রবীন্দ্রনৃত্যে বিভিন্ন নৃত্যধারার সমন্বয়

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্রনৃত্যে বিভিন্ন নৃত্যধারার সমন্বয়

রবীন্দ্রনৃত্যে বিভিন্ন নৃত্যধারার সমন্বয়

 

রবীন্দ্রনৃত্যে বিভিন্ন নৃত্যধারার সমন্বয়

 

রবীন্দ্রনৃত্যে বিভিন্ন নৃত্যধারার সমন্বয়

১৯২৭ সালে দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ থেকে বাসুদেবন নামের একটি ছাত্র শান্তি নিকেতনে কলাভবনে ভর্তি হন। শান্তিনিকেতন আসবার পূর্বে বাসুদেবন নৃত্য চর্চা করতেন। ভরতনাট্যমের কিছু ভঙ্গিকে পায়ের সহজ ছন্দে গেঁথে মনের আবেগ প্রকাশ করতেন। কিন্তু বিধিবদ্ধ ভরতনাট্যাম নয়। বলা যেতে পারে ভরতনাটমে নৃত্যভঙ্গির ভিত্তিতে আধুনিক নৃত্যের একটি ধারা।

নন্দলাল বসুর আগ্রহে শান্তিনিবে তনবাসী সকলেই তার নাচ দেখে মুগ্ধ। কবি তখন আশ্রমে ছিলো না। ফিরে এসে বাসুদেবনের কথা শুনে তার নাচ দেখলেন এবং স্থির করলেন। পরবর্তী অনুষ্ঠানে বাসুদেবনকে ব্যবহার করবেন। নটরাজ নাম পরিবর্তন করে যখন ঋতুরঙ্গ করা হলো তখন তাতে, প্রধান ভূমিকা ছিল বাসুদে। নের। বাসুদেবনের উল্লেখযোগ্য নৃত্য ছিল ‘যেতে যেতে একলা পথে’।

কোনোখানে তিনি এক নেচেছেন, কোনো গানে তার সঙ্গী ছিল ২/১টি ছাত্রী। বাসুদেবনের নাচে যে পুরুষোচিত বলিতো ছিল তা দেখে শান্তিনিকেতনের অনেক ছাত্রই নাচ শিখতে আগ্রহী হয়েছিল কিন্তু বাসুদেবানর নিজের ভরতনাট্যমের পদ্ধতিগত শিক্ষা না থাকায় তিনি ছেলেদের নাচ শেখাতে পারেনা। বটে কিন্তু নৃত্যের প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরী দিয়েছেন। শ্রদ্ধেয় শান্তিদেব ঘোষের নৃত্যের প্রেরণাও তার কাছ থেকেই পাওয়া ।

১৯৩১ এর জানুয়ারী মাসে শান্তিদেশ কেঁদুলী জয়দেব মেলাতে যান। তিনি খিলেছেন, এই মেলায় আমার যাতায়াত পূর্বেও ছিল। সখানে যখনি গেছি প্রতিবারই দু-একজন খুবই উঁচুদরের নাচিয়ে বাউলের দেখা পেয়েছি। তারে নাচ ছিল বিধিবদ্ধ ছন্দে, তালে গঠিত। পায়ের ছন্দের কাজে নানা রকম বৈচিত্র্য লক্ষ্য করতাম। এঁদের নাচের পুরুষোচিত শক্তির বিকাশ আমাকে খুবই মুগ্ধ করতো।

যদিও তাদের কাছে নাচ শিখিনি কিন্তু সেই নাচের প্রভাবে তাঁদের অনুকরণ করতে চেষ্টা করতাম। এ বছরেও সেইরূপ একটি বাউলের দেখা পেলাম মেলাতে। একটু মনোযোগ দিয়েই এবার তার নাচ দেখি। ফিরে এসে পূর্বের এবং এবারের অভিজ্ঞতাকে গুরুদেবের বাউল সুরের গানের সঙ্গে রূপ দেবার চেষ্টা করতে লাগলাম ।

একই সময়েই শান্তিদেব ঘোষ গুরুসদয় দত্তের আয়োজিত সিউড়ী লোকনৃত্যগীতের সম্মেলনে গিয়ে বীরভূমের রায়বেশে এবং ময়মনসিংহের মুসলিম সম্প্রদায়ের রুমাল হতে পুরুষের জারি নৃত্য দেখেন। সে বছর দোল উৎসবের সময় শান্তিদেব ঘোষ বাউল, রায়বেশে, জারি, মিলিয়ে নিজের কম্পোজিশনে নেচে হবার প্রশংসা পেয়েছিলেন। সন্ধ্যায় কবি নিজেও শান্তি দেবের নাচ দেখেন।

