের নিভৃতবাণী তিনি অতুলপ্রসাদ সেনকে প্রকাশ করতেন। বঙ্গভঙ্গকালে রাজনীতির স্বার্থপরতা, রেষারেষি, নেতৃত্বের দলাদলিতে আহত হয়ে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।
সরে দাঁড়ান অতুলপ্রসাদ সেনও। প্রচ্ছন্নভাবে যেন অতুলপ্রসাদ তাঁর ভাবগুরুর পথই অনুসরণ করে চলছিলেন। জীবনের সকল প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, অভিমান- বঞ্চনাকে অর্ঘ্য করে রবীন্দ্রনাথে সমর্পণ করে তাঁর আরাধ্যের পূজা সাঙ্গ করলেন। অতুলপ্রসাদ সেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহশীল দরদী মনটাকে দেখতে পেরেছিলেন-যা দূরে থাকা অনেকের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন ছিলো। দিলীপ রায়কে এ কথাগুলো বলতে বলতেই একদিন তিনি গেয়ে উঠলেন বঙ্গমাতার দুলাল রবির অমর জয়গাঁথা,
“জয়তু জয়তু জয়তু কবি,
জয়তু পুরব-উজল রবি।
জয় জগতবিজয়ী কবি,
জয় ভারতগৌরব রবি,
বঙ্গমাতার দুলাল ‘
রবি- জয় হে কবি ।
এই গানটি রচিত হয়েছিল লক্ষ্মৌতে রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। নবাব আলীর বাসভবনে উপস্থিত সকল গণ্যমান্যের দ্বারা রবীন্দ্রনাথকে স্বাগতকালে একটি বাঙালি মেয়ে অতুলপ্রসাদ সেন রচিত এই গানটি পরিবেশন করেছিল।
রবীন্দ্র সংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ী সান্যাল অতুলপ্রসাদ রচিত আরো একটি গান পরিবেশন করেছিলেন বালক-বালিকাদের সাথে নিয়ে যখন রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্মৌতে অতুলপ্রসাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামলেন। এ এক মন্ত্রমুগ্ধকর দৃশ্য। কবি বরণে বিগলিত সকল প্রাণ, ‘এসো হে এসো হে ভারতভূষণ, মোদের প্রবাসভবনে। আমরা বাঙালি মিলিয়াছি আজ পুজিতে বঙ্গরতনে।
প্রবাস জীবনে তাঁর লেখা আরো একটি অনন্য সংগীত যেখানে বঙ্গভারতীকে প্রবাসীদের প্রণতি নিবেদন করেছেন কবি, ‘এসো প্রবাসমন্দিরে, এসো গো বঙ্গভারতী।/ দীন প্রবাসী বঙ্গজনের লহো গো দীন আরতি। ২২ জানা যায়, লক্ষ্মৌতে অনুষ্ঠিত ‘প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন’-এর তৃতীয় অধিবেশনের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে এই স্বাগত সংগীতটি রচনা করেন অতুলপ্রসাদ সেন ।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলাকালে কংগ্রেসের অধিবেশনে কবি গেয়ে শুনিয়েছিলেন আরো একটি বিচিত্র পর্যায়ের গান যেখানে মূলত দেশের কাজকে আপন কাজ বলে ব্যক্ত করেছেন তিনি। আলোচনায় পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহামতি গোখলের সভাপতিত্বে বেনারসে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনের মূল প্রতিপাদ্য ‘বঙ্গভঙ্গ’ হওয়া স্বত্ত্বেও বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য,
এর প্রতিবাদের জন্য কোনো কার্যকরি সিদ্ধান্ত গৃহীত না হওয়ায় নিরূপায় নব্য সদস্য অতুলপ্রসাদ সেন গানের মধ্যদিয়ে কংগ্রেসের এই কর্মসূচির প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, ‘আপন কাজে অচল হলে চলবে নারে চলবে না। দেশের প্রতি কবির এই সরল ভালোবাসাকে অত্যন্ত সম্মান দেখিয়েছিলেন গোখলে। সহজ সরল অবয়বে এক শান্তিময় অভিব্যক্তির মানুষ ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন।
তিনি সমগ্র সময় জুড়ে সরল সমীকরণের মধ্যদিয়ে তাঁর জীবনটি অতিবাহিত করেছিলেন। কোনো অভিযোগে কাউকে কখনো অভিযুক্ত করেননি তিনি। একা সয়েছেন জীবনে কোলাহলশূন্য যন্ত্রণার ভার, আর তা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর গানের সুরের ভাজে ভাজে। তাঁর গান সম্পর্কে কনক দাশের মূল্যায়ন স্মরণযোগ্য, “অতুলপ্রসাদের গান তাই স্বমহিম। তাঁর গানের অলংকার সারল্যময়, অথচ মাধুর্যময় প্রকাশ, আঙ্গিক ও সুর।
এর সঙ্গে মিশ্রণ ঘটেছে ভাবের গভীরতা। ওই গভীর ভাব তাঁর গানের মধ্যদিয়ে হৃদয়ের সবচেয়ে শাশ্বত দুঃখকে আমাদের কাছে বারবার ফিরিয়ে দেয়। অতুলপ্রসাদের সুর পরিমণ্ডলে মিলিত সেই দুঃখ, সেই কারুণ্য আঘাত করে ফেরে প্রণয়াস্পদের সন্ধানে কোনও একাকী মানুষে। তাই তাঁর গান দুঃখ-কারুণ্য-বিষাদের পর জাগতিক সবকিছুর ওপরে পরম প্রেমের রাজত্বে অবাধ বিচরণ।
বাংলাগানের অনবদ্য গীতরূপ স্রষ্টার মধ্যে অন্যতম শিল্পচাষী অতুলপ্রসাদ সেন’র গানে যে স্বদেশচেতনায় যে উপদান লক্ষ্য করা যায় তা বিষয়-বৈচিত্র্যতার দিক থেকে রবীন্দ্রবলয়ে আবদ্ধ থাকলেও স্বমহীমায় ভাস্বর। বিভিন্ন আন্দোলন ও সভায় কবিগুরু সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার ফলে স্বদেশি আন্দোলকে তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন। আর তাই তার গানে অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যে স্বদেশচেতনার রূপ বিনির্মিত হয়েছে তা সমকালীন সময়ে প্রাসঙ্গিকতার দাবিদার।
বিখ্যাত ‘মোদের গরব মোদের আশা’ গানটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বলাবহুল্য তাঁর অল্পসংখ্যক গানে এ স্বদেশ চেতনার আভাষ পাওয়া গেলেও ব্যক্তিজীবন ও দর্শনে যে স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মগ্ন ছিলেন তা তাঁর জীবনের বিচিত্র ঘটনা থেকে দৃশ্যমান।
আরও দেখুন :