আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় বিভিন্ন ঋতুনাটো নৃত্যের প্রয়োগ
বিভিন্ন ঋতুনাটো নৃত্যের প্রয়োগ
বিভিন্ন ঋতুনাটো নৃত্যের প্রয়োগ
নটীর পূজার অভিনয় ও নৃত্যলীলা কবিচিত্তে সম্ভবত নতুন ভাবের উন্মেষ ঘটিয়েছিল। পরের বছর রচনা করলেন নটরাজ ও ঋতুরঙ্গ। এই দুটি ঋতুনাট্যে কবির নৃত্যচেতনা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। নৃত্য ও গীতের সাধনায় মুগ্ধ কবি স্তব ভরলেন নৃত্যদেবতা নটরাজের। লিখছেন,
“নৃত্যের তালে তালে, হে নটরাজ
ঘুচাও সকল বন্ধ হে
সুপ্তি ভাঙাও, চিত্তে জাগাও মুক্ত সুরের ছন্দ।
নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ
নৃত্যে তোমার মায়া
বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে
কাপে নৃত্যের ছায়া’।
এখানে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন,
‘প্রভু এই আমার বন্দনা
নৃত্যে গানে অর্পির চরণতলে,
তুমি মোর গুরু।
এই অনুষ্ঠানের গান, কবিতা ও নাচের দ্বারা তিনি উচ্চাঙ্গের শিল্পকলা হিসেবে নৃত্যকে যে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেন তা পরিস্কার দেশবাসীকে জানিয়ে দেন।
এই সময় থেকেই নৃত্যের প্রয়োজনে কবি গীত রচনা করেছেন, ছন্দবদল করেছেন। নাচের ছন্দ ও ভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে গানের ওপর নির্ভর করে গঠিত। আলাদা করে তালের ছন্দ দেখাবার রেওয়াজ তখনো শুরু হয়নি। এই দুটি ঋতুনাট্যে মণিপুরী নৃত্যধারা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করলো। একক নৃত্যই ছিল বেশি। কয়েকটি সম্মেলক নৃত্য ছিল।
১৯২৭ সালে ঋতুরঙ্গ থেকে ১৯৩১ সনে নবীন রচনার আগ পর্যন্ত শান্তি নিকেতনের যে বিশেষ নৃত্যধারা তা মণিপুরী আদর্শে চালিত হলেও পুরোপুরি মণিপুরীর অনুসরণ নয়। মেয়েরাই মূলত একক নৃত্যে অংশগ্রহণ করতো। দলবদ্ধ নাচ থাকতো খুবই কম। এবং নাচ হতো গানের দলের সমবেত গানের সঙ্গে।
১৯৩১ সালের মার্চ মাসে বসন্ত উৎসবের জন্য কবি রচনা করেন নবীন। নবীনের অভিনয়ে ছেলেরা নৃত্যে অংশগ্রহণ করেছিল। নবীনে মণিপুরী নাচের সঙ্গে পশ্চিম বাংলার বাউল, রায়বেশে ও রাঙ্গেরীয় লোকনৃত্য ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই সব রকমের নৃত্যপদ্ধতি নানা গানে বেশ ভালোভাবেই খাপ খাওয়ানো হয়েছিল।
এছাড়াও মিস ব্রুনার নামে হাঙ্গেরীয় একজন নৃত্যপটু ছাত্রী সে সময় শান্তি নিকেতনে ছিলেন ১৯৩১ সালে ভাদ্রমাসে কলকাতায় শিশুতীর্থ ও গীতোৎসব হয়। শিশুতীর্থের অভিনয়ের আগে গীতোৎসব নামে আলাদা নৃত্যগীতের অয়োজন ছিল। এতে নাচ ছিল নানা ধরনের। এতে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় প্রথম কথাকলি নৃত্যধারা পদ্ধতি সংযোজিত হলো শান্তিদেব ঘোষের তত্ত্বাবধানে।
এছাড়া বাসুদেবন নাচল তার দেশীয় ঢং-এ। বিদেশী নৃত্যপদ্ধতিতে নাচলেন জার্মানী থেকে শিখে আসা শ্রীমতি দেবী। হাঙ্গেরীয় শিল্পী নাচলেন তার দেশের সঙ্গে গুরুদেবের গানের সঙ্গে। এবাবে বিনা গানে কেবল তালে। বোলের সঙ্গে দু’ একটি নাচ দেখানো হয়েছিল। তার মধ্যে কথাকলির নাম উল্লেখ করা চলে করে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কবির কণ্ঠে তার আবৃত্তির সঙ্গে নাচ।