দোলের কিছুদিন পরে কলকাতার নবীন অনুষ্ঠানে শান্তিদেবকে বাউলের নাচের ধরনে একতারা হাতে নাচতে নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যে সিউড়ী থেকে রায়বেশে নাচের প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকদিনের জন্য নাচিয়ে আনানো হয়। নবীন অনুষ্ঠানে এবেলা ডাক পড়েছে, ফাগুন হাওয়ায়, হৃদয় আমার ঐ বুঝি তোর, ইত্যাদি গানের সঙ্গে দেশীয় বাউল, রায়বেশে ও জারির আদর্শে নৃত্যসংযোজন করা হয়েছিল।

এসময় কবি নিজে একতারা হাতে রাখার কয়েকটি ভঙ্গির নির্দেশ দেন এবং গানের কোন অংশে বসা বা ওঠা তার নির্দেশও দেন। সে বছরই গরমের ছুটির সময় আরো ভালো করে শিক্ষার উদ্দেশে শান্তিদের ঘোষকে কোচিন শহরের কেরালা কলমণ্ডলমে কয়েক মাসের জন্য পাঠানো হয়। তিনি সেখানে থেকে কথাকলির কিছু নৃত্যভঙ্গি বিশেষত কলাসম, সারি প্রভৃতি তালের নাচ এবং হাতের অভিনয় মুদ্রা ও তার ব্যবহার পদ্ধতি শিক্ষা করেন।

ইতিমধ্যে শ্রীমতি দেবী (হাতি সিংহ) নামের শান্তিনিকেতনের এক প্রাক্তন ছাত্রী জার্মানীর Rubolt von Laban, Marry Wigman, Must Jass এর প্রবর্তিত ইউরোপীয় আধুনিক নৃত্য শিখে দেশে ফিরে আসেন। গুজরাটের এক ধনাঢ্য পরিবারের কন্যা শ্রীমতি শান্তিনিকেতনে কলাভবনে ১৯২০ সালে যোগ দেন। ১৯২৭ এ জার্মানী গিয়ে ফিরে আসেন ১৯৩০ সালে। ১৯৩১ সালে মে মাসে দার্জিলিংয়ে কবি থাক কালীন শ্রীমতি দেবী সেখানে অবস্থান করছিলেন।

 

রবীন্দ্রনৃত্যে বিভিন্ন নৃত্যধারার সমন্বয়

 

কবির বিদায় অভিশাপ আবৃত্তির সঙ্গে সেখানে একটি নাচের অনুষ্ঠানে শ্রীমতি নেচেচিলেন ইউরোপীয় আধুনিক নৃত্য, রবীন্দ্রনাথ সে নাচ অনুমোদন করেন। সে বছরই বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে শ্রীমতি দেবী আধুনিক ইউরোপীয় নৃত্যধারায় ঝুলন কবিতায় আবৃত্তির সঙ্গে এবং এস নীপবনে গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। মেয়েদের দলবদ্ধ নৃত্য হয়েছিল মণিপুরী ঢং-এ। ঐ বুঝি কালবৈশাখী গানে কথাকলি, বাউল ও রায়বেঁশে নাচের অঙ্গভঙ্গি প্রয়োগ করা হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের জাভাবালি ভ্রমণ এবং সে দেশের নৃত্যের অভিজ্ঞতা কবিকে জাভাবালির নৃত্য সম্বন্ধে আগ্রহী করে তোলে এবং তিনি ইদোনেশিয়ার সুরকর্তা শহরে তামানশিষ্য বিদ্যালয়ে শান্তিদেব ঘোষকে জাভাবালির নৃত্য প্রশিক্ষণ নেবার জন্য পাঠান কয়েকমাসের জন্য। তামানশিষ্য বিদ্যালয়ের পরিচালক দেবান্তর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী ভক্ত। তিনি শান্তিদেবের নৃত্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন।