ভারতীয় নৃত্যধারায় এটি সন্দেহে নবতম সংযোজন। এর মধ্যে ঝুলন ও দুঃসময় সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। ঝুলনের নৃত। পদ্ধতি ছিল আধুনিক ইউরোপীয় নৃত্যপদ্ধতির উপর ভিত্তি করে । নেচেছিলেন শ্রীমতি দেবী। তার দুঃসময় ছিল মণিপুরী নৃত্যাঙ্গিকে, নেচেছিলেন হৈমন্তী দেবী এবছরই এরপর কবি শিশুতীর্থ রচনায় হাত দিলেন। শিশুতীর্থকে কবি বলেছেন কথিকা।
শিশুতীর্থ পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে যেভাবে আছে অভিনয়ের কারণে তার কিছু পরিবর্তন আনা হয়। নাটকটির উদ্বোধন বাক্য ছাড়া দশটি সগেং বিভক্ত। এই নাটকের প্রতিটি সর্গ কবি মঞ্চের পাশে বসে আবৃত্তি করেছিলেন এবং প্রায় প্রতিটি সরে আবৃত্তির সঙ্গে সমিতি দেবী ইউরোপীয় আধুনিক নৃত্যের আঙ্গিকে নাচের দ্বারা সেই ভাবকে প্রকা” করেছিলেন। শিশুতীর্থ রচনাপদ্ধতির সঙ্গে ব্যালে রচনা পদ্ধতির কিছুটা মিল রক্ষ্য করা যায়।
ব্যাল রচনার ক্ষেত্রে মূল বিষয়বস্তুটিকে বিভিন্ন দৃশ্যে। প্রথমে সাজিয়ে নেয়া হয় তারপর দৃশ্যানুযায়ী ভাবের দিকে লক্ষ্য রেখে নৃত্য, যন্ত্রসঙ্গীত ও দৃশ্যসজ্জা পরিকল্পিত হয়। শিশুতীর্থ বাস্তবিক ক্ষে এই আদর্শেই রচিত। প্রথমে শুধুমাত্র প্রিন্ট রচনা করা হয়েছে পরে এক একটি সর্গের ভান অনুযায়ী গানগুলোকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল ব্যালেতে নাচের ভিত্তি যন্ত্রসঙ্গিত আর শিশুতীর্থে নাচের ভিত্তি গান, আবৃত্তি ও কথা।
এই বছরই ডিসেম্বর মাসে রচনা করপন শাপমোচন। এটিও আগেরটির মতো একই পদ্ধতিতে রচিত। কেবল আরো বেশি নাটকীয়। একাধিক পাত্রপাত্রী এতে স্থান পেয়েছে। রাজা নাটক অবলম্বনে কবি এই নৃত্যনাট্যটি রচনা করেন। নৃত্যাভিনয়ের জন্যই এটি লেখা। শিশুতীর্থ পর্যন্ত গানের জন্যই নৃত্যের অবতারনা। নৃত্য গানের অনুষঙ্গ মাত্র। শাপমোচনে লক্ষ্য করা যায় নৃত্যের প্রয়োজনে গানের প্রয়োগ।
শাপমোচন ‘বহুবার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিনীত হয়। প্রতিবারই নৃত্যধারার উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রয়োগ রীতিতেও পরিবর্তন হয়। প্রতিবারই নৃত্যধারার উৎসর্যের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রয়োগ রীতিতেও পরিবর্তন আসে। মণিপুরী নাচের বোল দিয়েই তার সূত্রপাত। গানের মাঝে মাঝে ছোট খোলের বোল দিয়ে অভিনয় থেকে কেবল নাচের ছন্দে দর্শকের মনকে একটু আন্দোলিত করাই হল এর কাজ।
এর সূত্রপাত করেন নবকুমার সিং যিনি নটীর পূজার যুগে মণিপুরী নাচ শান্তিনিকেতনের মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। শাপমোচনের জন্য তাকে আবার আনা হয়েছিল। এছাড়া কথাকলি এবং মালাবারের মেয়েদের একপ্রকার নাচও ছিল। শাপমোচনের দৃশ্যগুলো নানা ঘটনার সমাবেশে রচিত যেমন ইন্দ্ৰসভা, মর্তদৃশ্য, রাজা চলেছেন, বিবাহের আয়োজন ইত্যাদি। সবই নৃত্যের আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।
আরও দেখুন :