শান্তিদেব ঘোষের প্রতিটি ভ্রমণের ফলে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার নতুন কিছু না কিছু যুক্ত হয়েছে। প্রতিবার ভ্রমণ শেষে অভিজ্ঞতা এবং অর্জন রবীন্দ্রনাথকে দেখাতে হয়েছে এবং পরে তা ঋতুনাট্যের খণ্ড গানে বা নৃত্যনাট্যে ব্যবহার করা, হয়েছে।
শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় প্রতিমা দেবীর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী নবকুমার সিংহের কাছে ১৯২৫/২৬ সালে কিছুদিন মণিপুরী নৃত্যশিক্ষা করেন।

এছাড়া কবির সঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণে গিয়ে ইংল্যান্ডের ডার্টিংটন হলে ব্যালে নৃত্যের রচনা কৌশল দেখেন এবং কিছুটা প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন। কবির অধিকাংশ নৃত্যভিনয়ের পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রতিমা দেবীকে লক্ষ্য করি। নটীর পূজা থেকে শুরু করে চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, শ্যামা, শাপমোচন, মায়ার খেলা, তাসের দেশ, সামান্য ক্ষতি ইত্যাদি কাহিনীকাব্যগুলোকে মুকাভিনয় বা নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে নতুন রূপ দেবার প্রথম পরিকল্পনা ছিল তার।

নৃত্যের সাজ পোশাকও প্রতিমা দেবী নির্ধারণ করে দিতেন। নৃত্যোপোযোগী নাট্য এবং নৃত্যনাট্য রচনায় কবির নেপথ্যের মূল প্রেরণাদাত্রী ছিলেন প্রতিমা দেবী। ১৯২৬ সালে কবির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিমা দেবী পরিকল্পনা করেন যে, ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যের পূজারিনী কবিতা অবলম্বনে কেবলমাত্র ছাত্রীদের দিয়ে নবকুমারের সহেযাগিতায় আবৃত্তি, গান ও মণিপুরী নাচ সহযোগ মুকাভিনয় করানো হবে।

কবি সে কথা শুনে নিজেই কবিতাকে নাটকে রূপান্তরিত করে পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। গানের ভার ছিল দিনেন্দ্রনাথের ওপর আর নৃত্য পরিচালনা করলেন প্রতিমা দেবী ও নবকুমার সিংহ উভয়ে। নটীর পূজার শেষ গান ‘আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো সম্পূর্ণভাবে নৃত্যের মাধ্যমে অভিনীত হয়েছিল। এই নাটকের অন্যান্য গানেও নৃত্যের প্রয়োগ ছিল। এতদিন পর্যন্ত নাটকে নৃত্যের প্রচ্ছন্ন ভাব থাকতো।

এই প্রথম গানের সঙ্গে সচেতন ভাবে নৃত্যকে লোবার চেষ্টা করা হলো। নটীর পূজায় নৃত্যকে নাটকের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পাওয়া গেল। কারণ নৃত্রেরই অর্ঘ্যে নটী তার পূজা সমাপন করে। নটীর পূজার বিষয়বস্তুর সঙ্গে নৃত্য অঙ্গীভাবে যুক্ত। ভৈরবী রাগিনীতে রচিত গানটির সঙ্গে আচার্য নন্দলালবসুর কন্যা গৌরি দেবীর মণিপুরী নৃত্য সহযোগে শ্রীমতির আত্মনিবেদনের ভঙ্গিমা সকল দর্শকের উচ্ছসিত প্রশংসা লাভ করেছিল।

 

রবীন্দ্রনৃত্যে বিভিন্ন নৃত্যধারার সমন্বয়

 

নটীর পূজা কয়েকবারই অভিনীত হয়। ১৯৩১ সালে কবির ৭০তম জন্মদিনে কবি শ্রীমতির নাচ সম্পূর্ণ নতুনভাবে রচনা করতে নির্দেশ দিলেন। এবারে নাচের দায়িত্ব ছিল শাস্তিদেন ঘোষের উপর। তিনি কথার ছন্দের সঙ্গে পদ ছন্দকে মিলিয়ে ছিলেন ভাবটি ঠিক রেখে। কবি দুরকম নাচই পাশপাশি দেখেন। মণিপুরীর সঙ্গে কথাকলি ও বাউলের নৃত্যছন্দের মিলন ঘটে। এই নতুন রচিত নৃত্যটি কবির সমর্থন পায় এবং কলকাতাতেও প্রশংসা লাভ করে।

আরও দেখুন :

Leave a Comment